বিবর্ণ বন্ধকীনামা

বিবর্ণ বন্ধকীনামা

যেই মাটির ঘরটাতে আমাকে থাকতে দেয়া হয়েছে সেই ঘরের পাশেই পুকুর। জানালা দিয়ে কখনো কখনো পুকুরের পানির আঁশটে গন্ধ নাকে লাগে। আচ্ছা মাছের গন্ধ আঁশটে হয়, তবে আমি কেন বলছি আমার নাকে পুকুরের পানির আঁশটে গন্ধ লাগে? এই গন্ধটা এখন আর আমার ভালো লাগেনা। অথচ একটা সময় শ্বশুরের পুকুরের এই গন্ধটা নেবার জন্যই সন্ধ্যার অন্ধকারে পুকুরের পারে গিয়ে দাঁড়াতাম। বিবাহিত হয়েও স্বামীর ছায়া ছিলনা আমার উপর। যেই মেয়ের স্বামী নিরুদ্দেশ হয় তার বদনামের অন্ত থাকেনা। আর যদি আশেপাশে যুবক বয়সী দেবররা থাকে তাহলেতো কথাই নেই।

আজ আমার মেয়ের আসার কথা। আমার চারিত্রিক সনদপত্র নিয়ে। প্রথম শ্রেণির গেজেটেড অফিসারের সিল, স্বাক্ষর করা আর সবার মতো গতানুগতিক চারিত্রিক সনদপত্র নয়, এটা ডিএনএর টেস্ট রিপোর্ট।

আমার মেয়েটা পড়াশুনায় তুখোড়। ওর সবথেকে কাছের বন্ধু ও আমাকেই মনে করে এখন পর্যন্ত। কতো কিছু যে ও আমার সাথে শেয়ার করে তার ইয়ত্তা নেই। শখ ছিল বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে নামের আগে ডক্টরেট তকমাটা লাগাবে। কিন্তু দেশের শুরুটাই বেচারী সঠিকভাবে করতে পারেনি।

খুব স্বপ্ন নিয়ে ওর সাবজেক্টের থিসিস কোর্সটা নিয়েছিল। ও তখনও থিসিসের অআকখ কিছুই জানতো না, যদিও তার আগের কোর্সে একটা রিপোর্টে ও ৯০ প্লাস নম্বর পেয়েছিল। কিন্তু ছয়মাস ও শুধু রিসার্চ টাইটেল নিয়েই ঘুরেছে সুপারভাইজারের পেছন পেছন। হতাশার চূড়ান্তে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল…কিন্তু দু-দু’টা দুধের বাচ্চা সামলে, রাতে বাচ্চাদের ঘুম পারিয়ে চোখের জল নিয়মিত লুকাতো আর পড়ায় মন বসাতো। ভাবতো এবার বুঝি ওর ফার্স্টক্লাস নম্বর মিস হয়ে গেল…ওর স্বপ্নের প্লেসটা বুঝি ও আর ধরে রাখতে পারলো না। হয়তো বিবাহিত জীবনের পরাধীনতা থেকেই কীভাবে দাঁত কামড়ে লেগে থাকতে হয় সংসার থেকে শিখে গিয়েছিলো। যেই লেগে থাকা বা স্বপ্ন দেখাটা ওর শৈশব বা কৈশোরে ছিলনা। ও গোয়েন্দা হতে চেয়েছিল। আমি কখনো জোর করিনি ওর ইচ্ছেতে। ও আসলে তখনও শিখেনি সুপারভাইজারের লোলুপ দৃষ্টি সামলে কীভাবে কৌশলে নিজের কাজ উদ্ধার করে নিতে হয়। তাই ছয়মাস পর বাধ্য হয়ে সুপারভাইজারকে বলেছিল ‘স্যার, দুই বাচ্চা সামলে থিসিসের কাজ করতে পারছিনা, তাই ছেড়ে দিতে চাই।’ আমার কাছে এসে গোপনে কেঁদেছে। শেষ পর্যন্ত ৩০০ নম্বরকে কোরবানি দিয়ে ১০০ নম্বরের প্র্যাক্টিকাম করেছে। হ্যাঁ, সেখানে ফার্স্টক্লাস নম্বর ছিল। কিন্তু মেয়েটা আমার তৃপ্তি পায়নি ডিপার্টমেন্টে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও। কারণ একটাই …থিসিস ছাড়া ও কোর্স শেষ করেছে।

ও এখনও ওর ক্যারিয়ার নিয়ে যুদ্ধ করছে। যুদ্ধ করছে ‘স্বামী’ নামক প্রভুর মন যুগিয়ে ক্যারিয়ার বাঁচাতে। ওর এই সংগ্রাম আমার ভালো লাগে দেখতে। আমি অনেক কিছুই পারিনি। আমি পারিনি নিজেকে পর্যন্ত বাঁচাতে। জীবন দিয়ে একটা ব্যাপার বুঝেছি, মেয়েদেরকে খুব বেশি কৌশলী, চতুর না হলে টিকে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে উঠে। আমি কৌশলী ছিলাম না বরং খুব বেশি বোকা ছিলাম। মানুষকে বিশ্বাস করতাম আরো বেশি। তার খেসারতই এখন আমায় দিতে হচ্ছে এই মাটির ঘরে থেকে। জানিনা জীবনের বাকী সময়টা কেমন করে কাটবে।

মাটির ঘরগুলো বেশ পুরনো। এখানে থাকাটা একটু কষ্টকরই বটে। আমার বিছানার একটু পাশেই বৃষ্টির পানি পড়ে ঘর ভেসে যায়। ঘরের বিভিন্ন স্থানে ইঁদুরের গর্তে ভরে গেছে। সেদিন শ্রাবণ মাসের বৃষ্টির পর ঘর থেকে একটা সাপ বেরিয়ে গেছে। আমার করার কিছুই নেই। আমাকে এখানেই থাকতে হবে। পাশেই কয়েকটা পাকা ঘর। সেখানে ছেলে তার সংসার পেতেছে। আমাকে ওরা খাবারে কষ্ট দেয়না। কিন্তু ছেলে নিয়মিত মনে করিয়ে দেয় বন্ধকী জমি ছাড়িয়ে নিতে। আর সাথে এও জানিয়ে দেয় সেখানে মেয়ের কোন হক-দখল নেই। আর মেয়ে কার জন্মের সেটা নিয়েও ছেলের সন্দেহ নয় রীতিমতো সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে সে। কখনো ঝগড়া তুলে মেয়েকে সাফ জানিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনা।

বর্তমানে এলাকার চেয়ারম্যান হচ্ছেন আমার মামা শ্বশুর। উনার কাছে কোন সমস্যা নিয়ে গেলে মুখের উপর বলে দেন ‘আপনজনদের জন্যে কিছু করলে বদনাম হবে’। কিন্তু উনারই পরিবারে আমার স্বামীর সম্পত্তি আটকে আছে সেকথা কখনো তুলতে পারিনি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি এলাকার মেম্বার ছিলেন। বিহারিদের নিরাপত্তার জন্যে মাটির নিচে বাঙ্কার তৈরি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মতো নিরাপত্তাহীন ভাগ্নে বউয়ের কথা উনার ভাবনায় আসেনি।

কিন্তু এসব কার কাছে বলবো? আর ছেলেতো আমার সাথে সৎবাপের মতো আচরণ করে। ছেলের ছুড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জেই মেয়েটি ডিএনএ টেস্ট করাতে বাধ্য হয়েছে।

কখনও খুব নিবিড়ভাবে ও আমায় জিজ্ঞেস করেছে, ‘মা, আব্বাতো আপনাকে সেভাবে ছায়া দিয়ে রাখতে পারেননি। হয়তো সেই দুঃসময়ে, কখনো আপনার দূর্বলতম সময়ে কেউ আপনার কাছ থেকে সুযোগ নিয়েছে। তেমন কিছু হলেও কিন্তু আমার কোন সমস্যা নেই মা। আমি আপনাকে মা ডেকে যেমন বড় হয়েছি তেমনি বাবাকে বাবা জেনেই বেড়ে উঠেছি। এর বাইরেও যদি কোন দূর্ঘটনা ঘটে থাকে আমার দিক থেকে কোন সমস্যা নেই। এসব নিয়ে ভেবে জীবনটাকে দূর্বিষহ করার কোন আগ্রহ আমার নেই।‘ আমি মেয়েকে বলতে পারিনি, আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সেই অন্ধকার হয়ে থাকা ইতিহাস। কেবল মলিন হাসি দিয়ে বলেছি, নাহ রে তেমন কিছু ঘটেনি। তুই নিশ্চিন্ত থাক। ও নিশ্চিন্ত থাকতে চেয়েছে। কিন্তু ছেলের সম্পত্তি দরকার। আমাকে নিয়মিত তাগাদা দেয় তাকে লিখে দিতে। ছেলের বউ এই নিয়ে প্রায়ই খোঁটা দেয়। একমাত্র ছেলেকে সম্পত্তি লিখে দিতে আমার এতো সমস্যা কিসের?

আমি বউকে বলতে পারিনি আমার সমস্যার কথা। যেই অপবাদে আজ আমার চারিত্রিক সনদ পত্র আসবে সেই একই অপবাদে আর কোন বিশেষ মেয়ের চারিত্রিক সনদপত্র কি আমার ছেলে আনবে? যেই মেয়ের ঔরষে আমারই ছেলের সন্তান রাখতে না পেরে সেই মেয়ে পৃথিবী ছেড়েছে?

ছেলে কলেজে পড়ার সময়ই উত্তর পাড়ার এক মেয়ের সাথে দেখতাম খুব ভাব হয়ে গেছে। আমার আপত্তি ছিলো না ওদের সম্পর্কে। ভেবেছিলাম ছেলে একটু রোজগেরে হোক। তারপর দিনক্ষণ দেখে ওর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে বিয়েটা পড়িয়ে দিব। কলেজ পাশ দেবার পর ছেলে যখন সরকারি চাকরির পোস্টিং-এ এলাকা ছাড়লো তার পরপরই মেয়েটা এসে প্রায়ই খুব কাঁদতো আমার কাছে। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলতো না কেবল অঝোরে কাঁদতো। একদিন ওর এক বান্ধবী বলে দিল সেই ভয়ঙ্কর সত্যি কথাটা যে, কী কারণে ও শুধু বোবার মতো কাঁদে আমার কাছে। ছুটিতে ছেলে যখন বাড়ি এসেছিল তখন ছেলেকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে বিয়ের কথা পারলাম। জানালাম মেয়েটিকে আমার অপছন্দ নয়। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ছেলে মুখের উপর বলে দিল ওই চরিত্রহীন মেয়েকে সে বিয়ে করবে না! আমি বোবা হয়ে গিয়েছিলাম! তাহলে আমার কাছে মেয়েটির কান্না কি মিথ্যে ছিল? অভিনয় ছিল? আমার কাছে এর জবাব নেই। মেয়েটির বান্ধবী দাই দিয়ে লুকিয়ে এ্যাবরশন করালেও শেষ রক্ষা হয়নি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সে চলে গেছে এই মিথ্যে আশার পৃথিবী থেকে।

লজ্জায়, ঘৃণায় আমার গা রিরি করে উঠে। মায়ের উপর এতো বড় অপবাদ ছেলে আমার বিশ্বাস করলো কেমন করে? হয়তো নিজে অভিজ্ঞ বলেই সম্ভব হয়েছে বিশ্বাস করতে। কৈ আমার মেয়েতো বিশ্বাস করেনি কখনো! বরং আমাকে সবসময় বলেছে…’মা, এসব একদম গায়ে মাখবেন না। লোকের মন্দ পুষ্পচন্দ।‘

প্রায় ঘরের পুরুষরাই ঘর ছাড়ছে। কেউ ভয়ে পালাচ্ছে আর কেউবা দেশকে স্বাধীন দেখার আশায় ঘর ছাড়ছে। আমার ঘরের দু’জন পুরুষ দেশকে স্বাধীন দেখতেই ঘর ছেড়েছিল। ছেলেটার তখন কতোই বা বয়স! মেট্রিক পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কে জানতো আমার ছেলে কখনোই মেট্রিক পাশ করতে পারবে না! কখনোই আর আমার বুকে ফিরতে পারবে না! ছোট ছেলেটি তখন নিতান্তই ছোট। স্কুলে যাওয়ার বয়স তখনও হয়নি।

মনে আছে নভেম্বরের একরাতে ছেলের বাবা এসেছিল। বলে গিয়েছিল কোন দুশ্চিন্তা না করতে। আর… শেষ আদর করে গিয়েছিল। পরেরবার যখন এসেছিল বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে..হাতে বড় ছেলের রক্তাক্ত জামা-কাপড়। তারপর আর ফেরেনি…। আমার কপাল পুড়েছিল তখনই। আমি জানতেও পারিনি।

মামা শ্বশুরের তিন ছেলের দু’জনই বাড়ি ছাড়া। একজন রয়ে গেছে। নিয়মিত আমার খোঁজ খবর রাখতো। কাছের পুরুষ বলতে তখন সেই দেবরই ভরসা ছিল (!)। সবধরনের সহযোগিতা তার কাছ থেকে পেয়েছি। সব পুরুষের ভেতরই হয়তো নারী লোভী একটা সত্তা বাস করে। যাদেরটা প্রকাশ পায়না তাদের বলি ‘ফেরেশতা’ আর যাদেরটা প্রকাশ পেয়ে যায় তাদের আমরা বলি ‘পশু’।

আমার দেবরটিকে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। কখনো হালকা রসিকতা করতো না তা নয়। গায়ে মাখার প্রয়োজন মনে করিনি।

এক সন্ধ্যায় সেই দেবর এসে পাকসেনাদের আর আলবদর বাহিনীদের কাছ থেকে ঘনিয়ে আসা বিপদ সম্পর্কে কিছু জ্ঞান দিয়ে গেল। সাথে এও বললো সম্পত্তি নাকি হাত ছাড়া হয়ে যাবে। যদি বন্ধক দিয়ে রাখি তবে যুদ্ধের সময়ে সেই বন্ধকের টাকা দিয়ে চলতেও পারবো আর যুদ্ধ শেষ হলে তা নিরাপদে ফিরে পাবো নইলে আলবদর বাহিনীর কেউ সম্পত্তির লোভে একা পেয়ে ভিটে ছাড়া করতে পারে। ছেলের বাবা ফিরে এসে যদি না পায়? কোথায় খুঁজবে আমাদের? দেবরের কথায় সেদিন যুক্তি ছিল। ফেলে দেবার মতো মনে হয়নি। সেই-ই ভিটেবাড়ি বন্ধক রাখতে সাহায্য করেছিল। হ্যাঁ, বন্ধকের টাকা যা পেয়েছিলাম তাতে পরের বাড়িতে গিয়ে ঝিগিরি করতে হয়নি, কিন্তু আজীবনের বন্ধকীনামায় আটকে গেছে সেই সম্পত্তি আমার দেবরেরই কাছে। জানতে পেরেছিলাম অনেক পরে, যখন আমার গায়ে অপবাদের বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে।

সম্পত্তি বন্ধক নেবার পর এক রাতে দেবর আমাকেও নিতে চেয়েছিল তার শরীরের খোড়াক হিসেবে। ক্লান্ত, বিবর্ণ আমার উপর

ঝাঁপিয়ে পরা সেই পশুকে চিনতে আমার কষ্ট হচ্ছিল বড্ড। মেয়ে তখন আমার গর্ভে মাত্রই জানান দিচ্ছে। নিজেকে শেষ রক্ষা করতে পুরুষাঙ্গে কামড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু দেরী হয়ে গিয়েছিল। যন্ত্রণায় কুকড়ে থাকা চাচার মুখটা দেখতে পায়নি কিন্তু মায়ের বিবস্ত্র অবস্থা দেখে ছোট ছেলে ধরেই নিয়েছিল বাবার অনুপস্থিতিতে মা বুঝি ‘চাচা’ নামের মামাতো দেবরের সাথে লটকে গেছে!

টেলিভিশন দেখার সুযোগ তেমন একটা হয়না। ওটা ছেলের শোবার ঘরে রাখা। স্কুল থেকে ফিরে নাতনী এসে আমাকে খবরের কাগজটা দিয়ে যায়। সেখান থেকেই জানতে পারি আজ স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের শাস্তি হিসেবে এর ফাঁসি হয়েছে। কাল ওর ফাঁসি হয়েছে। অনেকদিন পরতো বটেই তারপরওতো বিচার হচ্ছে। বিচারের রায় হচ্ছে আর তা কার্যকরও হচ্ছে।

স্বাধীনতা বিরোধী, মানবতা বিরোধীদের অপরাধের শাস্তি হয়। কিন্তু সেই সময়ের দেশপ্রেমী, মুখোশপরা, নারী লোভী পিশাচরা বহাল তবিয়তেই রয়ে গেছে আমার মতো ভুক্তভোগীদের সামনেই। এদের কোনদিন বিচার হবেনা। আর আমার বন্ধকীনামা হয়তো বিবর্ণ হতে হতে একসময় আমার ছেলের হাতে ঠিকই পৌঁছে যাবে যার প্রয়োজন আমার বা আমার মেয়ের নেই।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত