ও পাড়ার চাটুজ্জেরা

ও পাড়ার চাটুজ্জেরা

-বলি তুমি খবরের কাগজটা রাখবে? দিনরাত যত বাজে খবর পড়া | চা ঠান্ডা হলে নিজে গরম করে নিও, আমি বাপু পারবো না |

-এই শোনো, সারাদিন গজগজ করবে না তো | তোমার জ্বালায় কালকে পুরো কাগজটা পড়া হয়নি, আজ ভালো করে পড়তে দাও |

– কাগজের মধ্যেই ঢুকে বসে থাকো | আমার ছেলেটা বেচারা আরও রোগা হয়ে গেল, আজও ঐ পোড়া ভাত আর কাঁচা সবজি খেয়ে বেরিয়েছে, মেয়েটা যদি একটু সংসারটাতে মন দিত |

– কেন ও একা কেন দেবে? তোমার ছেলেরও তো সংসার, ও নিজেও তো দিতে পারে |আর তা ছাড়া এক আধ দিন ওরম হয় | কেন তোমার মনে নেই যখন গোঁসা করে বসে থাকতে হাত পুড়িয়ে রান্না করে খাওয়াইনি তোমায়?

এটা এদের রোজকার ঘটনা |ছেলে আর বৌমা অফিসে বেরিয়ে গেলেই শুরু | গলির শেষ বাড়িটা এই চাটুজ্জেদের | বিমল বাবু তার সময়কালের বেশ নামকরা উকিল ছিলেন, তবে হলে কী হবে বাড়ির জজসাহেব থুড়ি মেম বরাবরই সাবিত্রী | পান থেকে চুন খসলে রক্ষা নেই | একমাত্র ছেলে দীপ, গতবছর বিয়ে হয়েছে | তৃণারও একই অফিস, আলাপটা যদিও কলেজেই | তবে কাজ আর সংসার সামলাতে সামলাতে বেশ হাঁপিয়ে উঠছে দুটিতে |প্রেমটাই বোধহয় ভালো ছিল | এ যেন বিশাল দায়িত্ব | কোনোদিন তরকারিতে নুন দিতেই ভুলে যায় তৃণা তো কোনোদিন আয়রন করতে গিয়ে নতুন জামাটা পুড়িয়ে ফেলে দীপ | ইলেকট্রিক বিলের ডিউ ডেট পেরিয়ে যায়, ওয়ার্নিং নোটিশ এলে দীপের টনক নড়ে | ভাতটা চাপিয়ে ল্যাপটপটা খোলে তৃণা, পোড়া গন্ধটা পেলে খেয়াল হয় | ব্যস অশান্তি |

-আগে জানলে এরম একটা ছেলের সাথে প্রেম করতাম? সারাদিন ওই ফোনটা নিয়েই বিজি থাকো, কাজ দেখাচ্ছে! ”

– এরকম পোড়া খাবার খেতে হবে জানলে আমিও আরেকবার ভেবেই প্রেমটা করতাম |

আবার কি ! সেদিনের মতো রান্না চুলোয় যাক, প্রেমটা কিন্তু দিব্যি আছে |

-ছাড় না আজ আর রান্না করতে হবে না | বাইরে খেতে যাবি?

-এখন? আচ্ছা দাঁড়া এই মেইলটা পাঠিয়েই রেডি হচ্ছি |

জব্বর না? হ্যাঁ এরকমটাই হয় | হাজার ঝগড়া হোক, অভিমান হোক, দিনের শেষটা কিন্তু আদরের | যেদিনই ঝগড়া করে অফিস যায়, বাড়ি ফিরেই দীপ ডায়েরিটা খোলে, ” love you”. ব্যস রাগটা কখন যেন জল হয়ে যায় | তৃণা আগেই ফেরে, কোনো কাজ নিয়ে বসে আছে আর দীপ পেছন থেকে জড়িয়ে বলে “আজ আমি রান্না করে খাওয়াবো, তুই কাজ কর ” | তৃণার হাসিটাই যেন দেখার জন্য সকাল থেকে বসেছিল |

-কই গো? আংটিটা খুঁজে পেলে? আরে বলছি তো, ওই খাটের নীচেই থাকবে আরেকটু দেখো না | বাবা কি সাংঘাতিক মেয়ে বল? দীপ আংটি হারিয়েছে বলে অত গোঁসা? আধ-সেদ্ধ রান্না করে রাগ দেখাচ্ছে মহারানী | কি গো পেলে?

-তোমার ছেলেরই বা অত ভুলো মন কিসের? পরিষ্কার করবে বলে মেয়েটা খুললো,ওর হাতে দিয়ে গ্যাসটা অফ করতে গেল আর ও তারমধ্যেই কোথায় রেখে দিয়েছে, খেয়ালও নেই? হাত লেগে কখন নীচে পড়ে গেছে | এই নাও একেবারে কোনায় ছিল |

ঘন্টা খানেক হল তৃণা ফিরেছে | নাহ রাগটা আর নেই | টেবিলের ওপর আংটিটা | দীপ অফিস বেরোনোর আগে খুঁজেছে তাহলে | মাঝে মাঝে এত রাগ হয় ছেলেটার ওপর, আবার মাঝে মাঝে এত্তটা ভালোবাসতে ইচ্ছে করে | আংটিটা আঙুলে পরে নিয়ে ডায়েরিটা খুললো | এটার জন্যই তো অপেক্ষা করে থাকবে ছেলেটা |

রান্না ঘরে যাওয়ার আগে বসার ঘরের আলোটা জ্বালালো | সন্ধেয় এসে ধূপটা জ্বালিয়েছিলো | গন্ধটা এখনও রয়েছে | এই ছবিটা দেখলেই সারাদিনের ক্লান্তিটা কোথায় যেন উবে যায় |একটা পরম শান্তি পায় তৃণা | ছবির মালাটা বদলে দেয় | দীপ পুরো বাবার মুখটাই পেয়েছে | মা কি ওর দিকেই দেখছে?
“আশীর্বাদ কর এভাবেই তোমাদের ছেলেকে আগলে সারাজীবন যেন থাকতে পারি”

-মেয়েটা জেদী হতে পারে, তবে মনে কিন্তু দরদ আছে বল? আবার দেখছে আমি ওর দিকেই তাকিয়ে আছি কি না |

-সে তো আমি সবসময় বলি, তবে বেশি দেখো না, ও আবার ভিরমি খাবে | রজনীগন্ধার গন্ধে ঘুমটা আসছে শুলাম গো গিন্নি, তুমিও বরং ঘুম দাও |

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত