বাবার খুনি

বাবার খুনি

আমার বয়স তখন ১০/১২ বছর, আমি তখন ঠিক কিছু বুঝতাম না। অল্প কিছু বুঝতে শিখেছি, আমি স্কুল থেকে ফিরেই দেখি বাবা আমার মা কে মারছে, আমি কিছু বলতে গেলেই আমাকে কসে গালে একচর মেরে মাটিতে শুয়ে দিলো।
.
এটা নতুন কিছু নয় প্রায় প্রতিদিনই আমার চোখের সামনে বাবা মাকে ইচ্ছে মত মারতো! আমার এক বড় ভাই আছে বাবার ভয়ে কিচ্ছু বলতে পারে না, ভাবিও ঠিক তেমন নি কেউ কোনো কথা কয় না।
সবার চোখের সামনেই মা বাবার হাতে প্রচন্ড মার খেত কিন্তু মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হতো না মা” র।
আরও মার খাওয়ার ভয়ে মা চুপ করে থাকতো, মারার সময় মা কিছু না বললেও পরে মা ডুকরে ডুকরে কান্না করে।
আমি প্রায় প্রতি রাতেই আমার সেই ব্যাথা স্থান গুলোতে গরম তেল দিয়ে দিতাম, আমি যখন মা” র গায়ে তেল দেই তখন মা আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।
চোখে ছল ছল করে পানি, মনে হয় কিছু জানি বলবে আমাকে।
কিন্তু বাবার ভয়ে মা আমাকে কিছুই বলে না।
সব কিছুই নিরবে সহ্য করে, ভাই ভাবি ও কিছু বলে না।
এই সংসারে মা শুধু একাই কষ্ট করে।
সামান্য ভুল হলেই মার খেতে হয় মাকে…
.
এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকে বাবার অত্যাচার।
আমি ছোট বলে কিছু বলার সাহস পাই না, যদিও কিছু বলি তাহলে বাবা আমাকে মাটিতে মাজা সমান খাল করে পুতে রাখতো, যতক্ষণ রাগ কমতো না, ততক্ষণ মাটির ভেতরেই থাকতে হয় আমাকে।
এই ব্যাপারে মা যদি কিছু বলে তাহলে আবার মার শুরু, সেইজন্য মাও কিছু বলতে পারে না।
দূর থেকে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতো আর আচল টা মুখে দিয়ে কাঁদতো…
.
আমি যখন কলেজে পড়ি তখন আমার বন্ধুর সাথে একটা প্রব্লেম হইছিল, এ কথা বাবা জানতে পেরে আমাকে প্রায় ৩ দিন মাটিতে পুতে রাখছিল, আমার খুব কষ্ট হইছিল।
আমি সেই ছোট নেই এখন কিছু বলতে শিখেছি।
তাই চিল্লাচিল্লি করতে লাগছিলাম, আমার কষ্ট দেখে ভাই এসে মাটি সরাতে লাগছিল, কিন্তু বাবা পেছন থেকে এসে ভাইয়ের মাজায় গাছের একটা ডাল দিয়ে এমন ভাবে বারি দিয়েছিল ভাই সাথে সাথে বেহুশ।
সবাই কান্নাকাটি করতে লাগছিল।
গ্রামের অন্য একটা চাচা এসে ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।
তার কিছুক্ষণ পর বাবা এসে আমাকে উপরে তুললো।
আমি প্রায় পাগল হয়ে গেছিলাম, ভাইকে অনেক ভালবাসতাম।
আমি সাথে সাথে হাসপাতালে গেলাম, গিয়ে দেখি ভাইয়ের জ্ঞ্যান ফিরছে, ধিরে ধিরে কথা বলছে।
আমাকে দেখেই ভাই কেঁদে ফেললো, উঠতে পারছে না তবুও বুকে জরিয়ে নিতে চাইলো।
আমি আর কান্না থামাতে পারলাম না…
.
এত কিছু হয়ে গেল তবুও বাবা হাসপাতালে যায় নি, মা কেউ যেতে দেয়নি।
এত কষ্টের মধ্যে চলতো আমাদের পরিবার।
সবাই বলে পরিবারে বাবা নাকি বটগাছ, আমার বাবা কি গাছ?
সব সময় শুধু অত্যাচার আর অত্যাচার করে গেছেন।
.
এভাবেই আমার এই কথা গুলো একদিন কলেজে পৌছে গেল, সেখানে সবাই আমাকে অনেক ভাবে অপমান করতো।
কিন্তু আমি কাউকে কিছু বলতে পারতাম না শুধু বাবার ভয়ে।
দিনের পর দিন আমাকে সহ পরিবারের সবার উপরেই অমানবিক অত্যাচার চলতেই থাকতো…
.
আমি এইচ এস সি পরিক্ষাতে কোনো রকমে পাশ করছি, সেইজন্য বাবা আমাকে অনেক মারধর করে।
আর এই ব্যাপার গুলো নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে, টিটকারি মারে এতে আমার মানুষিক চিন্তা আরও বাড়তে লাগলো, আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
এত কিছু সহ্য করতে না পেরে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছিলাম।
কিন্তু বাড়ি থেকে বাহির হওয়ার পর মা” র উপরে আরও চাপ পরে।
আমি বাহিরে থাকতেই মাকে বাবা আরও বেশী মারতো।
এক সময় মা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায় আমাদেরকে ছেড়ে।
আমি নিজ হাতে আমার মায়ের কবরে মাটিও দিতে পারিনি।
আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিলো বাহিরে থাকতে, তাই মা মারা যাওয়ার ৭দিন পর বাড়িতে নিয়ে আসে।
বাবার উপরে অনেক রাগ হচ্ছিলো!
.
আমি একদিন বাবাকে বলছি আর কত জালাবে তুমি আমাদেরকে?
বাবা চুপ হয়ে ছিল।
কিন্তু গ্রামের সব লোক বাবাকে নিয়ে খোটা দিত, আমার এই বিষয় গুলো অনেক খারাপ লাগতো!
.
আমার বয়স এখন ২০ বছর তবুও বাবা আমাকে ছাড় দিতো না,
গ্রামের একটি মেয়েকে নিয়ে ঝামেলা হইছিল সেই জন্যে বাবা আমাকে হাত পা ধরে আবার মাটিতে পুতে রাখছিল।
সেদিন আমার অনেক রাগ হয়েছিল, আমি আর কিছু না করতে পেরে বাবা কে খুন করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছি।
আমি এই জন্যে ভাই আর ভাবিকে বললাম,
তোমরা শুধু আমার পাশে থেকে হেল্প করবে।
যা করার আমি নিজেই করবো, যদি পুলিশি কিছু হয় তাহলে সেখানে আমিই যাবো।
.
ভাবির পরামর্শ অনুযায়ী বাবাকে একদিন রাতে ভাতের সাথে ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়ানো হলো, বাবা ভাত খেয়ে ঘুমে বিভোর।
আর সেই সুযোগ নিয়েই এক কোপ দিলাম মাথাটা আলদা হয়ে গেল।
একটু ভয় লাগছিল তারপর ভাই আর ভাবি আসলো রুম থেকে, সবাই মিলে বাবাকে নিয়ে গোয়াল ঘরে গেলাম।
সেখানে আমি আর ভাই মিলে একসাথে একটা কবর খনন করে বাবার মাথাটা সহ চাপা মাটি দিলাম।
কিন্তু বাবার জামা গুলো পায়খানার ভেতরে রাখলাম।
.
আমি বাবাকে খুন করছি নিজের হাতে সেইজন্য আর রাতে কিছুই করতে পারলাম না।
আমি ভোর হতে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম, ভাই ভাবি সকালে খুঁজছে কিন্তু পায় নি।
প্রায় ৩ দিন পর গ্রামের সবাই ভাইকে বলে কিরে তোর বাপ কই?
ভাই বলে কই গেছে বাড়িতে কয়ে যায় নি।
তোরা মিথ্যা বলছিস! আর তোর ছোট ভাই কই?
তাকেও তো ৩দিন ধরে দেখছি না।
কি হইছে বল না হলে পুলিশ কে জানাবো।
পরে পুলিশ বাড়িতে এসে সব কিছু খোঁজে পায়খানায় রক্ত মাখা কাপড় দেখে-
ভাই আর ভাবিকে ধরে নিয়ে যায়।
আমি খবর পেয়ে একটা পুলিশের সাথে কথা বললাম, আমার ভাই ভাবি কিছু করে নি।
যা কিছু সব আমি নিজে করেছি ওদেরকে ছেড়ে দিন! তুই থানায় এসে ধরা দে আমরা ওদেরকে ছেড়ে দিবো।
আচ্ছা ঠিক আছে আমি আজকেই স্যালেন্ডার করব, তবুও ভাই ভাবিকে ছেড়ে দিন।
আচ্ছা তুই আগে থানায় আয় তারপরে!
.
আজকে আমি থানায় ধরা দিয়েছি, আমার সব কিছু বিচার করে আমাকে ৭ মাসের জেল দিলো।
আমার যে রাগ হইছিল বাবার উপরে তার চেয়ে এই ৭ মাস অনেক কম।
.
৭ মাস পর…
আজ আমার মুক্তির দিন, আজকেই ভাই ভাবির কাছে যেতে পারবো!
কিন্তু এই কথা গুলো ভাবতেই আমার দুটি চোখের কোনে অজান্তেই পানি জমলো।
এর কারণ আমি বুঝতে পারলাম না, হয় তো এই বেঈমান মনটা আজ মা বাবা কে মিস করছে।
কিন্তু এই গুলো কেয়ার না করেই বাড়িতে চলে আসলাম…
.
কিছু কথা- জন্ম থেকেই কোনো ছেলে/মেয়ে সন্ত্রাসী বা খারাপ হয়ে জন্মগ্রহণ করে না।
এটা পরিবারের অতিরিক্ত শাসন আর সন্তানদেরকে যথাসময় কেয়ার না করায় আপনার ছেলে সন্ত্রাসী বা খারাপ হতে পারে…
.
.
………………………………………. সমাপ্ত ……………………………………

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত