ছাত্রী

ছাত্রী

এই পিচ্ছি টাকে কোনভাবেই পড়ানোর ইচ্ছা আমাদের কারও ছিলোনা। অন্য সবায় বলে দিলো কোচিং এ বাচ্চাকাচ্চা এলাও না। আর যে এই কাজ করবে সে নিজ দায়িত্বে পড়াবে। কথাগুলো অন্য সব টিচার কড়া গলাতে বলল। কারণ বাচ্চাকাচ্চা পড়ানো খুব ঝামেলা এক কাজ। তবুও পিচ্ছির মা এসে আমাদের এমন করে রিকুয়েস্ট করল যে কেউ আর না করতে পারলো নাহ। শেষ আমাকে আরও বেশি করে রিকুয়েস্ট করলো। আমি সবার সাথে কথা বলে ঠিক করলাম ওকে ঠিক আছে।

পিচ্ছির নাম জানলাম লতা। প্রথম ক্লাস থাকতো অন্য স্যারের মানে শাওনের ও যখন ক্লাসে এসে পড়তে বলছিলো মেয়ে একদম চুপ। শাওন রেগে গেলেও চুপ থাকলো। আবার ক্লাসে এলো তাজবীর তখনো চুপ। তারপর আমি অনেক চেষ্টা করেও কথা বলেনা। অনেক হাসায় মেয়ে হাসেনা। তারপর সুজন ও এসে রেগেমেগে ছুটি দিলো আর আমাকে ঝাড়ল একটু।

পরেরদিন আবার সেইম কেস। মেয়ে কথা বলেনা। ৫ বা ৭ দিন যাবার পর ওর আম্মাকে বললাম — কাকী এভাবে হবেনা! আপনি ওকে বাসায় পড়ান। কাকী কিছুটা রাগ নিয়ে ওকে বাসায় নিয়ে গেল। তারপর অনেক পিচ্ছি পড়াতে চেয়েছিলো গার্ডিয়ান কিন্তু সব স্যার বলতো “নাহ”

একদিন দুদিন আমাদের কোচিং এ একটা অভ্যন্তরীণ সমস্যা দেখা দেয়। এজন্য আমাদের কোচিং টা গুটিয়ে নিতে হয়। যদিও শেষ ৩ মাস আমি একা করেছিলাম। তখন আমার সকাল কাটতো প্রচুর আনন্দে। কারণ আমি অন্যান্য স্টুডেন্ট এর সাথে এতো মজা করতাম যা বলা বাহুল্য। শেষ ওরা আমাকে শেরা শিক্ষক উপাধি দিয়েছিলো। আমাকে নিয়ে ওরা কিসব হাবিজাবী লিখত। বেশ ভালো লাগতো তখন।

এরপরে আমরা সবায়বায় নিজের মতো থাকা শুরু করলাম। টিউশনি আর করব না ভেবে নিলাম। কারণ একটা ঝামেলাপূর্ণ কাজ। আমি গ্রামে সবার কাছে বেশ ভদ্র একটা ছেলে। আর স্যার হবার কারণে বেশ সম্মান পেতাম তখন। আমার স্বপ্নের কোচিং চলে গেলো আর আগের মতো সম্মান ও। এখনো আছে তবে আগের মত নাহ।

ওই যে পিচ্ছির কথা বলছিলাম! ওর আম্মা আজ এক বছর পর আবার আমাকে বলল তার মেয়ে কে পড়াতে। যে কথায় বলেনা পড়াবো কিভাবে? ওর আম্মা আমাদের বাসায় এলে ওর আম্মার পেছনে যেয়ে লুকাই।

প্রথমদিন পড়তে এলো ওর আম্মার সাথে ছাড়া রুমেই ঢুকবে নাহ। তারপর এসে আবার চুপচাপ যেন কথায় বলবেনা। আমার রাগ হলেও পড়াতাম। এভাবে ওর আম্মার পক্ষে আসা অসম্ভব প্রায়। তারপর ওর ভাইয়ের সাথে আসতে শুরু করলো।

ভেবে নিলাম এভাবে কাজ হবেনা। আগে ওর সাথে মিশে যেতে হবে আমাকে। মেয়েটা আমাকে জমের মতো ভয় পায়। এই ভয় আমাকে দূর করতে হবে। তখন বানিয়ে ছানিয়ে একটা গল্প বলতাম মেয়েটা হাসত। আস্তে আস্তে ফ্রী হতে শুরু করলাম। এখন মেয়েটা আমাকে আর আগের মত ভয় পায়না। তবে এতো মিথ্যা কথা বলে ৯৬% তার মিথ্যা কথা।

ওর একটা ব্যাপার আমার অনেক ভালো লাগে ওর মাথায় অনেক বড় বড় চুল। মাত্র ক্লাস ওয়ানে পড়ে অথচ এতো বড় চুল বানিয়েছে। ওর যখন লিখতে দেয় তখন ওর চুল গুলো মুখের উপর আসে আর বাড়বার বিরক্ত হয়ে চুলগুলো কানে গুঁজে দেয় ওই দৃশ্য খুব ভালো লাগে আমার। দেখতে অনেক সুন্দরি তবে চুলের জন্য ঠিক পুতুলের মতো লাগে। একটা ছোট্ট পুতুলের দেখতে যেমন অনেক সুন্দর লাগে লম্বা চুলে ওই রকম।

এখন এতো বকবক করে যে আমার আর ওর কথা শুনলে বোঝা যাবে…
আমি– এই ৪ লাইন লিখো….
লতা– তাহলে ছুটি?
— হুম সব লেখা শেষ করো।
;- দুইটা লিখলে ছুটি?
— না সব লিখবা।
— জানেন কালকে আমাদের বাড়িতে চোর আসছিলো।
;- আমি লিখতে বলেছি।
— সব চুরি করে নিয়ে গেছে।
— কথা বলতে নিশেধ করেছি।
— কথা বললে কী হয়?
— তোমাকে আমি বলেছি ওই লেখাগুলা চুপচাপ শেষ করো। না হলে বেত দিয়ে মারব।
— আপনার কাছে তো বেত নেই।
— স্কেল দিয়ে মারবো।
— স্কেল আনিনি।
— লেখা শেষ করো। আর একটা কথা বললেই আরও বেশি লিখতে দেবো।
— আচ্ছা এই এক লাইন লিখলে ছুটি হ্যা?
— কথা বললেই কাজ বেশি দেবো।

শেষ ছাত্রী চুপচাপ এক মিনিট থেকেই আবার বকবক। পিচ্ছিটা এতো কথা কিভাবে পায় আমি বুঝিনা। কথা বলা শুরু করলে রাজ্যের গল্প তার কাছে।

আমি– আজকে তাড়াতাড়ি লেখো। আমি পড়িয়ে ঘুমাব।
— রাতে ঘুমাননি…
— চুপচাপ লেখো।
– আমি সারারাত পড়েছি জানেন। আপনার থেকে বেশি!
— হুম! এখন কাজ করো।
– তাহলে আজকে ছুটি?
— উফফ চুপচাপ থাকতে পারোনা! এতো কথা বলো কেন তুমি…
— আপনি ঘুরতে যাবেন আজকে?
— নাহ! ঘুমাব!
— তাহলে আজকে ছুটি?

মজার ব্যাপার এতদিন পড়ালেও আজও ওর মা একটা টাকাও দেয়নি আমাকে। তাতে অবশ্য আমার খারাপ লাগেনা প্রায় ৩ মাস পড়াচ্ছি!! তবে পিচ্ছিটা এতো বকবক করে যে আমার ভালোই লাগে। আমি সারাদিন রুমে শুয়ে একা কাটাই তবে যখন পিচ্ছিটা এসে বকবক করে তখন আমার এক প্রকার ভালো লাগা কাজ করে। মাঝেমাঝে আমিও ওর সাথে একদম মিশে যেয়ে সব গল্প করি। আমি ক্লান্ত হলেও আমার ছাত্রীর গল্প আর যেন শেষ হয়না।

এতো পিচ্ছি মেয়ে এতো পাকনা কিভাবে হয়। নানান বিষয় আমাকে জানায়। তাদের গাছে ফুল ফুটেছে। গরুব বাছুর হয়ছে। মুরগি ডিম দিছে। আজকে খেলতে যেয়ে পড়ে গেছে। সে নানান গল্প…

আমি মাঝেমাঝে মিটমিট করে হাসি ওর কথাবার্তা শুনে…

আমার একাকী নিশ্চুপ দিনে একজন বকবক সঙ্গী বেশ জমিয়ে তোলে আমার ঘরটা তখন কিন্তু মন্দ লাগেনা।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত