ভ্রান্তি

ভ্রান্তি

“খোকা! খোকা! আমারে মাইরা ফেলল তোর পোলা! খোকা!” “কী হয়েছে মা?” আমি দৌড়ে এলাম মায়ের রুমে। আমার ৫ বছরের ছেলে প্রত্যয়কে দেখলাম দাদীর পাশে বসে দিব্যি রংপেনসিল দিয়ে রং করছে খাতায়। যেন কিছুই হয় নি। “কী হয়েছে মা?” আমি নরম গলায় আবার শুধোলাম। “তোর পোলা পেনসিল দিয়া আমার চোখ গাইলা দিতে লাগসিল। এইডা কী বিচ্ছু রে?” আমি আহত হলাম মনে মনে, নিজের ছেলে সম্পর্কে নিজের মায়ের কাছ থেকে এসব শোনা খুব সুখকর কী করে হতে পারে?

“তুই অরে নিয়া যা। আমার ডর করতাসে” আমি আবারো আহত হলাম। কিছু না বলে প্রত্যয় কোলে করে নিয়ে আসলাম। সকালবেলায় উঠেই স্নান করা সুস্মির অনেক দিনের অভ্যাস। আজও ব্যতিক্রম হয় নি। বারান্দায় ভেজা চুল খুলে দাঁড়িয়েছে, স্নানসিক্ত সে চুলে অন্যরকম নেশা জাগে। “আমার মনে হয় মাকে একবার সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার” মৃদু স্বরে বলল সুস্মি।

আমি কিছু বললাম না। আমার মাকে আমি প্রচণ্ড রকম ভালোবাসি, বাসব না-ই বা কেন? মা যে কত কষ্টে আমাকে একটা অবস্থানে তুলেছেন তা দুনিয়ার আর কে জানবে। আগে মা গ্রামের ভিটায় থাকত। আমার প্রমোশন হয়ে আয় বেড়ে এই ফ্ল্যাটটা নেওয়ার পর মাকে নিজের কাছে নিয়ে আসি। প্রথম প্রথম সুস্মি মাকে মেনে নিতে অস্বস্তিবোধ করত। মাঝে মাঝেই মায়ের সাথে খোঁটাখুঁটি লাগত ছোটখাট রকমের। সুস্মি আমায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দু’একবার বলার চেষ্টা করেছে যে মাকে বৃদ্ধশ্রমে দিয়ে আসতে। কিন্তু আমি অত্যন্ত সহজ ভাষায় বলেছি, “মা এখানে থাকবে। তার ছেলের বাসা, তার পূর্ণ অধিকার”। তারপর হঠাৎ করেই সুস্মির খোঁটাখুঁটি বন্ধ হয়ে গেল। মায়ের সাথে খুব মানিয়ে চলতে লাগল।

সুস্মির সঙ্গে আমার সুদীর্ঘ সাত বছরের সম্পর্কের পর বিয়ে হয়। অনেকটা উপন্যাসের মতো শোনালেও এটা সত্যি। তাই যখন সুস্মি আর মায়ের বনিবনা হতো না, তখন আমার খুব কষ্ট হতো। কারণ দুজনই আমার মনে দুরকম ভালোবাসার রাজত্ব নিয়ে আছে। আমার জবাব না পেয়ে আবার বললো সুস্মি,

“শান্ত, প্লিজ মাকে একবার সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবে?”
“কেন? মা কী করেছে?”

“এই যে ছোট্ট ছেলেটাকে কীভাবে কীসব বলে। সেদিন তুমি ছিলে না বাসায়, মা চেঁচাচ্ছিল প্রত্যয় নাকি ছুরি দিয়ে উনার গলায় ধরার চেষ্টা করছিল। উনি ওকে ‘খুনি’ পর্যন্ত বলে ফেললেন!” “আচ্ছা দেখি। কাল পরশু একবার নেব মাকে” আমি প্রথমে মাকে ভুলভাল বুঝিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়েছিলাম। কিন্তু ডাক্তারের বিভিন্ন প্রশ্ন শুনেই উনি বুঝে ফেললেন তাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আনা হয়েছে। মা সরাসরি কিছু বললেন না কিন্তু তার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। বাসায় ফেরার পথে মা বলল

“খোকা”
“হুমম মা”
“আমি তোদের খুব যন্ত্রণা করতেছি না রে?”

“না মা, এ কথা মুখেও আনবে না। তুমি আমার ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলেও আমি রাতে এসে বলব মা ভাত খাইয়ে দাও” মা হেসে ফেলে অন্যদিকে মুখ ফেরালেন। আমার ক্ষীণ সন্দেহ হলো তিনি কান্না আড়াল করলেন। কিছুদিন যাবৎ আমার অফিসে কাজের অনেক চাপ যাচ্ছে। আজ হঠাৎই কাজ চাপ একটু কমাতে মুক্তি পেলাম। একটু দ্রুতই বাসায় ফিরে কলিংবেল না টিপে দরজার নব ঘোরালাম। আমাদের ফ্ল্যাটটি যে অ্যাপার্টমেন্টে তার সিকিউরিটি খুউব ভালো। তাই দরজা লাগানো আছে কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় না। একারণে নব ঘোরানোর পর দরজা খোলা পেয়ে অবাক হলাম না। ভাবলাম রান্নাঘরে গিয়ে পেছন থেকে সুস্মিকে জড়িয়ে ধরে সারপ্রাইজ দেব। কিন্তু ডাইনিং রুম থেকে দেখলাম সুস্মি খুব মনোযোগ দিয়ে ছেলেকে কী যেন বোঝাচ্ছে। চুপচাপ একটু এগিয়ে গিয়ে শুনার চেষ্টা করলাম মা ছেলেতে কী আলাপ হচ্ছে।

“তারপর তোমার দাদু চিৎকার করা শুরু করলেই তুমি নরমাল হয়ে যাবে। আর কাঁটাচামচটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলবে। তোমার বাবা যেন না দেখে। তবে তোমার দাদু চিৎকার না করা পর্যন্ত খোঁচাবে” “দাদুর হাত যদি কেটে যায়?” “কাটলে কাটবে, বাট তুমি কেয়ারফুলি–” আমি আর শুনলাম না। সাত বছর সম্পর্কের পর বিয়ে হয়ে বাচ্চা হয়ে তার বয়স ৫ হবার পর বিশ্বাসের পাহাড়টা হিমালয় সমান উঁচু হয়েছিল। কিন্তু সে বিশ্বাসটা যে নিরর্থক তা বুঝতে ভুল হলো না। এ কোন পিশাচিনী? রাত ১১:৩০। নিস্তব্ধ হয়ে এসেছে চরাচর। প্রত্যয় ঘুমুচ্ছে। সুস্মি নাইটড্রেসে আমার পাশে শুয়ে পড়লো।

“জানো, আজকেও মা প্রত্যয়কে-” “আমি জানি” “জানো? কীভাবে? মা আবার তোমার কাছে প্রত্যয়কে খুনিটুনি বলেছে? তোমাকে সে-ই কবে বলেছিলাম বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসতে” “তুমি এতটা নৃশংস? আমার মাকে সহ্য হচ্ছে না বলে নিজের ছেলেকে শিখিয়ে শিখিয়ে আমার কাছে মাকে পাগল প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলে। যেন তাকে তাড়িয়ে দিই? এই তোমার ১২ বছরের ভালোবাসা? যার তলায় পুরোটাই ময়লার স্তূপ। আমার মাকে যে এমন করতে পারে, সে আর যে হোক, আমার স্ত্রী হতে পারে না। অসম্ভব!”
সুস্মির গোলগাল মুখটা ছাইবর্ণ হয়ে গেল। কী একটা বলতে গিয়েও আটকে গেল।

আমি খাট থেকে নেমে গিয়ে ড্রয়ার খুলে ডিভোর্সের কাগজগুলো বের করে ওর সামনে রাখলাম “শান্ত, তু-তুমি! এটা-এটা পারো না” “দেখতেই পাচ্ছো পারি” কঠিন গলায় বললাম। সুস্মির সাথে ডিভোর্সের পর আমি প্রত্যয়কে নিজের কাছে রেখে মানুষ করি। এর প্রায় বছর সাতেক পর মা চলে যান চিরদিনের মতো। আমার ছেলেটা খুব সহজ সরল হয়েছে। সবচেয়ে আগে দরকার ভালো মানুষ হওয়ার, সেটা সে হবে বলেই আমি আশা করি। মাঝে মাঝে বাপবেটায় মিলে রাতে ছাদে চলে যাই।

“আব্বু, দাদু কি আসলেই স্টার হয়ে গেছে? আমি তো শুনেছি স্টার অ-নে-ক বড় হয়। দাদু এত বড় হয়ে গেছে?”
আমি আটকে যাই। এই আটকে যাওয়াতেও আনন্দ। ছেলেটা বড় হয়ে যাচ্ছে, ছেলেভোলানে কথার পেছনে যুক্তি দিচ্ছে। শুনেছি সুস্মি নতুন বিয়ে করেছিল বছরখানেক আগে। আমার কোন আক্ষেপ নেই। মাঝে মাঝে  অন্তঃসারশূন্য সেই ভালোবাসার কথা ভেবে অবাক হই। কোন কোন দিন বাপ ছেলেতে গল্প করতে করতে রাত গভীর হয়ে যায়। প্রত্যয় ঘুমিয়ে পড়ে আমার পাশের চেয়ারে। তখন একা একাই তারা দেখি আর কথা বলি দুজনের সঙ্গে। স্টার হয়ে যাওয়া মা আর ঘুমন্ত প্রত্যয়। মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে যায়।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত