রাজকন্যা সোনালি ও রানি রুপালি

রাজকন্যা সোনালি ও রানি রুপালি

অনেক অনেক দিন আগের কথা। আর অনেক দূরের এক দেশের গল্প। সে দেশের পেছনে উঁচু পাহাড়। সামনে বিশাল নদী। পাহাড়ে বড় বড় গাছ, ফুল, ফল আর ঝরনার বাহার। নদীতে বড় বড় ঢেউ। সেই ঢেউয়ের মাথায় মাথায় খেলে বেড়ায় অনেক রকমের মাছ। দেশের রাজাও যেমন ভালো, তেমনি ভালো সে দেশের প্রজারা। সবাই মিলেমিশে দারুণ সুখে বাস করত। সবাই সবাইকে ভালোবাসত।
রাজা ছিলেন খুবই ধনবান। তাঁর সিন্দুক ভরা ছিল সোনা-রুপা। হাতিশালে হাতি। ঘোড়াশালে ঘোড়া। আরও ছিল উজির, নাজির, কোতোয়াল, আমির, মন্ত্রী, সিপাহি, সান্ত্রি। তবে রাজার সবচেয়ে প্রিয় ছিল তাঁর একমাত্র মেয়ে সোনালি। অসাধারণ সুন্দরী রাজকুমারী সোনালির যেমন ছিল রূপ, তেমনই ছিল গুণ। সে গাইতে পারত, নাচতে পারত। মাটি দিয়ে মূর্তি গড়ত। সোনালি ভালোবাসত ফুল, পাখি, ঝরনা ও নদী। খুবই নরম ছিল তার মন। কাউকে দুঃখ দিতে চাইত না। সবাইকে ভালোবাসত সে। সোনালি ছিল সত্যিকারের শিল্পী। আর যাদের শিল্পীমন, তারা তো সবাইকে ভালোবাসবেই। কারণ ভালো না বাসলে তো কখনো গান গাওয়া যায় না। ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া যায় না।
এই সুন্দর সুখের দেশেও একদিন এল দুঃখের দিন। হঠাত্ এক অজানা রোগে মরে গেলেন রানি। সোনালি ও রাজা খুব দুঃখ পেলেন। দুঃখ পেল প্রজারাও। তবুও দিন গড়িয়ে যেতে লাগল। বড় হয়ে উঠল রাজকুমারী সোনালি। এদিকে রানি না থাকায় রাজপ্রাসাদ প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। নানা সমস্যা প্রাসাদে। কেউ কারও কথা শুনতে চায় না। যে যার ইচ্ছেমতো যা খুশি করে। আর এতে করে দিন দিন ঝামেলা বেড়েই যেতে লাগল।
তখন রাজার মন্ত্রী, আমির, উজির ও নাজির—সবাই মিলে ঠিক করল, রাজবাড়ির সব কাজ সুন্দরভাবে চালানোর জন্য একজন রানি চাই। আর রানির জন্য রাজাকে বিয়ে করতে হবে। তখন সবাই মিলে রাজার জন্য কনে খুঁজতে লাগল। শেষে রাজ্যের এক বড় ধনী সওদাগরের মেয়েকে রাজার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হবে বলে ঠিক হলো। সেই সওদাগর-কন্যার নাম হলো রুপালি। খুব সুন্দরী তিনি। মহা ধুমধামে রাজার সঙ্গে বিয়ে হলো রুপালির। সবাই ভাবল, যাক, এবার বুঝি সুখের দিন ফিরে এল। রানি এবার হাল ধরবেন সংসারের।
রানি রুপালিও দেখতে সুন্দর; কিন্তু রাজকন্যার মতো নয়। আর স্বভাবে ভীষণ খারাপ। খুব হিংসুটে। কারও ভালো দেখতে পারতেন না। কাউকে ভালোবাসতেন না শুধু নিজেকে ছাড়া। সব সময় সাজপোশাক, গয়না এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। তাঁর সময়ই হতো না অন্য কোনো দিকে মন দেওয়ার। দেখে-শুনে দুঃখ পেলেও সবাই মানিয়ে নিচ্ছিলেন রানির সঙ্গে। রানি রুপালি রাজকন্যা সোনালিকে একটুও দেখতে পারতেন না। সব সময় হিংসা করতেন। যদিও সেটা মুখে প্রকাশ করতেন না। তবে নানা কারসাজি করে সোনালিকে বিপদে ফেলতে চাইতেন।
একদিন রানি সোনালিকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন নদীর তীরে বেড়াতে। হঠাত্ দেখেন, ঢেউয়ের মাথায় একটা বড় মাছ তার বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে আপন মনে খেলতে খেলতে গল্প করছে। বাচ্চা মাছ মাকে বলছে, ‘দেখ দেখ, রাজকুমারী সোনালি কী সুন্দর! ওর মতো সুন্দর এই রাজ্যে আর কেউ নেই। রানি নিজেকে সুন্দরী ভেবে যতই অহংকার করুন না কেন, রাজকন্যা তাঁর থেকে অনেক সুন্দর, তাই না মা।’
‘হ্যাঁ, সত্যি তা-ই।’ ‘কিন্তু কেন রাজকন্যা রানির থেকে বেশি সুন্দর, বলো তো দেখি?’ বলল মা-মাছ। তিড়িং করে লাফ দিয়ে বাচ্চা মাছ বলল, ‘কেন মা? রাজকুমারীকে কেন বেশি সুন্দরী মনে হয়? তুমি বলে দাও। আমি বুঝি না।’
‘আমার বোকা ছানা তুই। নইলে ঠিক বুঝতে পারতি। রানি হলেন অহংকারী আর হিংসুটে। তাই তাঁর চেহারাও তেমনি। সোনালির মনে কোনো হিংসা নেই, অহংকার নেই, খুবই নরম মন তার। মনে অনেক দয়া আর ভালোবাসা সবার জন্য। দেখতেও তাই অনেক সুন্দর।’
মাছেদের সব কথা রানি শুনতে পেলেন। হিংসায়, রাগে রানি রুপালি পাগলের মতো হয়ে উঠলেন। মনে মনে ঠিক করলেন, মেরে ফেলবেন সোনালিকে। রাগে অস্থির রানি ছুরি দিয়ে আঘাত করলেন রাজকন্যাকে। তারপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন নদীতে। সোনালিকে ফেলে দিয়ে রানি কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে গেলেন প্রাসাদে। গিয়ে বললেন, ‘হায় হায়, কী সর্বনাশ হয়েছে! রাজকন্যা পা পিছলে পড়ে গেছে নদীতে। ঢেউয়ে ভেসে হারিয়ে গেছে।’ এ কথা শুনে হায় হায় করতে করতে সবাই ছুটল নদীর তীরে। শত শত নৌকা নিয়ে চলল খোঁজা। হাজার হাজার জাল ফেলে খোঁজা হলো। কিন্তু পাওয়া গেল না দারুণ ভালো রাজকন্যা সোনালিকে। রানিও খুব খুশি যে সোনালি মরে গেছে। তার মানে রাজ্যে এখন সে-ই সব থেকে সুন্দরী।
এদিকে হয়েছে কি, রানি যখন সোনালিকে ছুরির ঘা দিয়ে নদীতে ফেলে দিয়েছেন, সেটা দেখে ফেলেছিল মা-মাছ। তখন মা আর ছানা-মাছ মিলে সোনালিকে তুলে নেয় পিঠে। তারপর দ্রুত সাঁতার কেটে চলে যায় দূরে, বহু দূরে। একেবারে পাশের দেশে। এনে তুলে রাখে বনের ধারে ডাঙায়। সেই বনে তখন শিকারে এসেছিল রাজপুত্র হিরণ্ময়। শিকার করতে করতে ক্লান্ত রাজপুত্র তার সঙ্গীদের নিয়ে বিশ্রামে বসেছিল নদীর ধারে। রাজপুত্র বসেছিল গাছের তলায়। সঙ্গের রাঁধুনী কাঠকুটো জ্বেলে রান্না করছিল একটু আগে শিকার করা হরিণ। আগুনে ঝলসে খরগোশের কাবাব তৈরি হচ্ছিল। রান্না হচ্ছিল বনমোরগের মাংস। তাদের ঘোড়াগুলো ঘাস খেয়ে একটু আরাম করে নিচ্ছিল।
এমন সময় রাজপুত্রের নজরে এল, নদীর তীরে বালুর ওপর সূর্যের আলোয় কী যেন ঝিকমিক করছে। কাছে গিয়ে রাজপুত্র তো অবাক। আরে, একি! এ যে অপরূপা একটি মেয়ে! রাজপুত্র হিরণ্ময়ের ডাক শুনে ছুটে এল সবাই। সোনালিকে তুলে আনা হলো হিরণ্ময়ের তাঁবুতে। অনেক সেবার পর ধীরে ধীরে চোখ মেলে সোনালি। এরপর খুলে বলল তার দুঃখের কথা। সব শুনে রাজপুত্র সিদ্ধান্ত নিল যে সোনালিকে সে তার নিজের দেশে নিয়ে যাবে। বিয়ে করে রানি করবে। এত সুন্দর একটা মেয়ে, এত দুঃখ তার! এদিকে রাজপুত্র হিরণ্ময়ের দয়ালু ব্যবহারে খুব খুশি হয়ে সোনালিও রাজি হয়ে গেল তাকে বিয়ে করতে।
মহা ধুমধামে বিয়ে হলো হিরণ্ময় ও সোনালির। সাত দিন ধরে ভোজ খেলেন রাজ্যের মন্ত্রী-সান্ত্রি, আমির-ওমরা। বাদ গেল না প্রজারাও। সাত দিন ধরে তাদের পাতেও পড়ল মিঠাই-মণ্ডা, লুচি-পুরি, ফল-শরবত, পোলাও-কোরমা। সাত রাত ধরে আতশবাজি পুড়ল। আলোকসজ্জা হলো রাজ্যজুড়ে। সাত দিন সাত রাত ধরে সানাই বাজল, সেতার বাজল, গান হলো, নাচ হলো। প্রজা, আমির, উজির, মন্ত্রীরা খুশি। সোনালি-হিরণ্ময়ও খুশি।
দিনের পর দিন গড়িয়ে বছর পুরে গেল। একদিন সোনালির সত্মা গেছেন নদীর ধারে। হঠাত্ দেখা সেই মা-মাছ আর তার ছানার সঙ্গে। রুপালি জানতে চাইলেন, ‘বলো তো, পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দরী কে?’ মা-মাছ চুপ করে রইল। ছানা-মাছ মাথা উঁচু করে বলল, ‘কে আবার, সোনালি।’ ‘সোনালি? সে তো কবেই মরে গেছে।’ চিত্কার করে উঠলেন রানি রুপালি। ‘কে বলেছে সোনালি মরে গেছে? সে মরেনি। সোনালি এখন পাশের দেশের রানি। রাজা হিরণ্ময়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে।’
এ কথা শুনে রানি জ্বলে উঠলেন হিংসার আগুনে। মনে মনে ফন্দি করলেন, কী করে মেরে ফেলা যায়। রুপালি রাজাকে জানালেন যে সোনালি বেঁচে আছে। তার বিয়ে হয়েছে পাশের দেশের রাজার সঙ্গে। তিনি নিজে গিয়ে সোনালিকে দেখে আসতে চান। রাজা তো মহাখুশি যে তাঁর একমাত্র মেয়ে বেঁচে আছে। তিনি অনুমতি দিলেন যাওয়ার।
রানি রুপালি দাস-দাসী, লোকলস্কর, হাতি-ঘোড়াসহ চললেন পাশের দেশে। একদিকে রানি রুপালি আসছেন শুনে সোনালি তো ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল ভয়ে। রাজাও চিন্তায় পড়লেন, কী করা যায়? মন্ত্রীরা পরামর্শ দিলেন যে রানিকে এ রাজ্যে ঢুকতে দেওয়ার দরকার নেই। কোতোয়াল বলল, আমরা রানি রুপালিকে বন্দী করে রাখতে পারি। উজির-নাজিররা বলল, রাজ্যে আসুক রানি রুপালি। তাঁকে থাকতে দেওয়া হোক অতিথিশালায় কিন্তু রাজপ্রাসাদে তাঁর ঢোকা নিষেধ। রাজা এর কোনো প্রস্তাবেই মত দিতে পারলেন না, কারণ তাতে অতিথির অমর্যাদা করা হয়। রানি তো রাজা হিরণ্ময়ের রাজ্যে অতিথি।
ঠিক হলো, রানি রুপালি এলে তাঁকে রাজপ্রাসাদের অতিথিশালায় থাকতে দেওয়া হবে। কিন্তু রানি সোনালির সঙ্গে তাঁর দেখা হবে না। তাঁকে বলা হবে সোনালির অসুখ। তাঁর সঙ্গে কারও দেখা হওয়া নিষেধ।
যথাসময়ে রানি রুপালি তাঁর লোকলস্কর, দাস-দাসীসহ এসে উপস্থিত হলেন রাজপ্রাসাদে। ফুল ছড়িয়ে, আতর ঢেলে, নেচে-গেয়ে তাঁদের স্বাগত জানায় রাজা হিরণ্ময়ের লোকেরা। তারপর অতিথিদের জন্য সাজিয়ে রাখা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। ফল-শরবত দেওয়া হয়। হিরণ্ময় রাজ্যের মহামন্ত্রী রানিকে বলেন, ‘আপনারা বিশ্রাম নিন, তারপর ভোজসভায় নিয়ে যাওয়া হবে আপনাদের।’ রানি বললেন, ‘খাওয়া পরে হবে। আগে সোনালির সঙ্গে দেখা হোক।’ মহামন্ত্রী হাসলেন। বললেন, ‘আমাদের রানি মায়ের সঙ্গে আপনার দেখা হবে ভোজসভায়। এটাই আমাদের দেশের নিয়ম।’ কী আর করা। হিংসুটে রানি রুপালিকে তা-ই মেনে নিতে হলো।
যথাসময়ে সবাই হাজির ভোজসভায়। বিশাল হল। সেখানে উপস্থিত রাজা, মন্ত্রী, আমির-ওমরা, তাঁদের স্ত্রীরা। সবারই সুন্দর সাজপোশাক। হল আলো ঝলমল করছে। খাবারের সুগন্ধে সবার মন ভরে উঠল। সবাই খাবার টেবিলে গিয়ে বসল। কত রকমারি খাবার। ময়ূরের রোস্ট, দুম্বার ঝোল, উটপাখির ডিম, গরুর মাংসের ভুনা, আস্ত ছাগল, হরিণের আস্ত রোস্ট, ফল, দুধ, পিঠা, পায়েস, কেক, পুডিং আর নানা রকম মাছ। খাবার দেখেই মন ভরে যায়। অতিথিরা সবাই বসার পর শিঙা বেজে ওঠল। খাবার ঘরে এলেন রাজা হিরণ্ময় ও রানি সোনালি। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তাদের সম্মান জানাল। সোনালির সুন্দর পোশাক আর ঝলমলে গয়না দেখে হিংসায় রানি রুপালির বুক ফেটে যেতে লাগল। সোনালি তার সত্মা রুপালির সঙ্গে কুশল বিনিময় করল। বাবার কথা জানতে চাইল। বাবার কথা বলতে বলতে তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
সবাই খাবারের দিকে যে-ই না হাত বাড়িয়েছে, অমনি রানি রুপালি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘দাঁড়ান দাঁড়ান দাঁড়ান। একটু দেরি করুন। আমাদের দেশের একটি নিয়ম আছে। এ রকম ভোজসভায় আমাদের নিয়ম হলো, মেয়ের জামাইকে প্রথমে শরবত পান করানো। সেই শরবত আমি আমার দেশ থেকে তৈরি করে নিয়ে এসেছি।’ এই না বলে রানি রুপালি একটি সুন্দর বোতল থেকে দুই গ্লাস শরবত ঢেলে দুজনের দিকে এগিয়ে দিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলেন হিরণ্ময় রাজ্যের মহামন্ত্রী। তিনি দুই গ্লাস শরবতকে তিন ভাগে ভাগ করলেন। একটি গ্লাস রানি রুপালির হাতে দিয়ে বললেন, ‘আমাদের দেশের নিয়ম হলো, এই শরবত প্রথমে পান করবেন মেয়ের মা-বাবা। যেহেতু মেয়ের বাবা এখানে নেই। সেহেতু আমাদের রানি সোনালির মা প্রথমে এই শরবত পান করবেন।’ এই বলে মহামন্ত্রী জোর করে রানির মুখে শরবত ঢেলে দিলেন। শরবত জিহ্বায় লাগার সঙ্গে সঙ্গে রানি রুপালি ‘ওরে বাবা মরে গেলাম, মরে গেলাম’ বলে চিত্কার করতে করতে চেয়ার থেকে নিচে পড়ে কার্পেটে গড়াগড়ি দিতে দিতে মরে গেলেন। এই ঘটনা দেখে সবাই তো অবাক এবং দুঃখিত। সোনালিকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে বিষ মেশানো শরবত নিজের দেশ থেকে নিয়ে এসেছিলেন রানি। মহামন্ত্রীর অসাধারণ বুদ্ধির কারণে তাতেই তাঁর মৃত্যু হলো এবং বেঁচে গেল রানি সোনালি।
অতঃপর রাজা হিরণ্ময় ও রানি সোনালি সুখে বাস করতে লাগল। সুখে ছিল তাদের প্রজারা, তাদের দেশের পাখিরা এবং বনের ফুলেরা।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত