কাকের গল্প

কাকের গল্প

এ বছরে খুব গরম পড়েছে। ভোর না হতেই রোদের তাত বাড়তে থাকে, আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামলেও গরম কমে না। মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে একটু বাতাস দেয়। কিন্তু চারদিকে বড় বড় উঁচু উঁচু বাড়ি, আকাশ দেখা যায় না এমন উঁচু বাড়িও আছে। ঘরে ঘরে যে বেশ বাতাস খেলে বেড়াবে সে উপায় নেই। এবছর তেমন করে কালবৈশাখীর ঝড়ও হয়নি। ঝড় হলে ঘরদোর নোংরা হয় ঠিকই, তবে গরম তো কমে।এই গরমে পাখিদের কষ্ট সবচেয়ে বেশি। যত বড় বড় বাড়ি, রাস্তা তৈরি হচ্ছে, ততই ওদের থাকার জায়গা কমে যাচ্ছে। বড় বড় গাছের পাতার আড়ালে সারাদিন বসে থাকবে, সে উপায় নেই। গাছগুলোই কেটে ফেলা হচ্ছে যে। ভালো করে আকাশে উড়তেও পারে না আজকাল। কতরকম তার ঝুলছে চারদিকে। ইলেকট্রিকের তার, টেলিফোনের তার, কেবলটিভির তার। যত জলাজায়গাগুলো মাটি ফেলে বুজিয়ে দিয়ে বাড়ি তৈরি হচ্ছে। একটু জল খুঁজতেও যে কি কষ্ট!

অনেক পাখিরা তাই জঙ্গলে চলে গেছে। তাদের আর শহরে দেখা যায় না।

কিন্তু বেশ কিছু পাখি আছে, তারা শহরে থাকতেই ভালোবাসে। মানুষের সঙ্গে থাকতে ভালোবাসে। এই পাখিরা শহরে মানিয়ে নিয়েছে। গাছ নেই, তাই বাড়ির কার্নিশে বারান্দায় ছাদে বসে থাকে। কখনো বা কোনো তারে বসে দোল খায়। আর কোথাও একটু জলা জায়গা পেলে তো কথাই নেই। সকাল দুপুর বিকেল, সেখানে পাখির মেলা।

ভোর হবার আগে থেকেই তাদের ব্যস্ততা শুরু হয়। সূর্য ওঠারও আগে .. যেই অন্ধকার কম হয়ে আকাশটা আলো আলো হয় .. নীল আকাশ দেখা যায় .. অমনি পাখিরা বেরিয়ে পড়ে। কিচির মিচির কাকলি। আকাশ বাতাস জুড়ে পাখিদের গান শোনা যায়।

কোকিল, পাপিয়া, দোয়েল, টুনটুনি, বেনেবউ, টিয়া, চড়াই, শালিখ, পায়রা, বুলবুলি সব্বাই বেরিয়ে পড়ে। ভোর হতে না হতেই মোরগ গলার শিরা ফুলিয়ে ডেকে ওঠে, ‘কোঁকর কো’ ..

শিশিরভেজা ঘাসে, জলের ধারে ধারে ঘুঘুপাখিরা গলা ফুলিয়ে ডাকে, ’কেষ্টঠাকুর-র-র- ওঠ ওঠ’ ..

গম্ভীরগলায় কাক ডাকে, ‘ক্কঃ ক্কঃ’ ..

তখনও রাস্তায় গাড়ি চলা শুরু হয় না। ফাঁকা রাস্তায় পায়রাদের সঙ্গে সঙ্গে কাক খুঁটে খুঁটে খাবার জোগাড় করে। লম্বা একটা ল্যাজঝোলা পাখি ঘাসের মাটি থেকে ঠুকরে ঠুকরে কি সব খায়, আর সকাল থেকেই শালিখদের সঙ্গে গলা দুলিয়ে ঝগড়া করে। পাশের আমগাছটায় একজোড়া বুলবুলি পাখি থাকে, তারা এ সময় শিস দেয়। বোধহয় ঝগড়া থামানোর জন্যেই।

একটু আলো ফুটলেই পাখিরা পার্কের লেকের কাছে উড়ে আসে । মর্নিংওয়াকের মানুষজন এসে পড়ে । তার মধ্যেই পাখিদের ভিড়ও বাড়ে । একঝাঁক টিয়াপাখি এদিক সেদিক ওড়াউড়ি করে । দল বেঁধে পায়রা এসে পার্কের রাস্তায় বসে পড়ে ।

ক’দিন ধরে লেকের কাছে কয়েকটা বুনো হাঁস আসছে । এমনিতে হাঁসেরা আসে শীতকালে, এবছর ভুল করে এসময় এসে পড়েছে। ওরা সারাদিন জলে ডুবে থাকে । আগে আগে দুটো বক আসত । আজকাল দল বেঁধে বক আসছে । বুনোহাঁস আর বক, দুই পাখির বেশ ভাব হয়ে গেছে । একসঙ্গে জল থেকে মাছ আর পোকা ধরে খায় ।

মাছরাঙা পাখি সেই নিয়ে একদিন খুব রাগ করছিল। এমনিতেই গরমে খাবার খোঁজায় কত কষ্ট । তার মধ্যে রোজই জলের ধারে পাখির ভিড় বাড়ছে।

লেকের ধার ঘেঁষে একটা মস্ত শিমুলগাছ । তারপর পার্কের পাঁচিলের সঙ্গে সারি দিয়ে পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুলফুলের গাছ । তারপর পাশাপাশি দুটো ছাতিমগাছ । একটা আমগাছও আছে । এই সকালে গাছে গাছে পাখির হুল্লোড় ।

আমগাছের ডালে ডালে সবচেয়ে বেশি পাখি থাকে । সকালবেলা সবাই বাসা ছেড়ে বেরিয়ে এসে জলার ধারে বসে । বক আর হাঁসেদের সঙ্গে গল্পগুজব করে, তারপর হয়ত অন্য কোনো গাছে গিয়ে সেখানে অন্য কোনো পাখির বাসায় গিয়ে গল্প করে আসে । ছাতিমগাছের সবচেয়ে ওপরের ডালে বাবুইপাখির বাসা । মা-বাবুই বাসা থেকে মুখ বের করে গল্পগাছা করে ।

বাবুইপাখির বাসা এত সুন্দর যে একদিন বুনো হাঁসরাও এসে বাসা দেখে গেল । এমনিতে সব পাখিদের বাসাই বেশ সুন্দর, পরিষ্কার, পরিপাটি । শুধু কাকের বাসা ছাড়া ।

আমগাছের মধ্যে এক জায়গায় আলাদা করে বাসা করে থাকে একদল কাক । গাছের গুঁড়ির কাছে, ডালপালার মধ্যে কাঠকুটো দিয়ে হেলাফেলার বাসা । যেমন তেমন করে তৈরি বাসা, একটু ছিরিছাঁদ নেই । তার মধ্যেই যেমন তেমন করে ডিম রাখা, একটু জোরে হাওয়া দিলেই মাটিতে পড়ে যায় । তা নিয়ে কাকের মাথাব্যথা নেই । ওদের বাসায় এসে কোকিলপাখিও ডিম রেখে যায়, বোকা কাক বুঝতেই পারে না। নিজের ডিমের সঙ্গে সেগুলোকেও রেখে দেয় । সেই নিয়ে সব পাখিরা খুব হাসাহাসি করে ।

কাকের বাসায় কেউ বেড়াতে আসে না । কাকের সঙ্গে কেউ মেশে না । কাক দেখতে বিশ্রী, ডাকটাও বিশ্রী, কোনো গুণ নেই । কেনই বা মিশবে কেউ?

সাদা ধবধবে বক, সাদা সাদা হাঁস চারিদিক আলো আলো করে রাখে । সবুজ টিয়া, লাল ঝুঁটির মোরগ, লম্বা ল্যাজের বুলবুলি । শালিখপাখির হলুদ ঠোঁট গাঢ় বাদামী পাখনা । মৌটুসি ময়নার দলে এসে বসে, ছোট্ট চড়াইপাখি ফুরুত করে এসে বসে নীল কালো ডোরাকাটা বদরীপাখির পাশে বসে । আর অমনি একটা কি সুন্দর হাতে-আঁকা ছবি হয়ে যায় ।

একদল ময়ূর সুন্দর পেখম তুলে খেলে বেড়াচ্ছে, বড় ঝোলা ল্যাজের একটা সাদা পাখি এসে বসল ঠিক তাদের মধ্যিখানে । আর সময় বুঝে কোণাকুণি এসে বসল নীলকন্ঠ আর টিয়াপাখি । ব্যস, কেমন সুন্দর একটা আল্পনা হয়ে গেল ।

সবাই সুন্দর । রঙচঙে ঝলমলে। আর কাককে দ্যাখো কুশ্রী কালো । সকালবেলা সুন্দরী পায়রাদের দলে বসে দানা খুঁটে খায় যখন, সবাই মুখ ফিরিয়ে নেয় । কি কুচ্ছিত, কি কুচ্ছিত । সাদা ঝুঁটির কাকাতুয়া পায়রাদের ডেকে নেয়, ‘এদিকে চলে এসো । কাকের সঙ্গে থাকতে হবে না ।‘

আবার পরের দিন দ্যাখো আবার কাক সুন্দর পাখিদের দলে খেলতে আসে। লজ্জা শরমের বালাই নেই ।

একদিন তো খুব মজা হয়েছিল । খুব বৃষ্টি হয়েছিল সেদিন। নীল পেখমে সবুজ পাখনা দুলিয়ে নেচেছিল ময়ূর । গানও গেয়েছিল । দেখতে সুন্দর হলে কি হবে ! ময়ূরের গানের গলা একেবারেই নেই । কোকিল আর দোয়েল খুব হেসেছিল সেই নিয়ে । কাকের আওয়াজ শুনলেও যেমন সবাই হাসে ।

বোকা কাকটা করেছে কি, পরের দিন ময়ূরের পালক লাগিয়ে সেজেগুজে ময়ূরের সঙ্গে ভাব জমাতে গেছে । কাক বোধহয় ভেবেছিল, গলার আওয়াজ একরকম বলে ময়ূর ওকে বন্ধু করবে । ময়ূররা সঙ্গে সঙ্গে কাককে মেরেধরে তাড়িয়ে দিয়েছে । সেই নিয়ে সেদিন সব পাখিদের কি হাসাহাসি ।

তবু লজ্জা নেই। সারাদিন ‘কা কা’ করে গাছে গাছে মাঠে বনে ঘুরবে । আর চিল, শকুন, বাজ .. যত রাগী রাগী পাখির সঙ্গে খুঁজে খুঁজে মাংস খাবে । তবু যদি চিলের মত অমন ডানা সোজা করে আকাশে পাক দিতে পারত । একলা পাখি হয়ে চিল মাঝে মাঝেই আকাশে পাক খায়, কি সুন্দর লাগে তখন । কাক অত উঁচুতে উড়তেই পারে না । তাই চিল, বাজ, শকুন, ঈগলদের সঙ্গেও ওর বন্ধু হয় না ।

কোনো গুণ থাকলে তো বন্ধু করবে ! অন্ধকারের পাখিরা, বাদুড় কিংবা প্যাঁচা, তারাও ওর চেয়ে ভালো । কেমন অন্ধকারে দেখতে পায় ।

লেকের ধারে মর্নিংওয়াকে আসা মানুষজনও বলে, ‘এত সুন্দরের মধ্যে কাকগুলোকে মানাচ্ছে না ।‘

কেউ কেউ পাথর ছুঁড়ে কাককে তাড়িয়েও দেয় । তবু আবার পরের দিন কাক এসে হাজির হবেই ।

গরমের কষ্ট, জলের কষ্ট, খাবার জোগাড়ের কষ্ট নিয়ে এমনিই পাখিদের ভালো লাগছে না । তার মধ্যে এই কাক নিয়ে ঝামেলা । জলের কাছে এমনিই পাখিদের এত ভিড়, কাকগুলো এসে ভিড় বাড়িয়ে দিচ্ছে । জোর করে এসে জল খেয়ে নেবে, উড়ে উড়ে জল নোংরা করবে, পাখিদের মুখের খাবার ছিনিয়ে নেবে ।

দেখেশুনে বুনো হাঁসের দল একদিন সব পাখিদের নিয়ে একটা সভা করল । কাকেদের অত্যাচার আর সহ্য হয় না । চোখের সামনে এত নোংরা কুচ্ছিত পাখি, সারাদিন ডাস্টবিনে নোংরা ঘাঁটে আর তারপর লেকের জল নোংরা করে । কাককে আর আসতে দেওয়া হবে না ।

পাখিরা মিলে কাককে গাছ থেকে তাড়িয়ে দিল । বাসা ভেঙে দিল, ডিমগুলো মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল । কাঠঠোকরা পাখি লম্বা ঠোঁট দিয়ে কাকেদের খুঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে দিল । বাবা-কাক আর মা-কাক অনেকক্ষণ উড়ে উড়ে ভাঙা ডিমগুলোকে দেখল, তারপর কাঁদতে কাঁদতে জঙ্গলে চলে গেল ।

পাখিরা খুব খুশি । মানুষজনও খুশি । আর কালো বিশ্রী কাককে দেখতে হয় না । আর কর্কশ ডাকে মাথা ধরে না । সুন্দর সুন্দর পাখিরা উড়ে উড়ে আকাশটাকে ঝলমল করে রাখে । লেকের জলে এখন দুটো সুন্দরী রাজহাঁস ঘুরে বেড়ায় । কতরকম হলুদ, নীল, কমলা, সবুজ । কতরকম পালক । নীলকন্ঠ, বেনেবউ, ধনেশ, দুধরাজ, ছাতারে, বুলবুলি, শালিখ । পায়রার ঝাঁক ।

রোজ ভোরের সোনা মাখামাখি জলে, গাছের পাতায় । নীল সবুজ ঘাসের বন, লাল হলুদ ফুল । আর অনেক অনেক রঙ । ডানায় সোনালি লাইন মাথায় লালনীল মুনিয়া, সাদাটুপি লাল গির্দিপাখি, স্যাফরন গা লম্বা সাদাটে ল্যাজ গাঢ় নেভীব্লু দুধরাজ । ময়না, চন্দনা, দোয়েল, মৌটুসি .. নরম পাখির দল । আকাশের চিল, বাজ, শকুন, ঈগল .. শক্তিশালী পাখির দল । জোড়ায় জোড়ায় শালিখ । ঝাঁক বেঁধে পায়রা, বক, হাঁস । শুধু কাক নেই । কাক আর আসে না ।

এমনি করে দিন কাটতে লাগল । বুনো হাঁসরা অন্য দেশে উড়ে গেল । পেলিক্যান নামের আরো সুন্দর পাখি এসে লেকের জলে খেলা করে গেল । বর্ষা এল । শরত এলো । শীত এলো । কাক এলো না ।

বেশ চলছিল, কিন্তু কিছুদিন ধরে নানা মুশকিল দেখা দিয়েছে । গাছে গাছে পাখিদের বাসায় পোকামাকড় বেড়ে গেছে । বিষাক্ত সব পোকা ঘাসের মধ্যে, ক্ষেতের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে । আঁশটে গন্ধে আকাশ বাতাস ভরে যাচ্ছে ।

সুন্দর সুন্দর পাখিদের লাল নীল সবুজ পালক ভর্তি পোকা, সারাদিন ঠোঁট দিয়ে চুলকে চুলকে গায়ে ব্যথা । কোকিল খুব বিপদে পড়েছে । ওর ডিম রাখার জায়গা নেই । সব ডিম খেয়ে নিচ্ছে দুষ্টু বেড়ালরা । দিনে দিনে কোকিলের সংখ্যা কমে যাচ্ছে ।

প্রজাপতিদের অন্য বিপদ । সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে । শুঁয়োপোকা থেকে এতবেশি প্রজাপতি হচ্ছে যে আর থাকবার জায়গা নেই ।

মাথা দুলিয়ে প্যাঁচা ঠাকুর্দা বলল, ‘কাককে তাড়িয়েই সর্বনাশ হল ।‘ ওপরের আকাশ থেকে নেমে এসে শকুন আর বাজপাখিও বকাবকি করল । পাখিদের ডাক্তার, লম্বাগলার সারসপাখি বলল, ‘এখুনি কাকেদের ফিরিয়ে আনতে হবে । নইলে খুব বিপদ ।‘

পাখিরা খবর পেয়েছে, মানুষজনও নাকি হন্যে হয়ে কাককে খুঁজে বেড়াচ্ছে ।

দুধরাজ পাখি, খুব শান্তশিষ্ট, কাককে তাড়াবার দিনও সঙ্গে আসে নি । এখন পাখিদের সভায় এসে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল, কাক ছিল বলে কি কি সুবিধে হত সেই সব কথা ।

কি কি সুবিধে হত শুনে তো সবাই অবাক ।

এক একটা কাকের পরিবার মিলে নাকি চল্লিশহাজার শূককীট, শুঁয়োপোকা খেয়ে নেয় । কত যে পোকামাকড় খেয়ে নেয়, তার হিসেব নেই । সেই পোকামাকড়দের বেশিরভাগই ক্ষেতের ফসলের, গাছের ফলের ক্ষতি করে। তাই কৃষকরা আর বাগানের মালীরা কাককে খুব ভালোবাসে ।

সেইসাঙ্গে কাক খায় ইঁদুর। জ্যান্ত ইঁদুর, মরা ইঁদুর। কাক চলে গিয়ে ইঁদুরে ইঁদুরে দেশ ভরে যাচ্ছে । পোকামাকড়ে, বিষাক্ত কীটপতঙ্গে দেশ ভরে যাচ্ছে । জন্তুজানোয়ারদের আর পাখিদের তো বটেই, মানুষের ঘরে ঘরেও অসুখ বেড়ে গেছে । আবর্জনা বেড়ে গেছে । কাক নাকি একা একাই খুঁটে খুঁটে খেয়ে অনেক আবর্জনা পরিষ্কার করে পরিবেশ সুন্দর রাখে ।

আবার পাখিদের সভা বসল। বুদ্ধিমান পাখিরা কাকের গুণ ব্যাখ্যা করল । বিদেশ থেকেও জ্ঞানী পাখিদের ডেকে আনা হল। গম্ভীর ম্যাকাওপাখি এসেছে আফ্রিকা থেকে । সেই ম্যাকাও সুন্দর বক্তৃতা করে বুঝিয়ে বলল, কিভাবে কাক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে ।

‘পরিবেশ’, ‘ভারসাম্য’ .. এসব ভারি ভারি কথা পাখিরা তেমন বুঝল না অবশ্য । কিন্তু ম্যাকাওকে দেখে পাখিদের রঙ নিয়ে, রূপ নিয়ে আর অহঙ্কার করার কথা মনেও রইল না । যেমন বড়, তেমনি রঙ । সবুজ, নীল, লাল, হলুদ । এমন সুন্দর পাখি, সেও কিনা কাকের প্রশংসা করছে !

পাখিদের খুব লজ্জা করতে লাগল । সবাই বেশ বুঝতে পারছে, কাককে তাড়ানোটা ভালো কাজ হয় নি ।

ছোট্ট মৌটুসিপাখি ভ্যাঁ করে কেঁদেই ফেলল, ‘শিগগির কাকদাদাকে নিয়ে এসো । আর কিই বা এমন খারাপ দেখতে? কি সুন্দর কালো কুচকুচে ।‘

চন্দনা বুলবুলি বাবুই সবাই বলল, ‘গলার আওয়াজটাও খুব একটা খারাপ নয় ।‘

পাহাড় থেকে আসা নীল ময়না বলল, পাহাড়ে নাকি হলদে ঠোঁট লাল পায়ের সুন্দর কাকও আছে । সেই শুনে টিয়াপাখি বলল, ‘আমাদের কালো কাকই সুন্দর । রোজ ডাস্টবিনে বসে, তবু ওর গায়ে নোংরা লেগে থাকে না ।‘

সবাই সমস্বরে বলল, ‘আমাদের কালো কাকই ভালো । কালো জগতের আলো ।‘

ডাহুকপাখি লম্বা লম্বা পা ফেলে তখনই বেরিয়ে পড়ল । একঝাঁক পায়রা গেল দক্ষিণে, একঝাঁক টিয়াপাখি গেল পশ্চিমে । বকের দল সাদা পাখনা মেলে উত্তরের দিকে উড়ে গেল, মাছরাঙা পাখিরা গেল পূর্বদিকে । চিল আর বাজ অনেক উঁচু আকাশে গিয়ে চারদিকে খুঁজতে লাগল ।

শালিখ আর বাবুই মিলে আমগাছের দালে কাকের বাসা তৈরি করতে লাগল ।

জঙ্গলে জন্তুজানোয়ারদের সভা ডেকে সিংহরাজা আদেশ দিল, ‘সবাই মিলে কাককে খুঁজে বার করো ।‘ জঙ্গল জুড়েও ছুটোছুটি হুটোপাটি শুরু হল । যেমন করে হোক, কাককে ফিরিয়ে আনতেই হবে ।

মানুষরাও পিছিয়ে নেই। দিকে দিকে ‘কাক বাঁচাও কমিটি’, ‘কাক জাতীয় উদ্যান’, ‘কাক সোসাইটি’ তৈরি হল । পাঁচিলে, দেয়ালে, হোর্ডিঙে কাকের সুন্দর সুন্দর ছবি টাঙানো হল ।

এতজন মিলে এত ভালোবাসায় ডাকলে কি আর কাক না এসে পারে ?

বাড়ির বারান্দায়, স্টেশনের টালির ছাদে,স্কুলবাড়ির মাঠে কালো কালো কাকের দল আসতে লাগল আবার । পাখির দল এসে কাকের সঙ্গে খেলা করতে লাগল । কাকের আমগাছের বাসায় পাখিরা এসে গল্প করতে লাগল ।

আজকাল পাখিরা কাককে নিয়ে একসঙ্গে উড়ে যায় নীল জলের কাছে । রাজহাঁস লম্বা গলা দুলিয়ে হাসে ।

আকাশ বাতাস মেঘ বৃষ্টি গাছপালা সবাই জানে এখন, কালো কাক আসলে কত সুন্দর । পাহাড় টিলা জঙ্গল .. গাছে গাছে ফুল পাতা .. নদী নালা পুকুর । পাখির শিস । কাকের গম্ভীর ডাক ।সব মিলিয়েই জীবন । প্রকৃতির রূপকথায় কাউকে বাদ দেওয়া নেই ।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত