টেলিফোনের এপার ওপার

টেলিফোনের এপার ওপার

হিমাদ্রি: এই মধ্য রাতে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, আসলে হঠাৎ করেই শেয়াল ডাকার শব্দে ভয় পেয়ে উঠে গিয়েছি।

রুদ্র: ভাগ্যিস শেয়ালটা ডেকে উঠলো… শেয়াল মামার তরে গ্লাডিওলাস ফুলের পুজো রইল আমার (ঘুম ঘুম কন্ঠে)
হিমাদ্রি: আপনার মত বন্ধু থাকলে জাত শত্রুর দরকার পড়েনা (বলেই খানিক্ষন হেসে নেয়) । আচ্ছা রুদ্র বাবু আপনাদের ওখানে কি শেয়াল ডাকে না?

রুদ্র: হাইড্রোলিক হর্নে বুদ হয়ে থাকা এই ঢাকায় শেয়ালের শব্দ কান অবধি আসেনা আর শেয়াল থাকলে তো ডাকবে।
হিমাদ্রি: হ্যা, বাবা সেই ভাল। আপনাদের মধ্য রাতে ভয়ে ঘুম ভেঙ্গে যাবার চান্স নেই। কাওকে বিরক্ত করার মত অপরাধবোধ ও কাজ করেনা।

রুদ্র: তোমরা মেয়েরা না সব কিছুইতেই একটু শুচিবায়ু, ইশ্বরের মনের কথাও বলে দিত পার তবে সেটা বলেই খালাস। ঠিক বললে কিনা তার কোন হিসেব মেলাও না। যাই বল না কেন, এই মধ্য রাতে কোন যুবতীর ভয়ার্ত ভরাট কন্ঠ শোনার জন্য এই টেলিফোনগুলো আগেই আবিষ্কার হবার দরকার ছিল, আগের প্রজন্ম বড়ই দুর্ভাগা ছিল! আফসোস।

হিমাদ্রি: হা হা হা… ভালই বলেছেন। তো আপনার দিন কাল কেমন যাচ্ছে?

রুদ্র: অবিবাহিত ব্যাচেলরদের ভরা পূর্নিমায় যেমন কাটে তেমন ই আরকি।

হিমাদ্রি: আচ্ছা আপনার এই মুহুর্তে কি করতে ইচ্ছে করছে?

রুদ্র: আমার খুব করে ইচ্ছে করছে, কোন একজনকে নিয়ে শালবনে চলে যায়, তার হাতের কাচের চুড়ি, পায়ের নুপুরের শব্দে বনের ঘুমিয়া থাকা ঝি ঝি পোকা গুলো জেগে উঠবে। যখন খুব শীত লাগবে তখন একটা চাদর দুজনে একসাথে গায়ে জড়িয়ে নেব যখন সে হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে যাবে তখন তাকে আড়কোলে করে শুকনো পাতার উপর মড় মড় আওয়াজ করে একটা সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত জায়গা খুঁজে নিব, সঙ্গে অবশ্যই চায়ের ফ্লাক্স থাকবে সাথে মাটির ছোট চা খাবার পাত্র তারপর সেখানে ক্যাম্পফায়ার করব। দুজনের মাঝে ক্যাম্পাফায়ারের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলবে সেই সাথে চায়ের পাত্রে উউউউসসসস আওয়াজ তুলে চা খাব দুজন, একটা সময়ে তার খুব কাছে চলে যাব, তারপর তাকে বলব প্রিয়তমা চুল খুলে দাও… যাতে মৃদু বাতাসে তার চুলগুলো উড়ে যায়। আস্তে আস্তে আমার কোলের উপর তার মাথাটা রেখে দেব, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কবিতা শোনাবো তাকে, আর ভোর বেলায় সে পাখির কিচিরমিচির শব্দে জেগে উঠে দেখবে কেউ একজন তার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, তখন তার চোখে মুখে রাজ্যর বিস্ময় দেখে আরো কাছে টেনে নিব তাকে।
হিমাদ্রি: বাহ! কত সুন্দর নির্মল আকাঙ্ক্ষা আপনার। আচ্ছা ঐ যানজটের ঢাকা আপনার ভাল লাগে বুঝি? (খানিকটা অভিমানের স্বরে)
রুদ্র: না, মোটেও ভাল লাগেনা। পেটের দায়ে থাকা বলতে পারো, চারপাশে কত মানুষজন অথচ কেউ কাওকে রাস্তায় ডেকে জিজ্ঞেসা করেনা, বাবা তোমার শরীর কেমন। এই তুমি আসো না..বেড়িয়ে যাবে শিশু পার্ক,রমনাপার্ক, চিড়িয়াখানাও দেখা যাবে।
হিমাদ্রি: না বাবা, আপনাদের ঐ সাইরেনের শহরে ঝি ঝি পোকা নেই, কোকিল ডাকেনা, তেতুল গাছ নেই কিছুই নেই। আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো।

রুদ্র: আচ্ছা তোমার এই মুহুর্তে কি করতে ইচ্ছে করছে বা তোমার সাথে কি হলে তোমার ভাল লাগত?
হিমাদ্রি: আমি চাই এই হাড়কাপানো শীতে ভারী বর্ষা হোক, টিনের চালে ঝুম ঝুম করে বৃষ্টির পানি আছড়ে পড়ুক, সাথে দমকা হাওয়াতে টিনের সাথে ঘরের পাশের জাম গাছটা টিনের সাথে বাড়ি খাক আর এই ভয়ে কোন একজনকে নিয়ে কাথা মুড়ি দিব…দুজনের নিশ্বাস যখন দ্রুত ওঠা নামা করত তখন তার ঘামের গন্ধ মাখা শার্টে নিজেকে হারিয়ে খুঁজব, ঝড়ের রাতটা ভালবাসার ঝড়ের সাথে একদম মিশে যাক।
রুদ্র: আর কেউ যদি হাতটা ধরে বলে..হিমাদ্রি চল বৈশাখের মেলায় যায়, লাল কাচের চুড়ি কিনব, আলতা কিনব.. আসমানি রঙের শাড়ি কিনব তারপর যত্ন করে আমি তোমায় শাড়ি পরিয়ে দেব, শাড়ির কুচি দিয়ে দিব… নিজ হাতে তোমাকে সাজিয়ে নিয়ে ফটোগ্রাফারকে বলব হাজার খানেক স্থিরচিত্র তুলে রাখুন… আর তাকে বলব ছবিগুলোর উলটো পাশে লিখে দিবেন – জৈনক ব্যক্তির মেঘ পরী… তখন কি তুমি তার সঙ্গে যাবে?

হিমাদ্রি: আলতা, শাড়ি চুরির লোভ আমার আজন্মের তবে সেগুলো পরে কোন ফটোগ্রাফারের কাছে নয় ; আমি যেতে চাইব… নীল পদ্মের দীঘিতে। তাকে দিঘীর ঘাটলায় বসিয়ে রবীন্দ্র শোনাবো… ছোটখাটো ছিপ নায়ে দুজন ভাসব রাত্রি দ্বি-প্রহর পর্যন্ত…ইশ্বরের কাছে মনে প্রানে চাইব কেউ যেন একখানা নীল পদ্ম এনে আমার চুলে গুজে দেয়।

রুদ্র:আর কেউ যদি শেষ রাত্রিতে বলে… চল ধুলো মাখা রাস্তা দিয়ে হেটে এই ভরা পূর্নিমা গায়ে মাখি… তারপর ভোরবেলা সেই ধুলো শিশির মাড়িয়ে ধুয়ে ফেলি তবে তুমি কি তার সঙ্গ দিবে?

হিমাদ্রি: দেয়া যেতেই পারে; তবে আমি চাইব শেষ রাত্রিতে যখন আমি চুলোয় ফেনা ভাত চড়িয়ে দেব তখন কেউ একজন আমার পাশে বসে আগুন পোহাক…আমায় রুপকথার গল্প শোনাক..রক্ত খেকো ডাইনিবুড়ির গল্প শুনিয়ে ভয়ে আমার রক্তে হিম জমিয়ে দিক…
রুদ্র: কন্য সুন্দর দুপুরে কেউ যদি তোমার আঙুল ছুয়ে বলে চল শরষে খেতে যেয়ে গড়াগড়ি খেয়ে দুপুরটাকে বিকেল করি…তুমি কি তখন না বলবে?

হিমাদ্রি: কেউ যদি মধ্য দুপুরে কচুড়ি ফুলের ঐ সাদা-নীল ফুল এনে আমায় সাজিয়ে দিয়ে বলে চল শরষে খেতে যেয়ে দুপুরের মেঘেগুলোকে ডেকে আনি তবে দুবার না ভেবে তার হাতটা শক্ত করে ধরে বলব…
‘হেলায় ফেলোনা প্রিয় এবেলা.. বৈরাগ্যর তাল কেটে দিয়ে শখগুলোকে মাটি চাপা নাই বা দিলে এবেলা… চল প্রিয়.. মৌমাছি হয়..গোবরে পোকা হয়ে সারা বিল চষে বেড়ায় এবেলা”

রুদ্র:আচ্ছা হিমাদ্রি…কখনো শুনতে ইচ্ছে করেনা…”ভালবাসি”
হিমাদ্রি: কখনোই না ; এই শব্দটা মাঝে মাঝে সস্ত মনে হয় কেন জানি।

রুদ্র: (ছোট একটা ধাক্কা খেয়ে, নিজেকে গুটিয়ে নিল) ও…আচ্ছা।
হিমাদ্রি: কি আচ্ছা?? ( দীর্ঘ ফোনালাপের এই পর্যায়টা গম্ভীর হয়ে গেল।

রুদ্র: ঐ যে বললে… ভালবাসা তোমার কাছে সস্ত মনে হয়।
হিমাদ্রি: হ্যা তা ঠিক, তবে কেউ একজন আমাকে এই শব্দটা না শুনিয়ে অন্য কিছু শোনাক যাতে আমি শান্তি পাই..এমনটা চেয়ে এসেছি।

রুদ্র: কাল বৈশাখীতে তোমার হাতটা শক্ত করে ধরে যদি বলি ভয় পেওনা আমি আছি তো…তখন কি বলবে তুমি??প্রগাঢ় ঘন আমাবস্যাতে যদি বলি ঘাবড়ে যেওনা আমি প্রদীপ জ্বালাচ্ছি এখুনি…তখন কি বলবে তুমি? চারিদিকে যখন দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে তখন যদি আমার ভাগের এক টুকরো রুটি তোমার মুখের সামনে দিয়ে বলি খেয়ে নাও প্রিয় তখন কি বলবে তুমি?? তোমার বন্ধ্যাত্বর কারনে টোকাই ছেলে ধরে এনে যদি বলি..এই নাও আমাদের ছেলে আর শিগগিরি চোখের পানি মুছে ফেল তখন কি বলবে তুমি?? মাছ কাটতে গিয়ে তুমি যখন হাত কেটে বসে থাকবে তখন যদি বলি…বাবা মাছ টাছ অনেক খেয়েছি এই কয়দিন নিরামিষ খেয়ে দেখি চল তখন কি বলবে তুমি??জ্বরে যখন তোমার গা পুড়ে যাবে তখন যদি তোমার মাথাটা আমার কোলে রেখে বলি…একটু চোখটা বন্ধ কর আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর চিন্তা কর না আমি সব রেঁধে রেখেছি তখন তুমি আমার দিকে চেয়ে কি বলবে?

হিমাদ্রি: ভালোবাসি… ভালোবাসি (খুব দ্রুত এক নিশ্বাসে বলে উঠলো হিমাদ্রি)

রুদ্র:দেখলে হিমা…”ভালোবাসি”কোন সস্তা শব্দ না..আমার হাজার খানেক অনুভুতির উত্তর তোমার এই একটায় শব্দ “ভালোবাসি”
সস্তা আমরাই করে তুলি, মহান আমরাই করে তুলি।
(হিমাদ্রি খানিকক্ষণ চুপ থেকে)

হিমাদ্রি: রুদ্র….তুমি বাড়ি আসছো কবে?
রুদ্র: এইতো এখন ৪:৫৪ বাজে..ভোর হয়ে যাচ্ছে। পাঁচটা ত্রিশের ট্রেন ধরছি।

হিমাদ্রি: আমি পুজো সেরে ফেনা ভাত চড়িয়ে দিলাম…সাথে লঙ্কা বাটা…তুমি সোজা এখানে চলে আসবে।
রুদ্র: হিমাদ্রি……..শোন

হিমাদ্রি: প্রিয় এখন আর নাই বললে কিছু…কাছে এসে আমার হৃদপিন্ডের গতিবিধি মেপে যাও..তোমার শার্টে মেখে থাকা ঘামের গন্ধ দিয়ে যাও….পবিত্র ঐ চাহনি দিয়ে না হয় মেঘ হয়ে জমে থাকা সব অনুভুতি বৃষ্টি হয়ে ঝরালে……

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত