পরিবর্তন/আর্তনাদ

পরিবর্তন/আর্তনাদ

পরিবারের সম্মতিক্রমে ২০১৫সালের মার্চ মাসে আতকিয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়। কিন্তু সে ধার্মিক ও পরহেজগার মেয়ে আর আমি হলাম পুরোই তার বিপরীত।

নামাজ, রোজা তো দূরের কথা আল্লহর নামটাও মুখে নিতাম না।
.
তাকে আমার পছন্দ হত না। আমি একজন স্মার্ট ছেলে হয়ে কি করেই বা তাকে পছন্দ করব। কিন্তু আব্বুর বন্ধুর মেয়ে বলে কথা।

তাঁদের বন্ধুত্বের বন্ধনকে আরও মিতালী করার জন্যই দুই পরিবারের সম্মিতে এই বিয়েটা হয়। তাই আব্বুর মুখের ওপর এ সম্পর্কে কিছু বলতে পারিনি।

আমার আব্বুও ছিল একজন আলেম মানুষ। তাই হয়ত সে আতকিয়াকে আমার জন্য পছন্দ করে রেখেছিল।
.
বিয়ে হওয়ার পর থেকে মেয়েটা প্রতিনিয়ত আমাকে ভাল হওয়ার জন্য খুব বলতো। নিজেও নামাজ পড়ে আমার জন্য দোয়া করতো। একদিন গভীর রাত্রিতে আমার ঘুম ভাঙ্গল।

বিছানায় আমার পার্শে তাকে খুজে পাচ্ছিলাম না। পরে তাকে আবিষ্কার করলাম জায়নামাজে তাঁর গুনগুন কান্নার আওয়াজ শুনে। আমার হেদায়তের জন্য প্রভূর নিকট প্রার্থনা করতেছে।
.
প্রার্থনা শেষ করে আবার যখন বিছানায় সুইতে যাবে, ঠিক ঐ সময় আমি সোয়া অবস্থা থেকে উঠলাম। ডিম লাইটের তীব্র আলোতে তাঁর মুখের দিকে তাকালাম।

আহহা, কি অপূর্ব সুন্দর। বিয়ের পর থেকে তাঁর মুখের দিকে কখনো এভাবে তাকাইনি। মনের অজান্তেই মুখ থেকে আলহামদুলিল্লাহ বের হলো।
.
— আচ্ছা একটা কথা বলতে পারি?
— একটা কেন সহস্র কথা বলতে পার।
— আমি তোমার আম্মুর থেকে শুনেছি, তুমি তো আগে এইরকম ছিলে না। হঠাৎ এত পরিবর্তনের কারণ?
.
আতকিয়া বলল, “আসলেই আমি আগে এইরকম ছিলাম না। ধর্মের প্রতি অবহেলিত একটা মেয়ে ছিলাম। আর হ্যাঁ, আমার বয়স যখন ১০-১১বছর ছিল,

তখন একবার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে নৃত্য পরিবেষণায় আমি ১ম হয়েছিলাম। এরপর আমার এক স্যার গান শিক্ষা কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দেয়।

সেখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি কণ্ঠ চর্চা ও নৃত্য শিখতাম।”
.
বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমাদের দলকে ইনভাইট করত। সেখানে আমি কণ্ঠ/নৃত্য শিল্পী হিসাবে যেতাম।

দর্শকদের বাহবা, হাত তালি, প্রত্যেকের মুখে আমার প্রশংসাসহ বেশ সু-নাম কুড়িয়েছিলাম। এছাড়াও একটি দেশাত্বকবোধক গানের জন্য একাডেমিক কৃর্তক পুরুষ্কারও পেয়েছিলাম।
‘এই পর্যন্ত বলে আতকিয়া থামল’।
.
আমি বল্লাম, “কি হলো থামলে কেন? একজন কণ্ঠ শিল্পীর লাইফ হিস্টোরি শুনতে ভালই তো লাগছে। তারপর কি হলো?”
.
আতকিয়া বলল, “তারপরের ঘটনা কষ্টকর হৃদয়বিদায়ক কাহিনী। আমার শৈসব কাল থেকেই একজন ভাল বান্ধবী ছিল। তাঁর নাম আনিসা।

তাঁর সাথে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁর কোন বিপদ হলে আমি ঠিক থাকতে পারতাম না এবং সেও আমার বিপদে স্থির থাকত না।”
“কিন্তু আমাদের দুজনের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা পৃথিবীতে বেশিদিন স্থায়ী হলো না। আমি জানি বন্ধুত্ব কোনদিন মরে না, বন্ধুত্ব জ্যান্ত থাকে।

যদিও বা মানুষটি মারা যায়, কিন্তু বন্ধত্ব আর স্মৃতি কোনদিন মরতে পারে না।”
.
“আনিসা আপু আজ আমার সাথে নেই, কিন্তু তার স্মৃতি আছে। ভুলিনি ভুলবও না, কখনও না, কোনোদিন কিংবা এক মুহূর্তের জন্যও না। ফিরে এসো আনিসা আপু।

তোমার সাথে হাসি তামশ্যা, গল্প করব। কিন্তু আর আসে না কিংবা কোনদিন আসবেও না। আর বলবেও না আতকিয়া একটা গান শুনাওতো রে।”
.
“২০০৬সালে ৭ই মে, দিনটি ছিল রবিবার। আনিসা আপুর বড় ভাই(সাইফুল) ভাইয়ার বিয়ে। বিয়ের ৩দিন আগ থেকেই তাদের বাড়িতে ঘুমাতে হচ্ছে, বিয়ে বলে কথা।

খুসির খবর শুনলে রাতগুলো যেন পোহাতেই চায় না।”
.
“বিয়ের উদ্দেশ্য মাইক্রো বাসে করে যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের গাড়ীতে বর যাত্রীর পক্ষ থেকে আমি ও আনিসাসহ আরও বেশ কয়েকজন ছিল।

কিন্তু গাড়ীতে ওঠার পর থেকে আনিসাকে আর আগের মতো আনন্দিত দেখা যাচ্ছে না। মনমরা মানসিক রোগীর মতো আমার পার্শে বসে আছে।

আমিও তাঁর সাথে তেমন বেশি কথা বলিনি। শুধু একবার বলেছিলাম, আনিসা তোমার কোন সমস্যা হচ্ছে? প্রত্যুত্তরে সে না সূচক জবাব দিয়েছিল।”
.
“অর্ধপথ অতিক্রম করার পর একটি বাস ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষণ হয়েছিল। ফলে আমাদের চলতি মাইক্রোটি ট্রাকের পিছনে গিয়ে লাগে।

এতে করে গাড়ীর প্রত্যেক ব্যক্তিই আহত হয়েছিল।”
.
“আমার মাথায় ও কানে অনেক আঘাত পেয়েছিল। আর আনিসার মাথায়, মুখে, কানে ও হাত-পায়ে কঠিনভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়।

তার মুখ দিয়ে শুধু এতটুকু কথা বের হয়েছিল যে, আতকিয়া পানি খাবো।
এরপর কি হয়েছিল আর জানি না। কেননা, আমিও তখন জ্ঞান হারাই।
অবশেষে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করলাম। সেখানে স্পষ্ট পরিচিত কণ্ঠে কান্নার আর্তনাদ শুনা যাচ্ছে। নিশ্চিত কেউ মরেছে। পার্শেই এক আন্টি দাড়িয়ে চোখের জল মুসছে।”
— আন্টিকে বললাম, আনিসা কই?
— নিশ্চুপ।
— কথা বলছ না কেন আন্টি?
— সে বেঁচে নেই রে মা!
— আনিসা..! আবার অজ্ঞান হয়ে পরলাম।
.
“সাত দিনপর অর্ধ সুস্থবস্থায় মেডিকেল থেকে বাসায় ফিরলাম। আজকে কেন জানি বুকটা ধরপর করছে। শেষপর্যন্ত তাঁর মৃত্যু দেহটাও দেখতে পেলাম না।

তাঁর মাকে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে ঢুকরে কাঁদতে লাগলাম। আন্টি, আনিসাকে আমার কাছে এনে দাও না কেন? কোথায় সে হারিয়ে গেল আমাকে ছেড়ে?”
“কেন মৃত্যুশয্যাহিত আনিসার মুখে একটু পানি পর্যন্ত খাওয়াইতে পারলাম না। এখনও নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়, খুব।”
.
তাঁর মৃত্যুর পর থেকে মনের মধ্যে কেমন যেন খোদাভীতি নামক অনুভূতিটা জাগ্রত হলো।

তখন থেকে বিধাতার নিকট তওবা করে এই আলোর পথে ফিরে এসেছি।
.
এতক্ষণে আমি (নাঈম) কান্নায় চোক্ষদ্বয় লাল করে ফেলছি।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত