যদি না পড়ে ধরা

যদি না পড়ে ধরা

“আজ রাতে কিছু খাবার চুরি করতেই হবে!” রকি ফিসফিস করে সাম্যকে বলল।

“তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?” সাম্যর চোখগুলো গোল গোল হয়ে গেছে, “তুই রান্নাঘরে গিয়ে খাবার চুরি করবি? ধরা পড়লে কী হবে জানিস?”

“কী আবার হবে?” রকি ওরফে রোহিতাশ্ব ঠোঁট উলটে বলল, “হোস্টেল থেকে বার করে দেবে আবার কী! কিন্তু তার আগে কিছু না খেলে যে প্রাণটাই বেরিয়ে যাবে!”

“তোর ঘরে শুভ্র আর আর্য আছে। ওরা যদি টের পায়?”

“দূর দূর, ওরা দু’জনেই বিছানায় পড়লে মরার মতন ঘুমোয়। বোমা পড়লেও ওদের ঘুম ভাঙবে না! আর তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন বল তো? আমরা খাবারের জন্যে পয়সা দিই না? তবে কেন শুধু একটুকরো শুকনো পাঁউরুটি খেতে দেবে?”

“বা রে, আমরা অন্যায় করেছিলাম তো। তার শাস্তি পাব না?” সাম্য অপরাধীর গলায় বলল, “আমরা তো টর্চের আলোয় হোমওয়ার্ক করছিলাম।”

“সাড়ে দশটার সময় মিচকে শয়তান এসে আলো নিভিয়ে দিলে কী করব? গাদা গাদা হোমওয়ার্ক সব শেষ করতে হবে না? পরদিন অঙ্ক-স্যারের কাছে বকা খেলে খুব সম্মানের হত বুঝি? ক্লাস এইটের পড়া অত তাড়াতাড়ি শেষ হয় নাকি? হেডস্যারকে বলেও কোনও লাভ নেই। তেনারা ইলেকট্রিকের পয়সা বাঁচাচ্ছেন নিজেদের মাইনে বাড়াবেন বলে।”

“তুই তো সাতটা অবধি গল্পের বই পড়ে সময় নষ্ট করলি। তখন হোমওয়ার্ক করলেই হত!”

“আগে বল তুই কার দলে? আমার দলে, না ওই মিচকে আর প্রসাদস্যারের দলে? যা, ওদের দলেই যা তাহলে! কিন্তু খবরদার, যদি আর কোনওদিন পড়া জিজ্ঞেস করতে আসিস তাহলে এমন মজা দেখাব না!”

“তুই মিছিমিছি চটে যাচ্ছিস।” সাম্যর গলায় এবার আপোসের সুর, “আমি ওদের দলে হতে যাব কেন? খিদে তো আমারও পেয়েছে, কিন্তু ধরা পড়ে গেলে যে স্কুল থেকেই বার করে দেবে। তুই ভালো ছেলে, অন্য কোনও স্কুলেও ভর্তি হয়ে যেতে পারবি। কিন্তু আমার কী হবে বল তো?”

“কিচ্ছু হবে না। ধরা পড়লে তবে তো কিছু হবে! তোকে যেতে হবে না তাহলে। তুই এখানে থেকে শুভ্র আর আর্যকে পাহারা দে। যা করার আমি করছি।”

সাম্য নিজের ঘরে চলে গেল রাত বারোটা নাগাদ আবার আসবে বলে।

রকি ক্লাস এইটে এই বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বাবার বদলির কাজের চাকরি বলে রকিকে হোস্টেলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। উঁচু ক্লাস, বারবার স্কুল বদল করলে পড়াশনার ক্ষতি হবে। রকি আগে কখনও হোস্টেলে থাকেনি, তাই প্রথম প্রথম বেশ অসুবিধা হয়েছিল ওর। এত কড়া নিয়মকানুন মেনে চলা তার স্বভাবে নেই। তবে পড়াশোনায় বেশ ভালো বলে ফার্স্ট টার্মিনাল পরীক্ষার পরই রকির প্রচুর বন্ধু হয়ে গেছে। এখন আর হোস্টেলের জীবন মন্দ লাগছে না তার। সবই ঠিকঠাক চলছিল, এমন সময় একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল।

হোস্টেলে ছেলেদের খাবারের দায়িত্বে থাকা দেবনাথস্যার রিটায়ার করলেন, আর তাঁর জায়গায় খাবারের ভার দেওয়া হল প্রসাদস্যারকে। তিনি এসেই ঠিক করলেন যে ছেলেদের খাবার পিছনে অহেতুক প্রচুর টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, তাই কিছু সংশোধন করতে হবে। সপ্তাহে একদিনের বদলে তিনদিন নিরামিষ খাবার চালু করা হল, আর জলখাবারের মান অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেল। সকালবেলা জলখাবারের মেনু থেকে পাউরুটি-মাখন বা রুটি-তরকারি উঠে গেল, আর চালু হল বিস্কুট আর মুড়ি। তাও আবার খুব কম কম পরিমাণে। ওদের সবার বাড়ার বয়স। ঐটুকুনি খাবারে ওদের কারও পেট ভরে না। খিদের চোটে আধমরা হয়ে যাওয়ার জোগাড়!

রকি বাড়িতে সবসময় ভালোমন্দ খাবার খেতে অভ্যস্ত, তাই হোস্টেলের প্রচুর জল দেওয়া পাতলা ডাল আর সপ্তাহে একদিন মাংস আর একদিন মাছ (তাও মাছের দিন এক পিস মাছ আর মাংসের দিনে ছোটো ছোটো দুটো টুকরো মাংস) ওর মোটেই পছন্দ হচ্ছিল না। ব্যস, ওর মাথায় ঢুকল যে ছাত্ররা সব একজোট হয়ে হেডস্যারের কাছে নালিশ করলেই কাজ হবে। একটা চিঠি লিখে সবাই সই করে স্যারের কাছে জমাও দিল। ওরা আশা করেছিল কিছু হবে, কিন্তু কিছু হল না। উলটে প্রসাদস্যারের স্পাই মিচকে কীভাবে জানি জেনে ফেলল যে ছেলেদের উসকে চিঠি সই করানোর পিছনে রকির বড়ো অবদান। মিচকে রান্নাঘরে ফাইফরমাস খাটে, স্যারের সঙ্গে বাজারে যায়। ব্যাপারটায় যে রকির হাত আছে সেটা রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার পর থেকেই নানারকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল। টেস্টের আগে ওর ভূগোল বই হারিয়ে গেল, রকিদের ঘরে সাড়ে দশটায় আলো নিভে যেতে লাগল (এই আলো নেভানোর কাজটাও মিচকে শয়তানের!)।

রকি একবার জিজ্ঞেস করেছিল, “কী ব্যাপার, দা? এত তাড়াতাড়ি আলো নিভিয়ে দিচ্ছ কেন? পড়াশোনা শেষ করতে হবে তো!”

মিচকে কুটিল হাসি হেসে বলেছিল, “হুঁ হুঁ, বাবা! হেডস্যারের হুকুম, ইলেকট্রিকের বিল কম করতে হবে।”

রকির স্থির বিশ্বাস, প্রসাদস্যারই হেডস্যারকে ওই বুদ্ধি দিয়েছেন। তারপর ছুটিতে বাড়ি গিয়ে রকি একটা বড়ো চার ব্যাটারির টর্চ নিয়ে এসেছে। ভালোই চলছিল টর্চের আলোয় এমারজেন্সি পড়াশোনা, কিন্তু তাও মিচকে ব্যাটা আড়ি পেতে ঠিক ধরে ফেলল! আর সঙ্গে সঙ্গে হেডস্যারের কাছে নালিশ চলে গেল। প্রসাদস্যারের লাগু করা নতুন নিয়মে রকি আর সাম্যর সাতদিন ডাইনিং হলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সাতদিন ওদের সকাল বিকেল শুধু একটুকরো করে শুকনো পাঁউরুটি আর জল খেয়ে থাকতে হবে আলো নিভিয়ে শুয়ে না পড়ে টর্চের আলোয় পড়ার জন্যে শাস্তি হিসেবে।

এদিকে স্যারেদের খাবারদাবারের ব্যবস্থা আগের থেকে অনেক ভালো হয়েছে। ছাত্রদের খাবার কীরকম দেওয়া হচ্ছে সে-বিষয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। সেই জন্যেই হয়তো হেডস্যার ওদের চিঠিটা পেয়েও কিছু করেননি। এমনিতে হেডস্যারকে রকির পছন্দ। উনি ওদের ইংরেজির ক্লাস নেন, শিক্ষক হিসেবে খুবই ভালো। কিন্তু আজকাল যেন প্রসাদস্যারের কথা যেন একটু বেশিই শুনছেন। শাস্তির প্রথমদিনই শুকনো পাঁউরুটি খেয়ে রকির মাথায় খাবার চুরির আইডিয়াটা এল। রান্নাঘরে এত খাবার, আর ওদের কিনা না খেয়ে মরতে হবে!

সাড়ে দশটায় আলো নিভিয়ে দিয়ে গেল মিচকে শয়তান। শুভ্র আর আর্য দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল, কিন্তু রকির চোখে ঘুম নেই। খিদে পেটে আবার ঘুম আসে নাকি! শুয়ে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবছিল রকি। সত্যি তো, ধরা পড়ে গেলে কী হবে? স্কুল থেকে বারই করে দেবে হয়তো। তাহলে ভালোই হবে। এভাবে না খেয়ে, আধপেটা খেয়ে বেঁচে থাকা যায় নাকি! বাবা হয়তো রাগ করবেন, কিন্তু খেতে দিচ্ছে না শুনলে মা আর কিছু বলবেন না।

রাত বারোটা বাজার একটু আগেই সাম্য এসে হাজির হল। ওরও বোধহয় খিদের জ্বালায় ঘুম আসছিল না।

রকি ওকে ফিসফিস করে বলল, “তুই চাদর মুড়ি দিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে থাক, তাহলে আর কেউ কিছু বুঝবে না। তুই যা ভিতুর ডিম, তোকে আর চুরি করতে যেতে হবে না। এই ঝোলাটা নিয়ে যাচ্ছি, এতে করেই খাবার যা পাই নিয়ে আসব। শুভ্র বা আর্য ঘুম থেকে উঠলে খেয়াল রাখিস কিন্তু!”

সাম্য চটপট রকির বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। রকি পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাইরেটা অন্ধকার, কিন্তু একটু পরেই চোখ সয়ে গেল রকির। চুপি চুপি বারান্দার লম্বা পথ আর হলঘর পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে চলল সে। খাবার কোথায় রাখা থাকে সে জানে, তাই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু রান্নাঘরের কাছে এসে তার আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেল। এ তো রান্নাঘরে আবছা আলো রয়েছে! কারা যেন রয়েছে রান্নাঘরে! কী ব্যাপার? কী হচ্ছে এত রাতে? পরদিনের রান্নার জোগাড় চলছে নাকি? কিন্তু তা তো হওয়ার কথা নয়। সেটা তো ভোরেই হয়। উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল রকি। ওমা, হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রান্নাঘরে কী করছে মিচকে? সঙ্গে আরেকটা লোক রয়েছে। দু’জনে মিলে বস্তায় কীসব ভরছে!

হঠাৎ কাঁধে হাত পড়তে প্রচন্ড ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ফেলতে যাচ্ছিল রকি। তারপর দেখল, ওর পিছনে কখন নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছেন হেডস্যার! উনি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওকে চুপ করতে বলছেন। ভয়ে রকির বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। তারপর ওর পিছন থেকে এগিয়ে গিয়ে হেডস্যার সোজা রান্নাঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা কী হচ্ছে, উমাকান্ত? তোমাকে আমি চাকরি দিলাম আর তুমি কিনা হোস্টেলের রান্নাঘরের জিনিস চুরি করছ!”

মিচকের নাম উমাকান্ত শুনে রকির খুব হাসি পেল। ওকে মিচকে বলে ডাকতে ডাকতে ওরা আসল নামটাই জানত না।

মিচকে ভয়ে প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, “আমি কিছু জানি না, স্যার। প্রসাদস্যার বলেছিলেন, মুদির দোকানের শ্যামবাবু এলে তাকে কিছু জিনিসপত্র দিয়ে দিতে। তাই…”

হেডস্যার প্রচন্ড রেগে গিয়ে বললেন, “আমি আর কিছু শুনতে চাই না! দেখতেই তো পাচ্ছি রান্নাঘর থেকে মালপত্র পাচার করা হচ্ছে! কাল থেকে তোমাকে আর কাজে আসতে হবে না। আমি প্রসাদবাবুর সঙ্গেও কথা বলব। আপাতত যেখান থেকে মাল সরিয়েছ সেখানেই রেখে দাও। শ্যামাবাবু, আপনি এবার আসুন।”

লোকটা কোনও কথা না বলে সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেল। উমাকান্ত জিনিস তুলে তুলে রাখতে লাগল। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে হেডস্যার রকিকে বললেন, “তোমাদের অভিযোগের চিঠি আমি পেয়েছি, কিন্তু প্রমাণ ছাড়া তো শাস্তি দেওয়ার উপায় ছিল না! আজ তোমাকে এত রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এদিকে আসতে দেখে তোমার পিছু নিয়েছিলাম। ব্যস, হাতেনাতে সব ধরে ফেলা গেল। ভালোই গোয়েন্দগিরি হল, কী বলো?”

রকির মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না। সেও তো চুরির উদ্দেশ্যেই এসেছিল। সেই কথা কি আর এখন বলা যায়?

স্যার অবশ্য বললেন, “শোনো, এই ঘটনার কথা যেন আর কেউ না জানতে পারে। আমি ওদের উচিত শাস্তির ব্যবস্থা করব।”

রকিকে খালি হাতে ফিরতে দেখে সাম্য খুব হতাশ হয়েছিল। তবে পরের দিন যখন শুনল যে ওদের শাস্তি তুলে নেওয়া হয়েছে আর ওরা সবার সঙ্গে ডাইনিং হলে বসে খেতে পারবে, তখন ভারি অবাক হল। স্কুলের অন্য সবাইও খুব অবাক হল প্রসাদস্যার আর মিচকের আকস্মিক অন্তর্ধানে।

প্রসাদ স্যার চলে যেতেই খাবারের মান ভালো হয়ে গেল। শোনা গেল, হেডস্যার নিজেই নাকি হোস্টেলের খাবারের দিকটা দেখছেন। ক্লাসের সবাই ধরে নিল, ওদের সই করা প্রতিবাদ চিঠির জন্যেই সবকিছু বদলে গেছে। তাই সবাই হিরো। খালি রকিকে একা দেখতে পেলেই হেডস্যার মুচকি মুচকি একটা রহস্যময় হাসি হাসেন। আর রকি ভাবে, হেডস্যার কি বুঝতে পেরেছিলেন যে সেদিন রকিও রান্নাঘরের ভাঁড়ার থেকে খাবার চুরি করতেই গিয়েছিল!

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত