বিদেশে

বিদেশে

বিদেশে এসেছি আজ তিনমাস হয়েগেছে অথচ বাড়িতে একটা টাকাও পাঠাতে পারিনি। ছোটবোন আরিশার সাথে গত সপ্তাহ কথা হয়েছে। ওর কাঁপা কণ্ঠ থেকে যতটুকু বুঝলাম বাবা খুব অসুস্থ! মা নাকি নানুদের বাসায় গেছেন বড় মামার থেকে কিছু টাকা ধার করতে। বড় মামা অবশ্য মাটির মানুষ। পারে না আমাদের জন্য কলিজাটা দিয়ে দেয়। কিন্তু মামুনিটা আমাদের একদম দেখতে পারে না। কত আর দেখবে? তারও তো সংসার আছে, ভবিষ্যৎ আছে। মামার বড় মেয়ে আমাকে জীবনের চেয়ে বেশি লাভ করে। লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে মেয়েটি আমাকে প্রপোজ করেছিল সেই ১৫ সালে। আমি দেখতে শুনতে ওতো ভালো না। তাও কেন যে মেয়েটা আমাকে নিয়ে ভাবে জানি না।

‘এই অভি ভাই, গ্যাসটা কমিয়ে দিন। তরকারি শুকিয়ে যাচ্ছে তো!’

জসিম ভাইয়ের কথায় আমার তরকারির দিকে নজর গেলো। গ্যাসটা কমিয়ে দিয়ে শসা হাতে নিয়ে ট্যাপ থেকে পানি ছেড়ে ধুয়ে নিলাম। তারপর শসা কেটে নুডলস এর সাথে পাওয়া বাটিতে রেখে দিলাম। দেয়ালে মাথা রেখে আবারো ভাবতে থাকলাম সেই স্মৃতি!

আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষা দিচ্ছি। তখনও আমি টিউশনি করতাম। বিকালবেলার টিউশনি শেষে বাসায় ফেরার পথে ছোটবোন আরিশার জন্য ২০ টাকার চটপটি নিয়ে বাসায় আসছি। আরিশা চটপটি খুব পছন্দ করতো। ঘরে প্রবেশ করার আগে একটু শব্দ করে আরিশাকে ডাক দেই,
‘কইরে আরিশা, তোর জন্য চটপটি নিয়ে আসছি। দরজা খোল।’
আরিশা দৌড়ে এসে দরজা খুলে আর বলে,
‘ইশ এতদিন পর বোনের জন্য মায়া জন্মালো?’
‘যা তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, ঠান্ডা হয়ে যাবে।’
‘তুমি খাবা না?’
‘দে দিলে একটু খাই।’
‘আচ্ছা ভাইয়া ওয়েট কর, আমি ঠিক করে নিয়ে আসছি।’
‘যা আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি।’

হাতমুখ ধুয়ে ভাইবোন মিলে এক চামচ দিয়ে একই প্লেটে চটপটি খাচ্ছি। আরিশা নিজে একবার আমার মুখে আবার তার মুখে এক চামচ করে নিচ্ছে দিচ্ছে। আজ ঐ মুহূর্তটা খুব মনে পরে! ইচ্ছে হয় ২০ টাকার চটপটি ভাইবোন মিলে খাই।

অনার্স ২য় বর্ষে থাকতে রমজান ঈদে আমার পরিবারের সবাইকে টিউশনি থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে ঈদের পোষাক কিনে দিয়েছিলাম। ঐ ঈদটা আমার জীবনে বেস্ট ছিল। মা তো চোখের জল ছেড়ে বলেছিল, ‘তুই আমার আব্বার মতো রে!’

বৃষ্টির দিন ছিল। আমি আর আমার বোন নানু বাড়ি গিয়েছিলাম। যাওয়ার পথে খুব জোরেসোরে বৃষ্টি এসেছিল। রিক্সা থেকে নেমে ড্রাইভার সহ এক বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমার বোনের খুব ক্ষুধা পেয়েছিল। প্রায় ১ ঘন্টা ধরে বসে আছি কেউ এক গ্লাস পানি দিল না। কিছুক্ষণ পর এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ এসে বললেন, ‘ভাই কিছু মনে করবেন না। আমাদের বাসায় আপনাদের দেওয়ার মতো কিছু নেই। চালভাজা আছে যদি কিছু মনে না করেন তাহলে চালভাজা দিতে পারি।’

লোকটার কথা শেষ হওয়া মাত্র আমার বোন বলে, ‘চালভাজা তো ভীষণ প্রিয়।

একটা বাটিতে অনেকগুলো চালভাজা নিয়ে লোকটা আমার বোনের সামনে রেখে চলে গেলেন। আমার বোন গপগপ করে মুখে চালভাজা নিয়ে চিবাচ্ছে। আমার মনে হয় আমি এখনও দেখছি আরিশা গপগপ করে চালভাজা খাচ্ছে।

‘ও অভি ভাই, ডিউটির সময় তো হয়ে গেলো তরকারিটা নিয়ে আসেন খেয়ে যাই।’

জসিম ভাইয়ের ডাকে তরকারি নিয়ে গেলাম। দু’জন একসাথে খাবার খেয়ে নিলাম। জসিম ভাই চলে যাওয়ার পর ব্যাগ থেকে এলবামটা বের করে সবার ছবি দেখা শুরু করলাম। এক এক করে সবার ছবি দেখতে দেখতে একটা ছবির কাছে এসে থেমে যাই। ছবিতে আমার মামাতো বোন তিতলী হাতে একটা বাঁশের চিকন লাঠি নিয়ে আমার ছোটবোন আরিশাকে দৌড়াচ্ছে। আর তাদের সামনে দাড়িয়ে ছিল আমার আম্মু আর নানু। তাদের দু’জনের ছবি তুলতে গিয়ে ওদের ছবিও উঠে আসে।

তিতলী ছিল শ্যামবর্ণের। উচ্চতা আমার বুকের সমান হবে। মুখটা খুব মায়াবী। চোখগুলো ঠিক কেমন বর্ণনা করতে পারবো না। ওর কথার মাঝে কেমন যেন মায়া লুকানো ছিল। আমাদের ভালোবাসার সম্পর্কটা যখন ১১ মাস অতিক্রম করে, ঠিক তখনি ওর একটা বিয়ের প্রস্তাব আসে। যাইহোক তখন মামা তিতলীকে বিয়ে দিবে না সরাসরি বলে দেয়। একটু নিশ্বাস আসে। সেদিন তিতলী আমাকে বলেছিল,
‘আচ্ছা আমার যদি বিয়ে হয়ে যায়, আপনি কি করবেন?’
আমি খুব চিন্তা করেই বলেছিলাম, ‘তখন তোমাকে আমার সন্তানের মা করে নিব।’

তিতলী আমার কথায় লজ্জা পেয়ে একটা মুচকি হাসি দেয়। ইশ এখন মনে হচ্ছে যেন মেয়েটার হাসি আমার চোখে ভাসছে।

আমি যখন বিদেশে আসি, তখন মামার সাথে একদিন গোপনে কথা হয়েছিল। মামাকে বলেছিলাম আমি তিলীকে বিয়ে করবো। মামা একটা হাসি দিয়ে বলেছিলেন যদি সত্যি হয় তাহলে মামার মতো খুশী আর কেউ হবে না। সেদিন মামাকে একবার বুকে নিয়েছিলাম। আমার ডান চোখে একফোঁটা জল নেমেছিল সেদিন। এখনও মনে আছে, মামা ঐদিন ব্লু একটা শার্ট পরেছিলেন আর আমি পরেছিলাম আকাশি কালার শার্ট।

বিদেশে আসার দু’মাস পরেই মামুনি তার ছোটবোনের ইটালি থেকে আসা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। তিতলী কল দিয়ে খুব কেঁদেছিল আর আমি চুপ করে শুনেছিলাম। মামাকে কল দিয়েছিলাম। মামা শুধু দু’টি বাক্য বলেছিলেন, ‘তোর মতো ভালো ছেলের কপালে আমার মেয়ে নেই বাবা। তুই মাফ করে দিস বাবা!’

আসলে মামার কোনো দোষ ছিল না। দোষ ছিল ভাগ্যের। অসম্ভব ভালো একটা মেয়ে ছিল সে। তিতলী বলেছিল আমি যদি বলি সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিবে কিভাবে বাঁচবে তার কিছুই সে জানে না। সে জানে যেভাবে হোক আমাকে তার লাগবে। তার বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত আমাকে তার লাগবে!

খুব ভয়ানক ছিল তার কথা। খুব করে চেষ্টা করেছিল মেয়েটা। আমি কিছুই করিনি।

আজ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ। কাজ পাচ্ছি না। বাসায় টাকা দিতে পারছি না। বাবার কষ্ট দূর থেকেও উপলব্ধি করতে পারছি। কিন্তু কিছুই করতে পারছি না। ইচ্ছে হয় দেশে চলে যাই। কিন্তু তাও পারছি না।

‘এই অভি। তোর জন্য কাজ ম্যানেজ করছি রে। কই তুই এখনও ঘুমাস নাকি?’
বড় গলায় চিৎকার দিয়ে মুখে হাসি নিয়ে বড় কাকার ছেলে আমার কাছে আসছে আর বলছে। আমি মুখে কিরকম হাসি নিয়ে যেন কাশিম ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সত্যি বলছেন ভাই?’
কাশেম ভাই বুকে বুক মিলিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ রে, সত্যি কইছি!’

বেতন আর কাজ সম্পর্কে নাই বললাম। আমরা যারা প্রবাসী তারা অনেক কষ্ট সহ্য করতে পারি। অনেক অভিনয় করতে পারি। আপনাদের মুখে মুঠোফোনে শুনতে চাই আপনারা ভালো আছেন কিনা? টাকা পাঠিয়ে জানতে চাই সব ঠিকঠাক চলছে তো? না হয় সামনের মাসে ওভারটাইম করে আরো বাড়িয়ে দিব।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত