এক চিলতে সুখ

এক চিলতে সুখ

বাবা যখন মারা গিয়েছিল, তখন আমি ক্লাস ফাইভে৷ একদিন স্কুল ফিরে এসে দেখি বাবাকে সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়েছে৷ আমার মায়ের আহাজারি আর বাবার নীথর দেহ, বেদনার ব্যাথাটা আমার বুকে এসে বিঁধেছিল সেদিন৷
আমার মায়ের সাথে নানুরবাড়ির সম্পর্ক ছিল না৷ আমার মায়ের অপরাধ ছিল সাধারন ঘরের ছেলেকে বিয়ে করা৷ শুনেছি, আমার নানাজান রাগী মানুষ ছিলেন৷ আমার মামারা সবাই বড় ঘরের মেয়ে বিয়ে করে এনেছিলেন৷ খালাদেরও বিয়ে হয়েছিল বড় ঘরে৷

সেইখানে আমার মায়ের ব্যতিক্রমি হওয়াটা নানা মেনে নিতে পারেনি৷ বিয়ে হওয়ার পরেও নাকি, বাবাকে লোক দিয়ে মার খাইয়েছিলো মামারা৷

সেই কথা শোনার পর আমারও আর মন টানেনি ওদিকটাই৷

বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে খালারা দেখতে আসে মা কে৷ আমাকে কোলে তুলে আদর করে সবাই৷ আমার নীরস লাগে সবকিছু৷ সারাক্ষণ মায়ের কোলে বসে থাকতাম৷ মায়ের অসহায় উদাসীন চাহনী আমার ভেতরটা চুরমার করতো প্রতিনিয়ত৷ মাঝে মাঝে ঢুকরে কেঁদে উঠতেন৷ মায়ের কান্না দেখলে আমার বুকে ব্যাথা উঠতো৷ গলায় দলা পাকিয়ে উঠতো৷ আমিও কেঁদে দিতাম৷

মা আমাকে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে কান্না করতেন৷
তারপর একসময় হুট করে কান্নার বেগ কমে যেত৷ মায়ের মুখে চোখের পানির ছক বসে গিয়েছিল৷

৪০দিন যেতেই মামা-খালারা উঠে পরে লাগলেন৷ মা কে বিয়ে দিবে বলে৷ মা আমার কিছুতেই রাজি হন না৷ মায়ের এক কথা,

-আমি বিয়ে করবোনা৷ যাকে বিয়ে করবো সে যদি আমার সন্তান সাথে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়৷ তাও বিয়ে করবোনা৷ আমি আমার স্বামীকে কখনোই ভুলতে পারবোনা৷”

একসময় সবাই ক্ষান্ত হয়ে পরে৷ মা তার সিদ্ধান্তে অটল ছিল সবসময়৷
মা কে যখন বলা হয়েছিল, নিজের বাড়িতে গিয়ে থাকতে৷ মা তাতেও রাজি হননি৷ মা সবসময় বলতেন,
-যে বাড়িতে আমার স্বামীর মর্যাদা দেয়া হয়নি সে বাড়িতে আমি যাবো না৷ মানুষটা আমাকে কথা দিয়েছিল, আমায় একমুঠো সুখ এনে দিবে৷ একমুঠোর বদলে আমাকে এক আকাশ সুখে রেখেছে৷ অবলম্বন হিসেবে একটা সোনার টুকরো দিয়ে গিয়েছে৷ এই সোনার টুকরোকে আঁকড়ে ধরে আমি সারাজীবন কাটিয়ে দিবো৷

বছর চারেক পরে, এক গ্রীষ্মের দুপুরে মায়ের হাতের বিরিয়ানী খেয়ে শুয়ে ছিলাম৷ দরজার পাশে বসে মা আমার বাইরে তাকিয়ে ছিল উদাস দৃষ্টিতে৷ আমি শোয়া থেকে খেয়াল করি, মায়ের চিবুক বেঁয়ে পানি ঝরছে৷  আমি গিয়ে মাকে ঝড়িয়ে ধরি৷ মা আমার চেয়েও শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে৷

আমি মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
-বাবাকে খুব ভালোবাসো তাই না?
মা ধরা গলায় বলেছিল,

– ৪বছর হলো মানুষটা পাশে নেই৷ জানিস কত দুঃখ কষ্টে সুখের সংসারটা গড়েছে মানুষটা৷ একদম নিজ হাতে৷ সুখের সময়ে হুট করে চলে গেল৷

জানিস এই রকম এক গ্রীষ্মের দুপুরে আমি তোর বাবাকে হুট করে এসে বলেছিলাম,
-বিয়ে করতে পারবে আমাকে? এখনই?
তোর বাবা বলেছিল,

-পারবো৷ হয়তো আকাশের মতো সীমাহীন সুখ দিতে পারবোনা৷ তবে শরতের সাদামেঘের মতো এক চিলতে সুখ এনে দিতে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো৷ এবার বলো, তুমি কি যাবে?”

আমি রাজি হয়ে গিয়েছিলাম৷ তোর বাবাই তো আমার সুখ৷

তারপরের সকালগুলো শুরু হলো, বাস্তবার নির্মমতা দিয়ে৷ তোর বাবা দু’একটা টিউশন করতো৷ পালিয়ে বাঁচতে সেগুলোও ছাড়তে হলো৷ নতুন একটা জায়গায় গিয়ে উঠেছিলাম আমরা৷ পকেটে অল্প টাকা ছিল৷ কিছুদিনের মধ্যেই শেষ৷

উপায়ান্তর না দেখে স্কুলের সামনে গিয়ে বসে থাকতো মানুষটা৷ স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী দেখলেই বলতো,
-আমার কাছে পড়বে? ভালোমতো পড়াবো৷ তোমার যা খুশি দিও৷”
ওরকম বললে কি আর টিউশন পাওয়া যায় বল৷
মানুষটা ভালো ছবি আঁকতো৷ দেয়ালে দেয়ালে লিফলেট লাগাতো,
“ব্যবহারিক চিত্র যত্নসহকারে আঁকি”৷
মাঝে মাঝে দু’একজন আসতো যোগাযোগ করতে৷
আস্তে আস্তে দু’একটা টিউশন ও পেয়েছিল৷ ”
রোজ সকালে খালি পেটে বেরিয়ে পরতো মানুষটা৷ কিছু খেতে বললেই বলতো,
-সকালে কিছু খেতে পারে নাকি মানুষ? বমি আসে৷”
কিন্তু মানুষটা আমার অগোচরে ঠিকই ঢকঢক করে পানি খেয়ে বের হতো৷
আমি লুকিয়ে দেখতাম সব৷ শাড়ির আঁচল মুখে গুজে লুকিয়ে কাঁদতাম৷
পাছে দেখে ফেললে মানুষটার মন ভেঙে যাবে৷

আমাকে সুখের নিশ্চয়তা দিতে না পারা মানুষটা আমাকে একচিলতে সুখ এনে দিতে কত কষ্টই না করলো৷

একদিন রাত করে বাড়ি ফিরলো মানুষটা৷ এমনিতে অতো দেরীতে কখনোই ফিরেনি৷ আমি কারণ জিজ্ঞেস করতেই বলেছিল, নতুন টিউশন পেয়েছে৷

১,২,৩দিন একই সময়ে বাড়ি ফিরলো মানুষটা৷ ৪দিনের দিন সকালে আর উঠতে পারে না শরীরের ব্যাথায়৷ গায়ে সে কি জ্বর৷ হাতে গোটা কয়েক ফুসকা পরে গিয়েছে৷

সেই ফুসকা পরা হাতটা আমার মাথায় ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,

-এটা কিভাবে হলো৷ সত্যি করে বলো৷”
মানুষটা হাঁড়কাঁপানো জ্বর নিয়েও হেসে বলেছিল,

-রাজমিস্ত্রির কাজ করেছি৷ আমাকে আটকাবে না আমেনা৷ দেখো, আমি ঠিকই একদিন সুখ কিনে আনবো তোমার জন্য৷”

আমি মানুষটার হাতটা আমার মুখে লাগিয়ে বলেছিলাম,
-তুমিই আমার সুখ৷ প্রাচুয্যের সুখ আমার লাগবেনা৷.

তারপরও মানুষটা পিছু হটেনি৷ পুরো সপ্তাহ কাজ করতো মানুষটা৷ শুক্রবার আসলেই বলতো,
-আমেনা বিরিয়ানী রাঁধো৷ তোমার হাতের বিরিয়ানীগুলো অমৃতের মত লাগে আমার৷”
তারপর শেষবিকেলে আমাকে নিয়ে ঘুরতে বেরোতো৷ নদীর পারে বসে থাকতাম আমরা৷
নদীপানে উদাস হয়ে তাকিয়ে থেকে মানুষটা বলতো,
-জানো আমেনা! নদীর ওপারেতে বড্ড সুখ তাই না?
আমি কাঁধে মাথা রেখে বলতাম,

-কে বলেছে? সব সুখ তো আমাদের ছোট্ট কুটিরে৷ ওপারের মানুষগুলো বড্ড নিষ্ঠুর৷ ওপারের মানুষগুলো আমাদের অনূভূতিগুলো এক হতে দিতে চাইনি৷ ওপারের মানুষের হৃদয় নেই৷”

মানুষটা আমার কথা শুনে হাসতো৷ তারপর বলতো,

-তুমি এতো ভালো কেন? এত ভালোবাসো কেন আমাকে৷ আমি কি এগুলো পাওয়ার যোগ্য?”
জবাবে আমি কিছু বলিনা৷ চুপ করে মানুষটার হাত ধরে বসে থাকি৷

একচিলতে সুখ এনে দিতে রাত দিন পরিশ্রম করে গিয়েছে মানুষটা৷ দিনশেষে মানুষটার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে মায়া হতো আমার৷ বুক ফেটে কান্না আসতো৷ প্রাণপণ চেষ্টা করে চাপিয়ে যেতাম৷

যেদিন তুই হয়েছিলি৷ সেদিন তোর বাবা ১৫বছরের দূরন্ত কিশোরের মতো লাফানো শুরু করেছিল৷
তোকে কোলে নিয়ে তোর কপালে চুমু এঁকে বলেছিল,

-আমেনা আমি সুখ কিনতে পেরেছি৷ আমাদের সুখের গাছটাকে যত্ন করে বড় করবো৷ আমাদের সুখটাকে কখনো দুঃখের সাথে পরিচিত হতে দিবো না৷”

মানুষটা আনন্দ দেখে আমি নির্বাক হয়েছিলাম সেদিন৷ কিছু বলতে পারিনি আমি৷ আমার চোখ বেঁয়ে আনন্দাঅশ্রু গড়িয়ে পরেছিল৷”

তুই যেদিন অস্পষ্ট গলায় “বাবা” ডেকেছিলি৷ সেদিন মাটির ব্যাংকটা ভেঙেছিল৷
সেই টাকা দিয়ে মিষ্টি কিনে, রাস্তায় যাকে দেখেছে তাকেই খাইয়েছে৷
আমার হাত ধরে বলেছিল,

-আমেনা আমি স্বর্গসুখ পেয়ে গিয়েছি৷ জানো আমেনা! আজ আমি বড় নিশ্চিন্ত৷ যেদিন আমি থাকবোনা৷ আমার এই স্মৃতিটা আঁকড়ে তুমি মনে রেখো আমাকে৷ আমার সুখটাকে আগলে রেখো৷”

মা আরকিছু বলতে পারেনা৷ হাউমাউ করে কেঁদে উঠে মা৷ আমি মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি৷ মা আমার কপালে, গালে স্নেহের চুমু দেয়৷ আমার বাবাটাকে নিয়ে গর্ব হয় আমার৷ দুঃখ জিনিসটা মানুষটাকে হার মানাতে পারেনি৷ শরীরের নোনতা ঘাম ঝরিয়ে একচিলতে সুখ এনে দিয়েছে তার প্রিয়মানুষটাকে৷ অভাব জিনিসটাকে ভালোবাসা দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে দু’জন ভালোবাসার কাঙাল৷

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত