অভিনয়

অভিনয়

দীর্ঘ সাত বছর পর প্রথম বার মা হবে মেঘলা।এতো খুশি জীবনে ও আর পায়নি।সবাই যখন সব আশা ছেড়ে দিয়েছিল তখন এই সুখবর।কত যে ডাক্তার কবিরাজ উপোস জপ দান একটা সন্তানের জন্য মেঘলা করেছে এই সাত বছরে।সবাই তো ও কে বাজা নারী হিসেবে ধরেই নিয়েছিল।

কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরে ও দেখছে যে ওর শ্বশুর এবং স্বামী কথায় কথায় শুধু বলছে যেন ওর প্রথম সন্তান যেন ছেলেই হয়।কেউ যদি বলছে যে , তোমার বৌমা কে দেখে তো মনে হচ্ছে মেয়ে হবে।

শ্বশুর মুখ কালো করে বলছে, আমাদের বংশের সবার প্রথমে ছেলেই হয়েছে। আমার খোকার ও তাই হবে।

স্বামী ওর পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলছে, এতবছর পর আমার বাচ্চা আসছে।ছেলেই হবে।
“যদি মেয়ে হয়, দেখো আজকালকার সময়ে ছেলে মেয়ে সবাই সমান। আমি তো একটা সুস্থ সন্তানের মা হতে চাই।”
মেঘলা হাসি মুখে বলে।

দেখো এতদিন পর বাচ্চা হবে, অনেক সাধ‍্য সাধনার পর। এরপর আর নাও হতে পারে। ছেলে হলেই আমাদের জন্য ভালো।

বিরক্ত হয়ে বলে রবি, ওর স্বামী।

মনে মনে ভয় পায় মেঘলা।যদি মেয়ে হয়, কি করবে ও। কিভাবে সব সামলাবে। দিন যত ঘনিয়ে আসছে তত ওর ভয় বেড়েই চলেছে।।

কিন্তু এর মধ্যেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে।ওর শাশুড়ি পুড়ো উল্টো কথা বলে।
দেখ খোকা, এত ছেলে ছেলে করিস না।সবাই ছেলে চাইলে ছেলে বিয়ে দেবার সময় মেয়ে কোথায় পাবি! মেয়েরাই তো পরবর্তী সময়ে মা হয়।ছেলে মেয়ে যাই হবে ঠাকুরের আশীর্বাদ।

মেঘলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।যতই না করুক ওর দেখাশোনা, যত্ন।এই শরীরেও সব কাজ ওকেই করতে হচ্ছে।না পারলেই বলছে, আমরা বুঝি আর বাচ্চা জন্ম দেইনি? এই শরীরে যত কাজ করবে তত শরীর ভালো থাকবে।
কিন্তু এই বিষয়ে যে ওর শাশুড়ি মা ওর পাশে দাঁড়িয়েছে তাতেই ও খুব খুশি। একজন তো ওর পাশে আছে।
শত হলেও উনি নিজেও তো একজন মা।মনে মনে খুশি হয় মেঘলা।

ডেলিভারীর ডেট প্রায় এসেই গেছে, এখন আর তাড়াতাড়ি কাজ করতে পারে না মেঘলা।
সেদিন বিকালে, ছাদ থেকে জামা কাপড় নিয়ে নিচে নামছে ও।শুনতে পাচ্ছে শাশুড়ি মা কার সাথে যেন ফোনে হেসে হেসে কথা বলছে–

“আরে না না ঘরে নেই।ছাদে গেছে জামা কাপড় আনতে।ঘরে থাকলে কি আর এসব কথা বলি। নামতে এখনো অনেক দেরী। পেটের ভারে হাঁটতে দেরী হয়।দেখে তো মনে হচ্ছে মেয়েই হবে।” বলেই হেঁসে উঠলো শাশুড়ি।

যে কাজটা কোন দিন করেনি মেঘলা সেই কাজটিই আজ করলো। খুব আস্তে আস্তে হেটে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শাশুড়ির কথা শুনতে লাগলো।

“হ্যাঁ রে নন্দু তুই যেভাবে যেভাবে বলেছিস সেভাবেই সব করেছি এতোদিন। ঘরের সব কাজ করে এখনো আমি কোন কাজে হাত দেই না।

কি আর বলবে তোর দাদা । কিছু বুজলে তো।ও বাড়ি আসলে আমি তোর দাদার সামনে সামনে থাকি।যা লাগে হাতে দেই।আরে মেঘলা তো ঘরের কাজ করতে করতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে।তোর দাদা ভাবে, আমিই সব কাজ করি।ওর বউ শুয়ে বসে থাকে।

এই নিয়ে মাঝে মাঝে ওদের মধ্যে অশান্তি ও হয়। আমি তো চুপ করে থাকি।তোরা ঝগড়া কর।”
আবার হাঁসলো শাশুড়ি।

মেঘলা বুঝতে পারলো শাশুড়ি তার একমাত্র মেয়ের সাথে কথা বলছে।যার এই কদিন আগেই একটা মেয়ে হয়েছে।

“আরে আমি তো দিন রাত ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি যেন একটা মেয়ে হয়।যদি ছেলে হয় নাহ, ওই বউ কে তোর দাদা একদম মাথায় করে রাখবে।ওই বউ এর আর অহংকারে মাটিতে পা পড়বে না।তোর দাদার মন ঘুরে যাবে ঐ দিকে।”

মেঘলা আর শুনতে পারছে না, ধীরে ধীরে এসে নিজের ঘরে শুয়ে পড়লো। কষ্টে চোখে জল এলো ওর।মা ডাকলেই সে মা হয়ে যায় না।

মানুষের মন এতো ছোট হয়, মনে এক মুখে আর এক নিয়ে অভিনয় করে চলে।কত সহজেই আমরা বিশ্বাস করি এই অভিনয়।

সন্তান জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত