এই হলো নারী!

এই হলো নারী!

বিয়ের আগে জান্নাতকে আমি বার বার বলেছিলাম, “আমাকে বিয়ে করো না। জীবনেও স্বচ্ছলতার মুখ দেখতে পাবে না। তোমার কোনো শখও পূরণ হবে না। আর এটাও ভেবো না, তোমাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আমি এসব বলছি! যা বলছি তোমার ভালোর জন্যই বলছি।”

সে হাসতে হাসতে বলেছিলো, “থাক আমার ভালো তোমাকে দেখতে হবে না। মাস্টার্স পাশ করা একটি মেয়ে নিজের ভালো-মন্দ বুঝে। আমি জানি তো, তোমার অবস্থা আমি জানি।”

“তুমি জানলে কি হবে তোমার মা-বাবা তো জানেন না।”

“ওসব তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি আমার বাড়ী সামলাবো। তুমি প্রস্তাব পাঠাও। একটা নাকফুল কিনতে পারবে তো? কিনতে না পারলেও সমস্যা নেই। একদিনের জন্য ভাড়া নিলেও হবে। আচ্ছা, নাকফুল কি ভাড়া পাওয়া যায়!?”

যে মেয়ে চরম বাস্তবতায় মশকরা করতে পারে, সে মেয়েকে বাস্তবতার জ্ঞান দেওয়া অর্থহীন। আমিও হাসতে হাসতে বলেছিলাম “পারবো, নাকফুল কিনতে পারবো।”

বউয়ের গহনা বলতে ঐ নাকফুলই। আজ পর্যন্ত আর কোনো গহনা দিতে পারিনি। ওর খালি কানের দিকে যখন তাকাই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। একজোড়া কানের দুল কেনা খুব জরুরী। একটু একটু করে একবার টাকাও জমিয়েছিলাম। হঠাৎ মা’র চোখের সমস্যা বেড়ে গেলো। জান্নাত বললো, “যেটা বেশি প্রয়োজন সেটাই আগে। কানের জিনিস পরেও হবে। আগে মা’র চোখ অপারেশনের ব্যবস্থা করো।”

গত রোজার ঈদে বাড়ীর বাজার সেমাই, চিনি যা যা লাগে কম-বেশি করে কেনাকাটা শেষে মা-বাবার জন্য কেনাকাটা করলাম। আমার জন্য কিছু প্রয়োজন নেই। শাশুড়ি পাঞ্জাবি দিয়েছেন। জান্নাতের জন্য একটি শাড়ী কিনবো বলে যখন মনস্থির করলাম, তখন সে বললো, “মা’র ঔষুধ শেষ। আগে ঔষুধ নিয়ে এসো।”

ঈদেও বউকে যদি কিছু দিতে না পারি তাহলে আমি কেমন দায়িত্বশীল! মনের খচখচানি দূর হচ্ছিলো না কিছুতেই। এক বন্ধুর কাছে টাকা ধার চাইলাম। সে দিতেও চেয়েছিলো। কিন্তু ঈদের দু’দিন আগে অ্যাকসিডেন্ট করে সে হাসপাতালে পড়ে রইলো। হাসপাতাল বন্ধুকে দেখতে গেলাম। বন্ধুর কাছে ঘন্টাখানেক বসেও ছিলাম। কিন্তু অসুস্থ বন্ধুকে টাকার কথা বলতে পারিনি।

জান্নাতের জন্য ঈদে কিছু কেনা হয়নি। ত্রিশ টাকার একটা মেহেদী আর পনেরো টাকা দিয়ে একপাতা লাল টিপ। এই ছিলো জান্নাতের ঈদ বাজার!

সেই মেহেদী আর টিপ পেয়ে জান্নাত কি যে খুশি! রাত জেগে সে হাতে মেহেদী দিলো। সকালে আমাকে তা দেখালোও। খুব খুশি মনে হচ্ছিলো তাকে। সত্যিই কি সে খুশি? নাকি আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য, ভালো রাখার জন্য হাসি-খুশির ভান করছে? ভয়ে ভয়ে তার চোখে তাকিয়েছিলাম। মুখ মিথ্যে বলে, চোখ বলে না। ওর চোখে কোনো কপটতা দেখিনি সেদিন।

এই তো কয়েকদিন আগে আমার বন্ধু সুস্থ হয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলো। বকাবকি করলো খুব। “তুই আসলেই একটা আবাল! সেদিন ওতোক্ষণ ধরে ছিলি, অথচ একবারও টাকার কথা স্মরণ করে দেসনি। এই নে টাকা, ধর।”

সেই টাকা দিয়ে বউয়ের জন্য একটা শাড়ী এনেছি সেদিন। শাড়ী পেয়ে রাগ এবং খুশি দু’টোই দিখিয়েছে বউ। “এখন শাড়ী কি এমন জরুরী যে টাকা ধার করতে হবে? ধার করতে হয় করবে, তবে গুরুত্বপূর্ণ কাজে। অকারণে নয়।”

“আচ্ছা।”

“কতো নিয়েছে?”

তিনশত টাকা কম বললাম। “এক হাজার দুইশ’।”

“বলো কি! ছয়- সাতশ’ টাকা দিয়েও অনেক ভালো শাড়ী পাওয়া যায়। বেহিসাবি খরচ করলে হবে? সামনে আবার ঈদ না। কোরবানিতে একটা ভাগ দিতে হবে। কতো খরচ!”

“চিন্তা করো না তো, সব হবে। এখন বলো তোমার পছন্দ হয়েছে?”

জান্নাত হাসলো। কি নিষ্পাপ হাসি! “দেখতে হবে না, পছন্দটা কার! এখন একবার পড়ি, হ্যাঁ। তারপর রেখে দিই। ঈদে বের করবো।”

বুঝাই যায় সে আগামী ঈদের খরচ বাঁচার চেষ্টা করছে। সংসারের জন্য, আমার জন্য যে এতো কিছু ভাবে, কি করে বলি সে কথা রাখেনি। বিয়ের আগে সে বলেছিলো, “অর্থের অভাব আমি মেনে নিতে পারবো, কিন্তু ভালোবাসার অভাব মেনে নিতে পারবো না। দামী শাড়ী, গহনা আমি চাই না। একজন স্ত্রীর কাছে তার স্বামীর ভালোবাসাই সবচে’ দামী অলংকার, স্বামীর ভালোবাসাই সবচে’ বড় স্বচ্ছলতা।” জান্নাত আগে যেমন ছিলো, এখনো তেমনই আছে।

মধ্যরাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দেখি বউ আমার পা টিপে দিচ্ছে। পা টিপে দেওয়া, কোমরে মালিশ করা, মাথায় তেল দেওয়া, চুল টেনে দেওয়া এসব সেবা-যত্ন বউয়ের কাছে পেয়ে আমি অভ্যস্ত। নিষেধ করি, কিন্তু মানে না। “মাঝরাতে কি শুরু করলে বলোত! এসো, শুয়ে পড়ো।”

“সারাদিন এতো পরিশ্রম ক্লান্তি তো আসবেই। শরীরের ব্যথায় কাতারাচ্ছিলে গো। গায়ে জ্বরও আছে।”

“ঠিক হয়ে যাবে। এসো তো তুমি, ঘুমোও।”

“এই আর একটু” বলেও সে অনেক সময় লাগিয়ে দিলো। তারপর শুয়ে পড়লো। কিন্তু এপাশ-ওপাশ করা দেখে বুঝলাম স্বস্তি পাচ্ছে না। “কিছু বলবে?”

“হুম। কয়েকদিন থেকেই ভাবছি তোমাকে একটা কথা বলবো।”

“বলো।”

“তোমার ঐ পাঞ্জাবিটার কথা মনে আছে?”

“কোন পাঞ্জাবি?”

“ঐ যে, রোজার ঈদে মা তোমাকে যেটা দিয়েছিলো। ঈদের দিন কতো খোঁজাই না খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও পাইনি। শেষে পুরানো একটা পাঞ্জাবি পড়ে তোমাকে মাঠে যেতে হয়েছিলো।”

“হুম, কি হয়েছে তার?”

“সেদিন নতুন শাড়ীটা রাখতে গিয়ে দেখি সেই পাঞ্জাবি! আশ্চার্য! কোত্থেকে এলো?”

“কি বলো, পাঞ্জাবির পা আছে নাকি! ওখানেই ছিলো, কিন্তু তুমি সব জায়গায় খুঁজেছো ওখানে হয়তো খোঁজনি।”

“নাহ্। তা কি করে হয়? খুঁজেছি।”

আমি এমন একটা ভাব করলাম যেন প্রচন্ড ঘুম পেয়েছে। তারপর বউকে কাছে টেনে বললাম, “পাওয়া যাচ্ছিলো না, পাওয়া গেছে এটাই বড় কথা। চোখের দেখায়ও অনেক সময় ভুল হয়। এসব তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে, ঘুমোও।”

ঘুম জড়ানো গলায় “আচ্ছা” বলে জান্নাত চোখ বন্ধ করলো। আমি মনে মনে বললাম, “বউ, যার স্ত্রীকে ঈদের দিনেও পুরানো কাপড় পরিধান করতে হয়, তার নতুন কাপড় পরিধান করে ঈদ উদযাপন করার ইচ্ছে না-ও হতে পারে!”

এই হলো আমার স্ত্রী জান্নাত! এই হলো নারী!

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত