চিরপথের সঙ্গী

চিরপথের সঙ্গী

ফ্লাইটটা অনেক রাতের! এত তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সন্ধ্যেবেলার ফ্লাইট পাওয়া গেলনা। হেমন্তিকা একদৃষ্টিতে নির্ঝরকে দেখছেন!

এই দু’ বছরে কত বড়ো হয়ে গেল ছেলেটা!

ছাত্র- ছাত্রীরা সমানে ফোন করছে হেমন্তিকার ফোনে। প্রত্যেককেই খুব সুন্দর ভাবে উত্তর দিচ্ছে নির্ঝর। বুঝিয়ে বলছে – আগামীকাল ভোরে হেমন্তিকার গানের স্কুল -‘ আনন্দধারা’র রবীন্দ্র- জয়ন্তী পালনের যে অনুষ্ঠানটা হবার কথা ছিল- সেটা নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট জায়গাতে যেন ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের উদ্যোগে এবং দায়িত্বে সুচারুভাবে পালন করে। হেমন্তিকার অনুপস্থিতির কারণে অনুষ্ঠানটা যেন কোনোও রকম ভাবে বিঘ্নিত না হয়।

আগামীকাল ‘আনন্দধারা অনুষ্ঠানের’ উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশনের দায়িত্বটা ছিল নির্ঝরের। চেন্নাই থেকে গতকাল ভোরেই ছুটিতে বাড়ি এসেছে নির্ঝর। গত একমাস ধরে যে জ্বরটা খুব কাবু করে ফেলছে বারবার হেমন্তিকাকে – গতকালও সেটার প্রকোপে শয্যাশায়ী ছিলেন হেমন্তিকা। নির্ঝর এসে কি বুঝেছিল কে জানে! তড়িঘড়ি ডাক্তার দেখিয়ে একদিনের মধ্যে সমস্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। মুম্বাইয়ের ফ্লাইট ধরে ‘টাটা মেমোরিয়াল ক্যান্সার হসপিটালে’ মাকে নিয়ে যাচ্ছে নির্ঝর।

বাবার মুখখানা বারবার মনে পড়ছে এই মুহূর্তে হেমন্তিকার। বাবার গাওয়া গান -‘ নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে! ‘

ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে – বাবা-ময় জীবন ছিল হেমন্তিকার। আর ছিলেন রবি ঠাকুর – তার অপরূপ সৃষ্টির ভান্ডার নিয়ে। কথা বলতে শিখেই, আধো-আধো সুরে বাবার গান শুনে শুনে হেমন্তিকাও গাইতেন -‘ সত্য মঙ্গল প্রেমময় তুমি ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে। ‘ কথাগুলোর কোনোও মানে বুঝতে পারতেননা হেমন্তিকা। কিন্তু মনে হতো, কথাগুলোর মধ্যে বাবার স্নেহ স্পর্শের মতো জাদু রয়েছে যেন। সেই তখন থেকেই – রবি ঠাকুরকে বড় কাছের মানুষ বলে মনে হতো।

তারপর যত বড়ো হয়েছেন – রবীন্দ্র সংগীত নিঃশ্বাসে- প্রশ্বাসে সমস্ত সত্তার সঙ্গে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে হেমন্তিকার!

কলেজ সোশ্যালে পরম আবেগে গেয়েছিলেন

-‘ হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে, হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে। ‘
থার্ড ইয়ারের নিলয় বসু প্রেমে পড়ে গিয়েছিল তৎক্ষণাৎ। ওর প্রথম প্রশ্নটাই ছিল -”হেমন্তিকা নামটা কি এই গানটা থেকেই নেওয়া? ”

উত্তর দিতে গিয়ে বাবার গল্প, মা হারা জীবনে বাবার অনুপ্রেরণায় – সুখে দুঃখে রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় নেওয়া …সবটুকুই কেমন যেন উজাড় করে বলে ফেলেছিলেন হেমন্তিকা ওই স্বল্প পরিচয়তেই।

পাঁচ বছরের উদ্দাম প্রেমের পরে বিয়ে। তারপর ছেলে নির্ঝরের জন্ম। অনেক সাধ করে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকেই হেমন্তিকা ছেলের নাম রেখেছিলেন – ‘ নির্ঝর। ‘

সোহাগে -আদরে নিলয়ের সাথে কটা বছর কেটে গেছিল দুর্বার গতিতে । নিলয়ের উদ্যোগেই হেমন্তিকার গানের স্কুল ‘আনন্দধারা’ তৈরী হয়েছিল । নিজের এতদিনের রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষা উজাড় করে দিয়েছিলেন হেমন্তিকা -তার ছাত্র-ছাত্রীদের তৈরী করতে ।

এত সুখের মধ্যেই হঠাৎই একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় নিলয়ের মৃত্যু ছারখার করে দিয়েছিল হেমন্তিকার জীবন! এই শোক সহ্য করতে না পেরে কিছুদিনের মধ্যেই বাবাও মারা গেলেন!

ছোট্ট নির্ঝরকে বুকে নিয়ে, আবার আর একটা লড়াই শুরু হল হেমন্তিকার! ওই পরম দুঃখের দিনে – বারবার মনে হতো রবীন্দ্রনাথের জীবনের একের পর এক বিপর্যয়ের কথা। রবীন্দ্রনাথের সন্তানহারা পিতৃহৃদয় কেমন আকুল হয়ে একের পর এক সৃষ্টি সুখের উল্লাসে নিজেকে কিভাবে নিয়োজিত করেছিলেন – সেই কথা!

 

‘আনন্দধারা’ পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষার পীঠস্থান হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র নির্ঝর পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকেই নিয়মিত মায়ের কাছে নিষ্ঠা ভরে রবীন্দ্র সংগীত শিখেছে!
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে নির্ঝর চলে গেল চেন্নাইতে ডাক্তারী পড়তে।

এবছরের ‘ পঁচিশে বৈশাখ’ বিশেষভাবে উদযাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন হেমন্তিকা কারণ এ বছরই-‘ আনন্দ ধারা’ কুড়ি বছর পূর্ণ করলো ।

এই অনুষ্ঠানটা কিভাবে আরো মনোজ্ঞ ভাবে পরিবেশন করা যায় – তাই নিয়ে প্রতিদিন ফোনে নির্ঝরের সাথে জোর আলোচনা চলতো হেমন্তিকার। অসম্ভব ভালো গাইছে ইদানিং নির্ঝর।
কিন্তু…!

 

হেমন্তিকা কি আদৌ সুস্থ হয়ে ফিরতে পারবেন মুম্বাই থেকে? ডাক্তাররা যা সন্দেহ করছেন – তাই যদি হয় মানে ‘ফুসফুসে ক্যান্সার’ কি ভালো হবে? গান গাইতে কি আর পারবেন হেমন্তিকা?

হঠাৎ হাতের মুঠোয় একটা অসম্ভব চাপ অনুভব করলেন হেমন্তিকা!নির্ঝর শক্ত করে ধরে রেখেছে মায়ের হাত। আর মায়ের কাছে ছোটবেলায় শেখা প্রথম গানটি আবার গাইছে এতদিন পরে-

-” সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি,
দুঃখে তোমায় পেয়েছি প্রাণ ভ’রে।”
মাকে অভয় দেবার চেষ্টা করছে নির্ঝর!

নিজেকে আবার নতুন করে উজ্জীবিত করলেন হেমন্তিকা। নির্ঝরের জন্য তাকে সুস্থ হতেই হবে। চিকিৎসার পথ যতই কঠিন হোক না কেন – লড়াই করাটা থামিয়ে দেবেননা কিছুতেই হেমন্তিকা!

নিজের মধ্যে পাক খেতে থাকা ভয়টাকে ক্রমশ দূরে ঠেলে সরিয়ে দিতে দিতে হেমন্তিকাও মনে মনে গলা মেলালেন ছেলের সাথে –

-” আজ তো আমি ভয় করি নে আর
লীলা যদি ফুরায় হেথাকার।
নূতন আলোয় নূতন অন্ধকারে
লও যদি বা নূতন সিন্ধুপারে
তবু তুমি সেই তো আমার তুমি,
আবার তোমায় চিনব নূতন ক’রে। ”

জীবনের প্রত্যেকটি সুখে দুঃখে এ যাবৎ পরম আশ্রয় দিয়েছেন – রবীন্দ্রনাথ। আজ এই মুহূর্তে – ‘নতুন উদ্যমে বাঁচার লড়াইটা শুরু করতেই হবে প্রাণপণে’ এই কথাটা ভাবতে ভাবতেই নির্ঝরের গান আরো একবার হেমন্তিকার কাছে প্রমাণ দিয়ে গেল যে, রবীন্দ্রনাথই তাঁর

-‘ চির পথের সঙ্গী আমার, চিরজীবন হে। ‘
এই লড়াইটা জিততেই হবে হেমন্তিকাকে!
রাত পোহালেই আগামীকাল পঁচিশে বৈশাখ…!

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত