রনকের গোয়েন্দাগিরি

রনকের গোয়েন্দাগিরি

দারুণ করিৎকর্মা ছেলে রনক। ইতোমধ্যে সে বেশ নাম কুড়িয়ে ফেলেছে। সেটা অবশ্য পড়ালেখার ক্ষেত্রে নয়। কোনো প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও নয়। পড়াশোনায় সে আহামরি কিছু নয়, টিটিপি টাইপের; মানে- টেনেটুনে পাস। আর প্রতিযোগিতা, সে আর বলতে! কবিতা হোক, গান হোক আর কোনো বক্তৃতা হোক, সমানে তার হাঁটু কাঁপতে থাকে। পড়ি পড়ি অবস্থা। গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ। তাই পারতপক্ষে এসব থেকে সে একটু দূরে দূরেই থাকে। তাহলে সে নাম কুড়ালো কিসে? আর দেরি না করে বলেই দেই- গোয়েন্দাগিরিতে। হ্যাঁ, সে নাম কুড়িয়েছে গোয়েন্দাগিরিতে। রনক পড়ে ক্লাস ফাইভে। তাতে কী? তার গোয়েন্দা ব্রেইন একেবারে টনটনে। এরই মধ্যে সে কয়েকটি ছোটখাটো কেসের সমাধান করে ফেলেছে। এতে তার নামও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে একজন সহকারীও জুটে গেছে গোয়েন্দা রনকের। ওর নাম হলো চিনু। কেউ কেউ বলে, কারাতে চিনু। বেশ ভালো কারাতে জানে। রনকের তুলনায় বেশ লম্বা। বিপদাপদে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায় চিনুর কাছ থেকে। অনেক সময় বড় মানুষকেও ভড়কে দিতে পারে। রনকের আরেকজন বন্ধু আছে। ওর নাম সালিন। বেশ মোটাসোটা, ভদ্র ছেলে সালিন। ওকে যেকোনো কাজে লাগানো যায়। বিনিময়ে ওকে দিতে হবে আইসক্রিম। ওকে আইসক্রিম গিফ্ট দিয়ে অনেকেই অনেক কাজ করিয়ে নেয়। আইসক্রিমের বিনিময়ে সালিনকে দিয়ে কী কী কাজ করিয়ে নেওয়া যায়, সেই কথা আরেকদিন হবে। রনক কিভাবে গোয়েন্দাগিরিতে নাম করল, বরং সেই কাহিনীই জানা যাক। রনকরা যে মহল্লায় থাকে, তার শেষ প্রান্তে পাকা রাস্তা। এরপরই গ্রাম্য এলাকা। ওরা কদাচিৎ এখানে আসে ঘুরতে। সেরকম একদিন বিকালবেলা রাস্তার পাশে বসে সামনে দিগন্তজোড়া ফসলের ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে ছিল। এসব প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে কেমন যেন আনমনা হয়ে যায় রনক। এসব দৃশ্য ওর মনে খুব দাগ কাটে। হঠাৎ খুব ব্যস্তভাবে ওদের পাশ কাটিয়ে এক লোক চলে গেল। হালকা লিকলিকে ধরনের লোকটি। আরেকটু হলে ধাক্কাই লাগত। সেদিকে যেন লোকটির কোনো খেয়ালই নেই। রনকের কেন যেন লোকটিকে চেনা চেনা মনে হলো। কোথায় যেন দেখেছে তাকে। মনে করার চেষ্টা করল। অপরিচ্ছন্ন ও ছেঁড়া কাপড়-চোপড় পরিহিত অবস্থায় মাঝেমধ্যেই কোথায় যেন দেখা যায় লোকটিকে। হঠাৎ করেই মনে পড়ল রকের- অ্যা রে, ওকে তো দেখেছি স্কুলের কাছেই ভিক্ষা করতে। তবে স্বাভাবিক অবস্থায় নয়, ল্যাংড়া বা পঙ্গু অবস্থায়। তাহলে এখন লোকটি স্বাভাবিকভাবে হাঁটছে? ব্যাপারটা কী? সালিন বলল, ‘ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক। লোকটিকে কোথায় যেন দেখেছি। বস্ কেসটা আমাদের একবার দেখতে হয়’- সালিন বেশ মাথা খাটিয়ে বলল। সালিন আজ রনকের সঙ্গেই ঘুরতে বের হয়েছিল। রনকও বিষয়টি ভাবছে। ভাবাভাবির সময়টায় রনক বেশ আনমনা হয়ে যায়। ‘ওর ওপর আমাদের নজর রাখতে হবে’- এ কথা বলে ওরা দুইজন উঠে দাঁড়াল। পরদিন ওরা স্কুলের আশপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখল। কোথাও দেখা গেল না লোকটিকে। স্কুলে ঢুকে পড়ল ওরা। টিফিনের সময় আবার গেটের বাইরে এলো। চারদিকে সতর্ক নজর বুলালো। হঠাৎ দেখল, সেই লোকটি এগিয়ে আসছে। ভাঙা ক্র্যাচে ভর দিয়ে লোকটি এগিয়ে গেটের একটু দূরে এসে দাঁড়াল। ওদের তিন মাথা এক জায়গায় হলো। ফিসফিস করে পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলল রনক। সবশেষে ‘অ্যাকশন’ শব্দটি উচ্চারণ করল রনক। সালিন সবার সামনে। হঠাৎ বলা নেই-কওয়া নেই এগিয়ে এসে লোকটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মটকু সালিনের নিচে পড়ে লিকলিকে লোকটির কাহিল অবস্থা। কিন্তু অবাক ব্যাপার, লোকটির লুঙ্গির নিচ থেকে আপনাআপনি অন্য পা বেরিয়ে এলো। রনক মুচকি হাসল। হাত ধরে লোকটিকে উঠাল। ‘আমি গোয়েন্দা রনক, প্রতিবন্ধী সেজে স্কুলের সামনে ভিক্ষা করার উদ্দেশ্যটা কী?’- বেশ কঠিন সুরে বলল রনক। ওদের কথায় লোকটি ভয় পাবে কি, মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। ছেঁড়া পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা পরিচয়পত্র বের করে ওদের সামনে তুলে ধরল। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য। ‘খাইছে আমারে’- সালিন মুখ ফুটে বলে উঠল। ওদিকে, কারাতে চিনু সাঁই ফাঁই করে কারাতের ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছিল। পরিচয়পত্র দেখে সঙ্গে সঙ্গে একেবারে ফ্রিজ হয়ে গেল। ‘ইভ টিজারদের গতিবিধি লক্ষ করার জন্য আমি ছদ্মবেশে এসেছি। তাও তো ধরা পড়ে গেলাম।’- গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য বলল। এসব কথা শুনে ওদের তিনজনের মুখ একেবারে হাঁ হয়ে গেল। ‘গোয়েন্দা রনক, তোমাকে ধন্যবাদ’ বলে একটি ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিল লোকটি। কী বলবে, বুঝতে পারছে না রনক। সালিন তো জিহ্বায় কামড় দিয়ে বসল। বড় গোয়েন্দা কিনা ধরা খেল ছোট গোয়েন্দার কাছে। মনে মনে বন্ধু রনকের প্রশংসা না করে পারল না সে। গোয়েন্দা রনকের সহকারী হতে পেরে গর্বে তার বুকের ছাতি এক ইঞ্চি ফুলেও উঠল। এবার বড় গোয়েন্দা বলল, ‘ইদানীং এই এলাকায় ইভ টিজারদের দৌরাত্ম্য অনেক বেড়ে গেছে। মেয়েরা ঠিকমতো স্কুলে যেতে পারছে না। তাই ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাকে দায়িত্ব দিয়ে এখানে পাঠানো হয়েছে। এজন্যই পঙ্গু সেজে এখানে এসেছিলাম।’ রনক বলল, ‘আমরা কি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারি?’ ‘অবশ্যই’- বড় গোয়েন্দা বলল। এরপর ওদের টেনে নিয়ে একটা আমগাছের নিচে দাঁড়াল। চার মাথা এক হলো। বড় গোয়েন্দা ওদের বুঝিয়ে বলল, কী কী করতে হবে। ওরাও মাথা নেড়ে নেড়ে সায় দিল। স্কুলের কয়েকজন বড় আপুকে ইভ টিজারদের ব্যাপারে আলাপও করতে শুনেছে। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস কারো নেই। কারণ, ছেলেগুলো অনেক বেপরোয়া। ওরা কেউ পড়াশোনা করে না। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসে থাকে, চা খায় আর আড্ডা মারে। মেয়েদের দেখলে নানা রকম মন্তব্য করে, হাসাহাসি করে। কথামতো ওরা তিনজন গোপনে ইভ টিজারদের মনিটরিং করতে লাগল। আর বড় গোয়েন্দার দেওয়া একটি গোপন মোবাইল নাম্বারে খবরাখবর পাঠাতে লাগল। বেশ কয়েকদিন পরের কথা। এক দিন স্কুলের গেটের সামনে কর্কশ স্বরে পুলিশের সাইরেন বেজে উঠল। হেড স্যারের পেছন পেছন বাইরে এসে ওরা তিনজন দেখল, ইভ টিজারদের লাইন ধরে পুলিশের গাড়িতে ওঠানো হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ওদের দিকে হাত উঁচু করে ‘ভি’ চিহ্ন দেখাল। ওরাও তা-ই করল। এভাবে গোয়েন্দা রনক আরো একটি কেসের সমাধান করে ফেলল।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত