তার অপেক্ষায়

তার অপেক্ষায়

তখন ক্লাস 12 এ পড়ি.. ভাগ্যের দোষেই হোক, আর বিধাতার ইচ্ছাতেই হোক, ক্লাস 6 এ পড়াকালীন বাবাকে হারিয়েছি.. আমি মায়ের একমাত্র সন্তান.. বড় আদরের কিনা জানি না, বাট খুব কাছের..

পৃথিবীতে কাছের বলতে এই এক মা ই আছে.. মা কোনোদিন কোনো অভাব বুঝতে দেন নি.. এক মুহুর্তের জন্যও কোনো কিছুর কমতি হয়নি আমার..

পড়ালেখাতে একেবারে খারাপও ছিলাম না.. তবে এবারেও হয়তো ভাগ্যটা ভালো নাকি খারাপ বুঝতে পারলাম না..
বিধাতার ইচ্ছাতে কোনো ভার্সিটিতে চান্স পাই নি.. দ্বিতীয়বার কোনোমতে টেনেটুনে একটা সাইন্সের সাবজেক্টে চান্স পেলাম.. মজার বিষয় এই যে, এতে না আমার কোনো আফসোস আছে, না আমার মায়ের..

ভর্তির দিন যথারীতি ভর্তি হয়ে বাসায় ফিরছিলাম.. হঠাৎ ই বাসটা এক্সিডেন্ট করলো.. বুঝতে পারছি না, ভাগ্যটা আবারও ভালো, নাকি খারাপ.. সেদিন জীবনে প্রথম বার মনে হলো, ‘হ্যা ভাগ্যটা সত্যিই খারাপ’..

ঐদিন এক মুহুর্তের মধ্যে মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো.. কয়েক মুহুর্ত পর্যন্ত আমি এই পৃথিবীতে নিজের কোনো অস্তিত্ব খুজে পাচ্ছিলাম না.. সে বছর ভার্সিটির পরীক্ষা আমার আর দেওয়া হয় নি.. আবার ফার্স্ট ইয়ারেই ছিলাম.. জীবন তার ছন্দেই চলছিলো.. একদিন হঠাৎ একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায়..

প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে রাস্তায় হাটছি.. হঠাৎ প্রচন্ড ঝড় উঠে চারদিকে অসম্ভব অন্ধকার নেমে এলো.. রাস্তায় সবাই ছোটাছুটি করে নিরাপদ স্থানে চলে গেছে.. কিন্তু আমি ঐ বাতাসকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছি.. মাটির দিকে তাকিয়ে হাটছিলাম..

সামনে মনে হয় এক বোরকা পড়া মেয়ে এসে দাড়ালো.. একবার এদিক, একবার ওদিক.. শেষমেশ ৩০ সেকেন্ড পর দুজনই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের গন্তব্যে হাটা দিলাম.. একবার পেছনে তাকালাম, তবে তার মুখটা আর দেখা হয় নি..

ঘুম ভাঙার পর বুঝলাম রবীঠাকুরের লেখা অপরিচিতার সাথে অনুপমের শেষ পর্যন্ত দেখা হলেও.. আমার স্বপ্নের অপরিচিতাকে আর দেখা হলো না..

শুনেছিলাম মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় কোনো স্বপ্ন দেখে, তখন তার রুহ্ নাকি সেখানে উপস্থিত থাকে.. সত্যি কিনা জানি না.. তবে কি সেই অপরিচিতার রুহ্ও আমাকে দেখেছে? জানিনা..

Facebook এ অনেক পোস্ট পড়েছি.. মানুষের জীবনে যখন নিজের বলতে কেউ বা কিছু অবশিষ্ট থাকে না, তখন নাকি তার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে থাকে না..

কিন্তু আমার মন বা মস্তিষ্ক, কোথাও এই না বেচে থাকার চিন্তা কখনোই আসেনি.. হয়তো আমার বলতে সত্যিই কেউ আছে.. হয়তো…

আজ ৮ বছর কেটে গেছে.. সেই পুরনো সব স্মৃতি আর সেইভাবে মাথায় ঘুরে না.. ভাগ্যের জোরেই মনে হয় আমি এ বছর রাজশাহী ভার্সিটির শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলাম.. আজ আর একা মনে হয় না.. এই তো সবাই আছে..
আজও বাসায় ফিরছিলাম.. এখন আর বাসে চড়তে হয় না.. রাজশাহীতেই থাকি.. হেটেই যাচ্ছিলাম..

হয়তো কিছু একটা না পাওয়া জিনিসকে খুব মিস করছি.. কিন্তু কি জিনিস, তা বুঝতে পারছি না.. হঠাৎ ই প্রচন্ড ঝড় শুরু হলো.. সেই স্বপ্নের মতো.. ভুলেই গেছিলাম তার কথা.. কিন্তু এই ঝড় আবারো আমার সেই অপরিচিতার কথা মনে করিয়ে দিলো.. শুধু একটু মুচকি হাসলাম.. আবার নিজ গন্তব্যে পৌছানোর জন্য হেটে চলেছি..
অন্ধকারে কিসের সাথে যেন ধাক্কা খেলাম.. অতো লক্ষ না করে হেটে চলেছি.. হঠাৎ ই কেউ যেন বলে উঠলো,

-একটু শুনুন..
প্রথমে ভাবলাম মনের ভুল.. তাই হেটেই চলেছি..
-আরে মশাই.. আপনাকেই বলছি.. (মেয়ে)
তখন সত্যিই তাকালাম,
-জ্বি বলুন..
-আপনার মুখটা একটু দেখবো.. (মেয়ে)
-কেন?

-না সত্যি বলতে আজ থেকে বহু বছর আগে এমন একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম কিনা.. তাই..
আমি শুধু অবাকই হয়নি.. রীতিমতো চুপ হয়ে গেছিলাম.. এক অপরিচিত দুটি চোখ নির্মলভাবে আমাকে দেখছে..
হয়তো তার অপেক্ষাতেই আমার হৃদয় আর মস্তিষ্ক সবসময় আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলো..
এতো কিছুর পর আমি বলে ফেললাম,
-আমি কি আপনাকে দেখতে পারি?

মেয়েটা কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো.. আমি আর ও দৌড়ে যাত্রী ছাউনির নিচে দাড়ালাম.. কোনো মানুষ নেই.. শুধু আমি আর মেয়েটা..

মেয়েটা তার মুখ থেকে নিকাবটা সরালো.. আমি তার দিকে তাকিয়েই ছিলাম.. সে হয়তো কোনো পরীর মতো সুন্দর ছিলো না.. তবে আমার চোখে সে সবচেয়ে সুন্দর ছিলো..
মেয়েটা হুট করে বলে উঠলো,

-আমি রিদ্ধি.. আজ আমার বিয়ের দিন.. আমি বাড়ি থেকে পালিয়েছি..
-আমি তুরজাউন.. তা পালিয়েছেন কেন??
-আপনার অপেক্ষাতে ছিলাম..
-মানে??

আমি আর রিদ্ধি সব খুলে বললাম একে অপরের কথা.. হয়তো সেদিনের স্বপ্নে আমাদের রুহ্ সত্যিই একে অপরের সাথে মিলিত হয়েছিলো..

আজ আমি রিদ্ধির দুই সন্তানের বাবা.. আজ আমার নিজের বাবা মা না থাকলেও, সব ফিরে পেয়েছি.. হয়তো তারই অপেক্ষায় ছিলো এ মন..

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত