জীবন

জীবন

জীবনের অনেকগুলো বসন্ত অতিক্রম করা এই মানুষটির বয়স হিসেব করা হয় না বছরে, হিসেব করা হয় না মাসে, হিসেব করা হয় না দিনে … হিসেব করা হয় প্রতিটি দিনের প্রতিটি মূহুর্তে । পৃথিবীর দু’শ্রেণীর মানুষের বয়স হিসেব করা হয় মূহুর্ত গুণেঃ
> যাদের জীবনের প্রতিটি মূহুর্তই মূল্যবান
> যাদের জীবনের প্রতিটি মূহুর্তই যন্ত্রণার
আমিনুল ইসলাম তাদেরই একজন ।
.
কোনো এক স্নিগ্ধ প্রভাতে চোখ পড়লো চৌকিতে বসে এক ধরনের গোঙানি শব্দ করা আমিনুল ইসলামের দিকে । উত্তর পাবো না জেনেও হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম “কেমন আছেন ?” । পাশ থেকে তার বৃদ্ধা মা বললেন, “ও ভালো আছে, বাবা” । সত্যিই কি ভালো আছে আমিনুল ? ভালো বা খারাপ যাই থাকুক না কেনো নিজ মুখে আমিনুলের কথা বলার কোনো ক্ষমতা নেই । নির্দিষ্ট সময় পর পর সে মুখ হা করে এক ধরনের গোঙানি শব্দ করছে । এমন শব্দ করে সে কি তার অস্বস্থির জানান দিচ্ছে নাকি এমন শব্দ করতেই সে অভ্যস্ত তা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না তবুও হাসিমুখে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে । খানিকক্ষণ পর পর তার মুখ থেকে লালা পড়ছে আর অমনি তার মা (প্যারালাইজড হয়ে যার শরীরের বা পাশটা অবস হয়ে গেছে) ডান হাত দিয়ে তার বিকলাঙ্গ সন্তানের দুর্গন্ধময় লালা মুছে দিচ্ছেন নিজের পরনের কাপড় দিয়ে (এজন্যই বোধহয় মমতাময়ী শব্দটা শুধু মায়ের সাথেই হয়) । আমিনুল মুখ হা করেই রইলো … চোখে পড়লো তার দাঁতের উপর হলদেটে রঙের আস্তরণ আর জিহ্বার উপর বেশ পুরুত্বের ময়লা আস্তরণ । নাক আর বগলের লোমগুলোও বেড়েছে বেশ । খানিকক্ষণ পর পর সে তার বাম হাতের আঙুলগুলো দিয়ে নাক পরিষ্কারের ব্যর্থ চেষ্টা করছে । জীবনের এতোগুলো বছর ধরে সে এই চেষ্টা করে খুব একটা সফল হতে পেরেছে বলে মনে হলো না কারণ তার হাতের আঙুলগুলো অস্বাভাবিকভাবে বাঁকা, হাত দুটোর কার্যক্ষমতাও নেই বললেই চলে । কার্যক্ষমতাহীন পা দুটোও অদ্ভুত রকমের বাঁকা ।
.
অন্যান্য সবার মতো দৈনন্দিন জীবনের ইচ্ছেগুলো পূরণ হয় না আমিনুলের … চাইলেই সে বলতে পারে না তার খুব কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে, চাইলেই সে প্রিয় কোনো জিনিস নিজ হাতে ধরে দেখতে পারে না, চাইলেই সে বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলতে পারে না, চাইলেই সে ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুদেরকে কাছে টেনে একটু আদর করতে পারে না, চাইলেই সে সবাইকে বলতে পারে না, “আমি তোমাদের বোঝা হতে চাই না, আমি তোমাদের করুণার পাত্র হতে চাই না, আমি নিজের মতো করে বাঁচতে চাই” ।
.
হয় না, এমন চাওয়া পাওয়াগুলো আমিনুলের পূরণ হয় না । যার প্রতিটি সূর্যোদয় হয় করুণায়, যার প্রতিটি সূর্যাস্ত হয় করুণায় তার অমন চাওয়া পাওয়াগুলো কখনো পূরণ হয় না ।
.
আমিনুল আমার আপনার মতোই একজন মানুষ তবুও সে আমাদের মতো খুশিতে হাসতে পারে না, কষ্টে কাঁদতে পারে না । আচ্ছা, তার কী মন আছে ? সেই মনে কি কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে বিভোর হবার অধিকার আছে ? হয়তো নেই, অমন লাঞ্চনা-বঞ্চনা আর করুণার জীবন যার তার ঐ অর্থহীন কল্পনার কী ই বা মূল্য আছে । বাস্তবিক জগতে নিজ ক্ষমতায় যার দু’কদম হাটার ক্ষমতা নেই, কল্পনার জগতে তার অনুপ্রবেশ নিষেধ, কড়াকড়িভাবে নিষেধ ।
.
সময় আমাদের যতোই খারাপ যাক না কেনো আমরা ভালো আছি, বেশ ভালো আছি ।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত