চোখের জল

চোখের জল

হুট করে অণুকে বাসায় দেখে বড্ড অবাক হয়েছি আমি৷ সকাল বেলা, হাতে বাজারের থলে ধরিয়ে আম্মা বলেছিল,
মেহমান আসবে৷ বাজার নিয়ে আয়৷

আমিও বাজার এনে দিয়েছিলাম৷ কিন্তু অণু মেয়েটা হুট করে এসে পরবে ভাবিনি৷ আর আম্মাও এই ব্যাপারে টু শব্দ করেনি৷

অণুর পরিবারের সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছে বছর পাঁচেক আগে৷ আমরা যে বাসাটাই থাকতাম৷ তার পাশের বাসাতেই অণুর পরিবার থাকতো৷ সকাল বিকাল প্রায়ই দেখা হতো৷ গোলগাল চেহারার সাথে সরু নাক আর লম্বাকেশী মেয়েটা অণু৷ বয়সে আমার চেয়ে বছর তিনেকের ছোট হবে৷ আমি পিচ্চি বলে ডাকতাম মেয়েটাকে৷
প্রথম প্রথম রাগ করলেও পরে পিচ্চি ডাক শুনলে হাসতো৷ অণুর মাঝে মাঝে মন খারাপ হতো৷
তখন হুট করে আমাকে এসে বলতো,
-শুভ ভাই আমার মন খারাপ৷ চলো ঘুরে আসি৷ ফুচকা খাবো৷
আর আমি যখন বলতাম,

-পিচ্চি মেয়ের আবার মন খারাপ! ছ্যাকা দিলো নাকি কেউ?
অণুর মুখে তখন রাগের আভা ফুটে উঠতো৷ হাতের নখগুলো দেখিয়ে বলতো,
-নখগুলো দেখেছো কত লম্বা? এগুলা দিয়ে খামচি দিবো আরেকবার পিচ্চি ডাকলে৷ এখন চলো৷
পিচ্চি মেয়েটার আবদারগুলো রাখতে আমিও বেরিয়ে পরতাম৷ সারাটাদিন আমার পিছনে লেগে থাকাই ছিল পিচ্চিটার কাজ৷

মাঝে মাঝে যখন আমারও মন খারাপ হতো৷ অণু আমাকে বিরিয়ানী রান্না করে খাওয়াতো৷ অণুর হাতে রান্না করা বিরিয়ানীটা ছিল আমার মনের আকাশের কালো মেঘ কাটিয়ে দেয়া এক পশলা বৃষ্টি৷

মাঝে মাঝে আমি মন খারাপের ভান ধরতাম৷ অথচ আমি দিব্যি ভালো আছি৷ অণু ও অবশ্য ব্যাপারটা বুঝতে পারতো৷তারপরও বিরিয়ানী রান্না করে খাওয়াতো৷ ছাদের কোণটাতে দু’জনের হাতে দু’টো বিরিয়ানীর প্লেট৷ সাথে দুষ্টুমি আর খুনঁসুটি মিলিয়ে অন্যরকম ভালো লাগায় ভরে যেতো আমার মনটা৷

এমনই এক ম্লান রোদ্রের শেষ বিকেলে অণুকে বলেছিলাম,
-অণু একটা কাজ করে দিবি আমার?
অণু মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল,
-এমন ভাবে বলছো কেন? বিরিয়ানী রাঁধবো? না আন্টির কাছ থেকে টাকা নিয়ে দিবো?
আমি মুচকি হেসে অণুর গুলুগুলু গালগুলো টেনে বলেছিলাম,
-তেমন কিছু না৷ এক চিঠি লিখে দিবি? প্রেমের চিঠি৷ ভালোলেগেছে একজনকে৷ গত কয়েকদিনে আমার মনের আকাশে বিচরণ করে চলেছে ভালোলাগার মানুষটা৷ জানিসই তো আমি ভীতুর ডিম৷ এমন একটা পত্র লিখে দিবি৷ যাতে ভালোলাগার মানুষটা আমার ভালোবাসার মানুষ হতে বাধ্য হয়৷ বল লিখে দিবি?”
অণু হেসে বলেছিল,
-লিখে দিবো৷ তবে এক শর্তে৷
-কি শর্ত?
-চিঠিটা তুমি মেয়ের হাতে দিবা৷ কিন্তু প্রমিস করো, তুমি কখনোই এটা পড়বেনা৷

তারপরের সকালে অণু আমাকে ঠিকই একখানা প্রেমপত্র লিখে দিয়েছিল৷ না আমার হাতে দেয়নি অবশ্য৷ পাছে আমি যদি পড়ে ফেলি এই ভয়ে৷
চিঠিটা হাতে নিয়ে আমাকে বলেছিল,
-তুমিতো ভীতু টাইপের৷ প্রেমিকাকে চিঠি দিতে গিয়ে আবার ভয়ে মরে যাবা৷ তাই চলো তোমার হয়ে চিঠিটা আমিই দিবো৷”

আমিও আর অণুর কথা ফেলতে পারিনি৷ ভার্সিটির মাঠে গিয়ে জলপাই গাছের ছায়ায় বসে থাকা নীলুকে দেখিয়ে দিয়েছিলাম৷ অণু সত্যি সত্যিই নীলুকে দিয়ে এসেছিল চিঠিটা৷

সেদিনের পুরো বিকেল অণুর সাথে কাটিয়ে এসেছিলাম৷ পিচ্চি মেয়েটার সব আবদার আর বাহানা পূরণ করে৷
“নীলু রাজি হবে তো?”
এই কথাটা অণুকে শ’খানেক বার জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ অণু প্রতিবারেই রহস্যের হাসি হেসে বলেছিল,
হ্যা করবে৷

আমার কেন জানি অণুর সেদিনের হাসিটা বড্ড অচেনা মনে হয়েছে৷ আমি মাথায় রাখিনি৷ নীলুতে বিভোর ছিলাম বলে হয়তো সব গুলিয়ে ফেলেছিলাম৷

সেদিনের রাতটা আমার আজও মনে পরে৷ চাপা উত্তেজনায় ঘুমোতে পারিনি আমি৷ আমার মন আর মস্তিষ্কজুড়ে ছিল নীলু নামের মেয়েটা৷

তার দিন দুয়েক পরেই নীলুর কাছে ডাক পরে আমার৷ কালোরঙা শার্ট আর ব্লু জিন্স পরে যখন বেরুচ্ছিলাম৷ হুট করে অণুর আগমন৷ নাক সিটকে বলেছিল,
-এসব কি পরেছো? ক্ষ্যাত লাগছে৷ নীল শার্টটাই পরো৷ হাজারহোক হবু প্রেমিকার সাথে দেখা করতে যাচ্ছো৷ প্রেমিকদের নীল শার্টেই মানায় বুঝেছো ছেলে৷”
আমিও অণুর কথা ফেলতে পারিনি৷ ঠিকই নীল শার্টটা পরে গিয়েছিলাম৷

নীলু তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গাটাই বসেছিল৷ এতদিনে জায়গাটা আমারও প্রিয় হয়ে গিয়েছে৷ ধুরুধুরু বুক নিয়ে আমি নীলুর সামনে গিয়ে দাঁড়াই৷ নীলু মুচকি হাসে৷ নীলুর হাসি দেখেই আমার ভেতরটা গুলিয়ে আসে৷ নীলু ঈশারায় বসতে বলে তার পাশে৷
পাশে রাখা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে আমার দেয়াটা চিঠিটা বের করে৷
-আমি পড়ি৷ তুমি শুনো৷
আমার দিকে তাকিয়ে বলে নীলু৷
এই বলে পড়া শুরু করে মেয়েটা৷

প্রিয় নীলু,
আমি জানি না তুমি দেখতে কেমন৷ তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তোমার মুখটা অনেক মায়াবী নিশ্চয়৷ তোমার গালগুলোও হয়তো গোলগাল৷ গোলগাল গাল আবার আমার সাহেবের বড্ড পছন্দ৷ আচ্ছা তুমি বিরিয়ানী রাঁধতে পারো? পারলেও আমার মতো পারবেনা জানি৷ জানো তো, আমার রান্না করতে ভালো লাগে না৷ আমার সাহেবের জন্য রাঁধি৷ যেদিন শুনেছি, আমার সাহেবের বিরিয়ানী পছন্দ৷ সেদিন থেকেই রান্না শেখা শুরু করেছি৷ আমার সাহেব সকাল বিকাল আমার গাল টানে৷ পিচ্চি বলে ডাকে৷ এটা আমার বড্ড ভালো লাগে৷ যদিও আমি মেকি রাগ দেখায়৷

আমার সাহেব প্রতিবিকেলে আমাকে সঙ্গ দেয়৷ আমার মন খারাপগুলো গায়েব হয় আমার সাহেবের হাসিমাখা মুখখানা দেখলে৷ আমার সাহেবের মনের আকাশেও মেঘ জমে মাঝে মাঝে৷ তবে সেই মেঘ আমি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই৷ বুঝেছো মেয়ে?

কাল বিকেলে শুনলাম, সাহেবের নাকি তোমাকে পছন্দ৷ পত্র লিখে দিতে হবে৷ তোমাকে বলা হয়নি এখনো৷ জানো তো, কথাটা শুনেই আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরেছে৷ আমার হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে৷ চোখগুলো টলমল করে গলাটা ধরে আসছিল৷ অনেক কষ্টে নিজেকে আটকেছি৷ আমার সাহেবের মুখে অন্য মেয়ের কথাশুনেই আমার এই অবস্থা৷ আর ভাবো, আমার সাহেব যদি চিরতরে তোমার হয়ে যায়! তবে আমার কি অবস্থা হবে৷
আমার এতগুলো ভালোলাগার অনূভূতি তুমি নষ্ট করো না মেয়ে৷

বড্ড ভালোবাসি আমার হাবাগৌবা সাহেবটাকে৷ আমাকে অবশ্য এখনো পিচ্চি ভাবে৷ কিন্তু উনিতো জানেনা, এই পিচ্চিটার মনের আকাশে সারাক্ষণ উনিই বিচরণ করে৷ আমার জীবনের প্রত্যেক মূহুর্ত আমার সাহেবময়৷ আমি জানি, একদিন উনার মনেও আমার জায়গা হবে৷

আমি জানি, তুমি এই চিঠিটা আমার সাহেবের হাতে দিবে৷ উনি মন খারাপ করবেন৷ রাগী রাগী মুখে আমার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে৷ কথা শুনাবে আমাকে৷ কিন্তু আমি সব করতে রাজি৷ আমার সাহেবকে একদিন আমার করে নিবো৷
আর শুনো, আমার সাহেবকে কালো শার্টে খুব মানায়৷ তোমার সাথে দেখা করতে নিশ্চয় কালো শার্ট পরেই যেতে তৈরী হবে৷ কিন্তু আমি যেতে দিবো না৷ পাছে তুমি যদি প্রেমে পরে যাও হি হি৷ তাই নীল শার্ট পরিয়েই পাঠাবো৷ যাতে ক্ষ্যাত লাগে৷ দেখবে, শার্টটাও আমার কথামতো পরে যাবে৷ এবার ভাবো, তুমি কি প্রেমের পর এসব সহ্য করতে পারবে? তাই ভালোই ভালোই বলছি, একদম সাহেবের দিকে নজর দিবানা হুহ!
ইতি
সাহেবের পিচ্চি

নীলু চিঠিটা আমার হাতে গুজে দিয়ে বলেছিল,
-মেয়েটা বড্ড ভালোবাসে তোমাকে৷ ওর অনূভূতিগুলো ছুয়ে গেছে আমাকে৷ ভালোবাসাগুলো পায়ে ঠেলো না৷ আপন করে নিও৷ হ্যা তোমার হয়তো আমাকে ভালো লেগেছে৷ আমারও ভালোলাগে তোমাকে৷ তুমি খুব ভালো একটা ছেলে বুঝেছো৷ কিন্তু বিশ্বাস করো, প্রেমিক হিসেবে আমি কখনোই তোমাকে ভাবিনি৷ কয়েকবার চোখাচোখি আর মুচকি হাসি দেখে প্রেম হয় না শুভ৷ অনূভূতি লাগে৷ সে অনূভূতিটা তোমার প্রতি আমার জন্মায়নি৷
কিন্তু অণুর জন্মেছে৷ মেয়েটাকে আপন করে নিও৷ নিশ্চয়টা দিচ্ছি ভালো থাকবে৷
যাই৷ ভালো থেকো৷

রাগে গজগজ করে বাসায় ফিরেছিলাম আমি৷ একমূহূর্তের জন্য আমার বেঁচে থাকাটা অর্থহীন মনে হয়েছিল৷ অণুকে আর বলা হয়নি কিছু৷ ভেবেছিলাম দেখা হলেই, গাল লাল করে দিবো৷ অণু আমাকে সে সুযোগ দেয়নি৷
রাগ আমি বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারিনি কখনোই৷ পরেরদিন নাস্তার টেবিলে মা যখন বলল,
-অণু ঢাকায় চলে গিয়েছে৷
কথাটা শোনামাত্রই ব্যাথার দলা পাকিয়ে উঠে আমার গলায়৷
কিছুক্ষণের মধ্যেই শূন্যতার হাহাকার গ্রাস করে বসে আমাকে৷ একমূহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আমার কেউ নেই৷
এরপরের প্রত্যেকটা দিন আমার দুর্বিষহ কেটেছে৷ আমি বুঝতে পেরেছি, এই মেয়েটা ছাড়া আমার চলবেনা৷ আমার অনূভুতিগুলো এই পিচ্চি মেয়েটার মধ্যে বন্দি হয়ে পরেছে৷
একাকিত্ব প্রতিনিয়ত গ্রাস করেছে আমাকে৷ অভিমানও জমেছে অনেক৷ একদম না বলেই হারিয়ে যেতে হবে কেন?

-আন্টি কামলাটা কে? নতুন রেখেছো নাকি?”
মা কে জিজ্ঞেস করে বসে অণু৷
ক্রিকেট খেলে এসে আর হাত-পা ধোয়া হয়নি৷ রুমেই বসেছিলাম৷
অণুকে ঘিরে আমার ঘুমন্ত অনূভূতি গুলো মাথা ছাড়া দিয়েছে৷ সেগুলোকে মেয়েটা বুঝে?
উল্টো পঁচানো শুরু করেছে৷

-কেমন আছো?
জিজ্ঞেস করে অণু৷ একবার তাকালাম মেয়েটার দিকে৷ আগের চেয়ে বড় হয়েছে৷ উত্তর দিলাম না৷
-রেগে আছো?
আবার জিজ্ঞস করে অণু৷
আমি উত্তর দিই না তারপরও৷
-চলে যাবো?
-গেলে পরেরবার এসে দেখতে পারবিনা আর৷
উত্তর দিই আমি৷
অণু আমার পাশে এসে বসে৷

আমার হাতটা তার দু’হাতের মাঝে নিয়ে বলল,-জানো তো৷ তোমাকে না জানিয়ে চলে গিয়েছিলাম৷ বড্ড কষ্ট হয়েছিল আমার৷ কিন্তু এটার দরকার ছিল৷ আমি কাছে থাকলে হয়তো তোমার কাছে পিচ্চিই থেকে যেতাম৷ কিন্তু আমি ওরকম পিচ্চি হয়ে থাকতে চাইনি৷ আমি জানি, তুমি আমাকে অনেক মিস করেছো৷ আমি ভুলিনি তোমায়৷ প্রতিনিয়ত তোমার খোঁজ নিয়েছি চাচির কাছ থেকে৷ যখনি শুনতাম, তোমার মন খারাপ৷ সেদিন আমারও মন খারাপ হতো৷ আমি জানি তোমার মন খারাপে ছাদের কোণে বসে থাকো৷ আমিও থেকেছি৷ শেষবিকেলের ম্লান রোদে তোমাকে ভেবেছি৷ আচ্ছা তুমি কি অনুভব করেছো আমায়?”
অণুর দিকে তাকালাম আমি৷ পুরো চেহারাজুড়ে আমাকে পাওয়ার আকুলতা৷
জানিস অণু,

তুই যাওয়ার পর আমি বুঝেছি তুই আমার কাছে কি ছিলি৷ তোর দেয়া মূহুর্তগুলো আমি বড্ড অনূভব করেছি৷

হুট করে কেউ এসে বলেনি,
-চলো ঘুরতে যায়৷ আমার বড্ড মন খারাপ৷
কিংবা পিচ্চি বলে ক্ষ্যাপালে হাতের নখগুলো দেখিয়ে বলতি,
-নখগুলো তোমাকে খামচানোর জন্যই বড় করেছি৷”
আমার প্রত্যেকটা মন খারাপের বিকেলে তোর শূন্যতা অনুভব করেছি৷
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙলেই তোকে মনে হতো৷ তোর দেয়া কালো শার্টটা আমার আজো আছে৷
মন খারাপের সময় শার্টটা গায়ে জড়িয়ে বসে থাকি৷ শার্টটা পরে আমি কোথাও বের হয় না৷ পাছে কেউ পছন্দ করে ফেললে৷ তখন তো আমার পিচ্চি এসে আবার মন খারাপ করবে৷
শার্টটা যত্ন করে রেখে দিয়েছি৷ আমি জানি তুই ফিরবি৷
গৌধূলী বিকেলে কালো শার্ট পরবো আমি, আর তুই কালো শাড়ি পরে বের হবি৷ হাতে হাত রেখে হারিয়ে যাবো৷
যাবি তুই?
মাথা নেড়ে সায় দেয় অণু৷

অণুর দিকে তাকিয়ে অবাক হই আমি৷ গড়িয়ে পরা চোখের জল আর প্রাপ্তির হাসি মিলিয়ে অদ্ভূত সূন্দর লাগছে মেয়েটাকে৷

আমি আলতো করে চোখের জলগুলো মুছে দিয়ে গালগুলো টেনে দিই৷

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত