অংশুমানের গল্প

অংশুমানের গল্প

রোববারের সকালে একটু বেলা করেই ঘুম ভাঙে অংশুর। এসিটা ২৪ শেই আছে, সুতরাং ঘরটা মিনি দার্জিলিং এ পরিণত; এখানেই হানিমুন চলছে ওদের। আসলে করবীর সাথে লাভ ম্যারেজটা গত পরশুই করেছে অংশুমান।

ব্যাঙ্গালোরে এসেছে বছর পাঁচেক হল, IT Sector এ এক বিদেশি কোম্পানির উচ্চপদস্থ চাকুরে। পুরুলিয়ার ঘটিব্রাহ্মন সন্তান সে, ছুটির দিনেও মন্দিরে যাওয়ার ভক্তিতে কমতি ছিল না অংশুমানের। বছর তিনেক আগে এক ভোরে সে করবীকে দেখে। সূর্যের নরম আলোতে কোনো রকম প্রসাধন ছাড়া এক অপরুপ দেব প্রতিমা মনে হয়েছিল অংশুর। তারপর থেকে ওই সপ্তাহে এক আধবার দেখা সাক্ষাৎ কয়েক মুহূর্তের জন্য, ব্যাস এটুকুই। ওদিকে বাড়িতে অংশুর মা তার রায়গঞ্জের বান্ধবীর একমাত্র মেয়ে অমলার সাথে যে বিয়ে প্রায় পাকা করে ফেলার উপক্রম। একথা জানতেই কিছু বন্ধুর সাহায্যে বিয়েটা চটপট সেরে নেয় অংশু। তারপর বাড়িতে বাবাকে ফোন করে খবরটা দেয়। যাইহোক এ খবর শুনে তারা আর কালক্ষেপ না করে আজই দুপুর ১২টা কুড়ির ফ্লাইটে চড়ে বসেছেন।
চাদরের বাইরে বের হয়ে থাকা মুখটুকুতে হঠাৎ বৃষ্টির ফোটা মত পড়তেই আধাঘুমের ম্যাড়ম্যাড়ে চোখে চেয়ে দেখলো করবী ওর দাড়ি সেভ করার ছোট্ট আয়নাটা নিয়ে কপালে সোহাগের সিঁদুর লাগাচ্ছে। আর সেই ভিজে চুল থেকেই শিশিরবিন্দুর মত জল ঝরে পড়ছে। চাদর থেকে হাতদুটো বের করে যেইনা কোমরটা ধরেছে অংশু, অমনি পাঁকাল মাছের মত শরীরটাকে হিলহিলিয়ে কপট রাগ সহ চোখ বড় বড় করে করবী ইশারা করলো অংশুকে ফ্রেশ হয়ে নিতে। পটে আঁকা সুন্দরী না হলেও, যে রূপ থেকে চোখ ফেরানো যায়না, করবী সেই সুন্দরী।

প্রাতঃরাশে পোহা মানে চিড়ের একটা পদ সাথে একটা ডিমের পোচ আর এক পেয়ালা চা। লাঞ্চের জন্য বাবা মায়ের পছন্দের সব্জি আর মাছ এনে, পাশের ফ্ল্যাটের বাঙালী সহকর্মীর বাঙালী স্ত্রী ইশানী বৌদিকে ডাকতেই, তিনি স্ব-উৎসাহে রান্নাবান্না করে দিয়ে গেলেন।

বৌদিই করবীকে একটা ঢাকাই জামদানি সুন্দর করে পরিয়ে দিয়ে গেলেন। ত্রয়োবিংশী করবীর চোখেমুখে শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস। যথা সময়ে হৈ হৈ করে অংশুর বাবা ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেলেন ওর মাকে সাথে করে। করবী শ্বশুর শাশুড়িকে টুপ করে প্রণাম করে এক্কেবারে লজ্জাবতী লতার মত ঘরের এক কোণে সরে দাঁড়িয়ে রইলো। এদিকে মা বাবার সাথে অংশু, শরীর স্বাস্থ্য, চাকুরি, এলাকা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা মগ্ন রইলো। করবী সবটাই দেখছে কিন্তু সে অংশগ্রহন করলোনা। অংশুর মাও যেন বৌমা হিসাবে করবীকে ঠিক মেনে নিতে পারছিলেন না। যাইহোক, ক্লান্ত শরীরে বাবা মা ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিতে গেলে করবীও একটু গা এলিয়ে দিল।

হঠাৎই অফিস থেকে বসের জরুরী একটা ফোনের জন্য অংশু বেরিয়ে গেল। মা বাবা, করবী তিনজনেই ঘুমাচ্ছে, ‘এই যাব আর এই আসব, অযথা জাগিয়ে লাভ কি’ এই ভেবে অংশু বেরিয়ে গেল। ঘুমভাঙা শাশুড়ি বৌমার দরজার সামনে গিয়ে অনেক ডেকেও সাড়া না পেয়ে রুষ্ট মনে বললেন-

“বাব্বা, মেয়েছেলের এতো দেমাক কেন বাবা। ছেলেটা যেন আমার নয়, টিকলে হয়!
সন্ধ্যার দিকে অংশুর সাথে ফোনে কথা বলে ওর বাবা জানলো তার আসতে লেট হবে। ওদিকে ওর মা স্থানীয় বাজারে যাবার জন্য উদগ্রীব, বিবাহ আশীর্বাদের লোকাচারের সামগ্রী কেনার জন্য। তিনি অংশুকে সে কথা বলতেই অচেনা জায়গার জন্য করবীকে সাথে নিয়ে যেতে বললেন-
” মা, আমি করবীকে মেসেজ দিয়ে দিচ্ছি। ওর সাথে চলে যাও।”

মায়ের ঠিক মনপুতঃ নাহলেও ছেলের কথাটা ফেলতে পারলেন না। তিনি বৌমার ঘরের দিকে যাওয়ার আগেই দেখেন করবী একটা শালোয়ার স্যুট পড়ে এক্কেবারে তৈরী। শাশুড়ি কোনো কথা বাড়ালেন না, চুপচাপ করবীর পিছনে অনুসরণ করলেন।

ব্যাঙ্গালোরের ভিড় রাস্তাতে করবী, শাশুড়ির হাতটা কয়েকবার ধরার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি বললেন-
“থাক, আর আদিখ্যেতা করতে হবেনা, আমিও গড়িয়াহাটে শপিং করি। গেয়ো ভূত ভেবোনা। উঁ, আমার সোনার টুকরো ছেলেটার উপরে কালাজাদু করে বস করে আবার ঢং হচ্ছে! ”

ফেরার সময় রাস্তাটা শাশুড়ি বৌমা পার হচ্ছিলেন, হঠাৎ দড়াম করে একটা শব্দ। তার পর লোকে লোকারণ্য।

আউটার রিং রোডের একটা হাসপাতালের মর্গের সামনে লাশ শনাক্ত করছে অংশু। ওর স্ত্রী করবী গাড়ি এক্সিডেন্টে মৃত। যাকে তিন দিন আগে একটি মন্দিরের অনাথ আশ্রম থেকে বিবাহ করেছিল। অংশুর মা ও কপাল চাপড়ে কেঁদে চলেছেন, ”

যদি জানতাম বৌমা আমার মুক ও বধির, আমি কি ওর হাত ছাড়তাম?”

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত