কূলবধূ

কূলবধূ

সিরাজবাগের সদাশিব বাবু যেমন ধনী তেমনি মহৎ । নিজের কাজ ছাড়াও অন্য কোন মানুষের দরকারে অদরকারে ঝাঁপিয়ে পড়তে পিছুপা হন না তিনি । সৎ মানুষ হিসেবে তাঁর বেশ সুনাম আছে,তাঁর নিজস্ব ব্যবসা । চুমকি আর জরির শাড়ির দোকান ।তার দোকানে প্রচুর খদ্দের নিত্যি ভীড় করে থাকে । বিভিন্ন শাড়িতে চুমকির কাজ করার জন্য প্রচুর অর্ডার পড়ে ।জরির পাড় লাগাতেও ভীড় করে থাকে ছেলেমেয়েরা । পূজাপার্বণ আর অনুষ্ঠান এর মরশুমে সারা বছর ধরে তাই তার ব্যবসা রমরমিয়ে চলে ।

সদাশিব বাবুর পুত্র প্রদীপ ব্যবসায় বাবাকে সাহায্য করে প্রদীপের বিয়ের বয়স হয়েছে । সদাশিব বাবু কুলবধু হিসেবে এমন একজনকে আনতে চান যে রূপে-গুণে সুন্দর হবে । দূর দূর থেকে অনেক মেয়ের খোঁজ আসে , কিন্তু সদাশিব বাবুর কাউকে মনে ধরে না । আসলে ধরবে কি করে তারা যে সদাশিব বাবুর নেওয়া পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না । এই তো কদিন আগেই তিতাসপুরে নির্ঝর বাবুর মেয়ে দেখতে সদাশিব বাবু গেছিলেন। সব কিছুই তার ভালো লেগেছিল কিন্তু বাদ সাধল একটা জায়গাতেই । সে মেয়েকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, সে সাজগোজ করতে ভালোবাসে বলে প্রত্যেক মাসেই নতুন ধরণের কোন জরি বসানো শাড়ি দোকানে এলেই সে কিনে ফেলে , কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই সে শাড়িতে তার অরুচি ধরে যায়। মন তখন ব্যাকুল হয়ে ওঠে আবার কোন ঝাঁ চকচকে নতুন শাড়িরজে । সদাশিব বাবু বুঝলেন এই মেয়ে তার পুত্রবধু রূপে এলে তার খরচ যোগাতে যোগাতে হিমশিম খাবেন তিনি আর তার ব্যবসার লোকন হবে। সঞ্চিত ধনে টান পড়বে। নাহ এ মেয়ে বাতিল । আবার নতুন করে খোঁজশুরু করতে হবে তাঁকে ।

এইরকম করে দিনের পর দিন কেটে যায়,মনের মতন আর কাউকে তিনি পান না । একদিন তিনি দোকানে বসে ভাবছেন কি করা যায়, এমন সময় একটি মেয়ে এল তার দোকানে । সে এসেই জিগ্যেস করল , “আচ্ছা আপনার দোকানে জরি বা চুমকি ছাড়া কোন শাড়ি নেই ?” সদাশিব বাবু তাকে এক পলক দেখে বললেন,-“কেন মা, আজকাল তো এইরকম শাড়ি সবাই পড়ছে, তুমি বুঝি এই ধরনের শাড়ি পরতে পছন্দ কর না ?” মেয়েটি হেসে উত্তর দিল-“আমিও পরতে ভালবাসি, তবে আমার ঘরে অনেক কাজ করা শাড়ি আছে, যা অনেক পুরোনো হয়ে গেছে কিন্তু জরির পাড় আর চুমকিগুলো  এখনও সুন্দর আছে, তাই আমি এমন শাড়ি জছি যাতে আমি সেই চুমকি আর জড়ি গুলো ছোট্ট আল্পনায় ভরিয়ে নতুন করে তুলতে পারি । আমি আঁকতে জানি ,তাই নিজেই সেসব এঁকে নিতে পারব। ” এই বলে মেয়েটি থামল ।

তখন সদাশিব বাবু তাকে সুন্দর দেখে অনেক শাড়ি বের করে দিলেন আর কথার ফাঁকে তার নাম কি, বাড়ি কোথায় আর বাড়ি্তে কে কে আছে জেনে নিলেন মেয়েটির নাম শ্রী। বেশ ছোট্ট নাম ও সুন্দর। বাড়ি গোপালবাগে।তার বাড়িতে তার বাবা, মা ও ছোট বোন ছাড়া কেউ নেই ।অল্প কয়েক বিঘে জমি আছে যেখানে তার বাবা ছোট্ট ছোট্ট চারাগাছের সৃষ্টি করে । তার পর হাটবারে সেই চারাগাছ বিক্রি করে দেয় । সারাদিন  গাছেদের যত্ন, নতুন কলম তৈরী , বীজের চারাদের দেখাশুনা করা এতেই সব সময় চলে যায় ।মা অনেক রকম সেলাই-ফোঁড়াই জানে । নানা রকমের সুতোর জালে শাড়ি, চাদর বুনে ফেলে অবসর সময়ে । ছোট্ট থেকে শ্রী তার মায়ের কাছে শিখতে শুরু করেছে হাতের কাজ । একটু একটু করে শিখে আজ সে নিজে বাড়িতে আরো অনেক কে শেখায় । এই ভাবেই তাদের সংসার চলে । মেয়েটি সম্পর্কে সদাশিব বাবু খোঁজ় নিয়ে এত কিছু জেনে মনে মনে খুব খুশী হলেন । যদিও দোকা মেয়েটি কে দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন । আজ আরও খুশী হলেন । এরকম মেয়েই তো তিনি খুঁজছিলেন । কিছু দিনের মধ্যেই তিনি মেয়ের বাড়িতে হাজির হলেন । মেয়ের বাবা , মা তো সদাশিব বাবুকে ফুল তোলা কার্পেটে বসালেন । ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে সদাশিব বাবু বুঝতে পারলেন ঘরদোর গুছানো । দেওয়ালের কোণায় কোণায় হাতের কাজের নিপুণ ছোঁওয়া । এত কিছু দেখা সত্ত্বেও তার মনের মধ্যে ছোট্ট পরীক্ষা নেওয়ার ইচ্ছা জেগে উঠল। তিনি মেয়েটিকে ডেকে ঘি রঙের গরদের শাড়ি ও একটি আকাশী রঙের শাড়ি দিলেন । ইচ্ছা করে বললেন “এই শাড়ি দুটি তে কি কাজ করা যায় বলতো মা, আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিনা, অথচ কম খরচে সুন্দর কোন কাজ আমাকে করে দিতে বলেছে একজন । তুমি বলতে পারো এত কম খরচে কি করে শাড়িটি সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা যায় ?” মেয়েটি এক পলক তাকিয়েই বলল, -“আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন , আমি দেখছি কি করা যায় ।”

সপ্তাহ পরে একদিন সদাশিব বাবু দোকানে বসে হিসেবের খাতা মেলাচ্ছেন, এমন সময়ে “আসতে পারি ভিতরে?” শুনে তাকিয়ে দেখলেন শ্রী এসেছে । হাতের প্যাকেট টি খুলে শাড়ি দুটি হাতে তুলে দিল মেয়েটি । নীল শাড়িটির অপূর্ব ঔজ্জ্বল্য যেন ঠিকরে পরছে চুমকির অসাধারণ কাজের স্পর্শে । ঘি রঙের শাড়িটিও যেন এক অন্য রূপ পেয়েছে হাতের তুলির টানে । সদাশিব বাবু খুশিতে ডগমগ হয়ে এক মুহুর্তও দেরী  না করে তার সাথে তার বাড়িতে গিয়ে তার বাবা মা এর সাথে কথা বলে ছেলের সাথে বিয়ে পাকা করে ফেললেন ।এতদিন ধরে এমনি এক কূলবধূই তো খুঁজছিলেন  তিনি যেতার ব্যবসার কাজে উন্নতির স্রোত বয়ে আনবে,শুধু তাই নয়, তার সাথে তার সাফল্যও চারিদিকে ছড়িয়ে পরবে।এতো অল্পে যে সন্তুষ্ট আর এমন যার ধীশক্তি আর ধৈর্য, সেই তো তাঁর যোগ্য কূলবধূ।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত