শ্বাপদসঙ্কুল

শ্বাপদসঙ্কুল

পূর্ব কিম্বা শেষ কথাঃ
দেশের একটা স্বনামধন্য পত্রিকার পঞ্চম পাতায় এক কলাম তিন ইঞ্চি জায়গা দখল করা সংবাদটি অনেকের নজর এড়িয়ে যাবে। সংবাদের শিরোনামঃ ভালবাসা নামগোত্রহীন। সংবাদের সারমর্মঃ ঢাকার ইলেক্ট্রনিক্স ও কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার অবিবাহিত জামিলুর রহমান একটা মোবাইল ফোন কোম্পানির হয়ে নিয়মিত রাঙ্গামাটি যাওয়া আসা করতেন। কোন এক সময় মারমা উপজাতির কিশোরী মেয়ে শেফালী মারমার সাথে তার প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রেমিকার বয়স এবং উভয়পক্ষের পারবারিক বাঁধার কত বিবেচনা করে বেপরোয়া প্রণয়ীযুগল গতকাল সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পলায়ন করেছে। সামরিক গোয়েন্দাসূত্র এবং পুনর্বাসিত বাঙ্গালীরা খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।

১. গল্পের শুরু
পাতা মাড়ানোর খসখস শব্দ। একটা স্থির বিন্দু থেকে শব্দটা ভেসে ভেসে আসছে। বাড়ছেও না, কমছেও না। হয়তো কোন বুনো প্রাণী শিকার ধরে এনে ক্ষুধা নিবৃত্তি করছে।
ডান দিকের বাঁশ ঝাড়ের দিকে একবার তাকিয়েই জামিল আবার কাজে মনোসংযোগ করল। মোবাইল ফোনের ট্রান্সমিটার দ্রুতই সারতে হবে। উপর মহলের নির্দেশ। যান্ত্রিক গোলযোগের প্রভাব পড়েছে মাত্র দশ মাইল ব্যাসার্ধ জুড়ে। কিন্তু বলতে গেলে এই পুরো দশ মাইল ব্যাসার্ধই দখল করে আছে সামরিক ঘাঁটি। মোবাইল মাস্টের সক্রিয় থাকাটা তাই এর প্রচার-ব্যাসার্ধের চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

কখনো কখনো এই বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের ঢেউয়ে জ্ঞাতসারেই বাঁধ বসিয়ে দেয়া হয়। গোঁটা এলাকার মোবাইল সিগন্যালে তব্ধা ধরে। পাহাড় আর উপত্যকা জুড়ে আরম্ভ হয় ‘সন্ত্রাসী’ খোঁজার চিরুনী অভিযান।
হঠাৎ অসংখ্য ডানা ঝাপটানোর শ্যালো ইঞ্জিনের মত শব্দে জামিল চমকে উঠলো। ডান কাঁধটা একটু কাঁপতেই হাত খসে সাড়াশিটা পড়ে গ্যালো বিশ ফিট নিচে। মাটিতে বিছিয়ে থাকা কতগুলো শেফালী ফুল সাড়াশির ভর-বেগ সইতে না পেরে চিবানো আঁখের মত থেঁতলে গ্যালো। শব্দের উৎস বরাবর জামিল আরেকবার মাথা ঘুরালো। রাবার গাছগুলোর উপর দিয়ে এখন অগণিত পাখি অগোছালোভাবে উড়োউড়ি করছে। একটু পরই পাখসাঁটের শব্দ নিভে গিয়ে আবার জেগে উঠলো শুকনো পাতার খসখসানি।
একটা মেয়েলি কন্ঠের ত্রস্ত আওয়াজ ভেসে এলো কী? আওয়াজটাকে যেন অর্ধেক পথে চেপে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পাতার মর্মরধ্বনিও প্রায় লুপ্ত। কেমন একটা আতঙ্কময় চাপা নীরবতা।
জামিল মই বেঁয়ে নীচে নেমে এলো। ভয়ের চাইতে উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠাই এখন প্রবল। ও পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলো রাবার বনের দিকে। এক দিকে হেলে পড়া বাঁশ ঝাড়ের পেছনে ও নিজেকে আড়াল করে নিলো। বাঁশ পাতার ফ্রেইমের ভেতর দুটো পুরুষের ছায়ারেখা। অভ্যাসের বশে মোবাইল ফোনে হাত চলে এলো। ছায়ারেখা দুটি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে ঝর্নার পেছনে মিলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ রোদের ঝাপটা লেগে অশরীরী দুটি যেন মুহূর্তের জন্য অবয়ব ফিরে পেলো। শ্যামলা বর্ণ, অর্ধ-উলংগ, বাঙ্গালী। কৃশকায় ছায়ারেখাটি কী মনে করে একবার পেছনে তাকালো। একটা ঝলক মাত্র। তারপরও চেহারাটা চেনা লাগছে, জামিল যেন কোথায় একে দেখেছে। কোথায়?

ছায়ারেখা দুটো মিলিয়ে যেতে না যেতেই একটা গোঙ্গানির শব্দে ক্যামেরার এলসিডি স্ক্রীন ফিরে এলো রাবার গাছের নীচে।
জামিলের দুচোখ এখন বিস্ফোরিত। ওর বুকের ডান পাশে কেউ সজোরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে।

২. পাহাড় যাত্রা
সমতল ছেড়ে জলপাই-রঙ্গা জীপের বহর ক্রমশ সবুজের ঢেউয়ে তলিয়ে যাচ্ছে। এবড়ো-থেবড়ো পাহাড়ি পথ। দুরন্ত হাওয়ায় তৃণার খোঁপা খুলে যাচ্ছে বার বার। শাড়ি সামলানোই এখন সার্বক্ষণিক প্রকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পোশাকে হুড খোলা জীপে ওঠার মত বোকামি সে করল কী ভাবে? নিজের উপরেই নিজের রাগ হচ্ছে।
তৃণা কর্নেলের স্ত্রী। তারপরও সামনে পেছনের খোলা জীপ থেকে জুনিয়র অফিসাররা ওর শরীরটাকে আড়েঠারে মেপে নিচ্ছে। এই সতেজ পাহাড়,সবুজ বন-বনান্ত, নীলাভ আকাশ আর মুখরা বাতাস মটর-গাড়ির দ্রুতির সাথে মিলেমিশে এমন এক আনন্দঘন কাব্যের কোলাজ তৈরি করেছে যে অযাচিত দৃষ্টিপাতের অস্বস্তিটুকু ও এই মুহূর্তে আর গায়ে মাখছে না। তৃণা আড়চোখে কর্নেল ফেরদৌসের দিকে চাইলো। সামরিক ইউনিফর্ম পরা বলিষ্ঠ পুরুষ। ঠোঁটের উপর পুরু কাল গোঁফ। ডার্ক গ্লাসে কর্নেলের চোখ ঢাকা। কিন্তু মুখের টান টান পেশীগুলো বলে দ্যায় ওর শ্যেন দৃষ্টি অভিজ্ঞ শিকারির মত চতুর্দিক নিরীক্ষা করছে।
তৃণা ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্রী। কিন্তু মিনমিনে কবি সাহিত্যিক নয়, ফেরদৌসের মত শক্তপোক্ত যুদ্ধংদেহী মানুষটাকে ও স্বামী হিসেবে বেছে নিয়েছে। তৃণার ভাষ্যমতে ফেরদৌসের একটা গাট্স্ আছে, প্রয়োজনে পুরনো দিনের রাজকুমারদের মত ভয়ঙ্কর রাক্ষসপুরী থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে ওকে উদ্ধার করবে। কবিদের মত কারনে অকারনে গোলাপ ফুল হাতে ভিজে ন্যাকড়া হয়ে নেতিয়ে পড়বে না।
জীপের বহর হঠাৎ থেমে গ্যালো। সামনে রাস্তা সহসাই সরু হয়ে গ্যাছে, দুদিকে খাড়া পাহাড় আকাশস্পর্শী। তৃণা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফেরদৌসের দিকে তাকালো। ফেরদৌস জানালো, ওই রাস্তায় প্রায়শই অ্যাম্বুশ হয়। ট্রাইবাল মিস্ক্রিয়েন্টরা পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আর গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। গাড়ির বহর যখন একবার সরু রাস্তায় ঢুকে পড়ে তখন আরম্ভ হয় আক্রমন। গাড়ির বহর না পারে পিছু হটতে না পারে সামনে যেতে। কখনো সখনো রাস্তায় মাইনও পোঁতা থাকে, ট্যাক্টিকাল অবস্টিক্ল্।
অগ্রবর্তী গ্রুপ রেকি করে এসে জানালো পথ পরিষ্কার। সবগুলো ইঞ্জিন আবার চালু হলো, সবগুলো চাকা ঘড়ির কাঁটার অনুবর্তী হয়ে ঘোরা আরম্ভ করল। সামনের প্রকৃতি রহস্যঘেরা, ক্রমঃউন্মোচনময়। কিন্তু সেই রহস্যের হাতছানি তৃণাকে এখন আর আগেরে মত প্রবলভাবে টানছে না। মনের ভেতর কিসের একটা কালো ছায়া পেন্ডুলামের মত দুলছে।

৩. সংসার
বাসায় পৌঁছুনোর ঘন্টাখানেক যেতে না যেতেই কলিং বেলটা বেজে উঠলো। তৃণা দরজা খুললো। একজন আর্মি অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। অফিসারটি পরিচয় না দিয়েই ব্যস্ত কন্ঠে বললোঃ
‘কর্নেল স্যার আছেন?’
‘আছেন। কুমিল্লা থেকে মাত্র এলেন।’
‘ওনার সাথে এখুনি কথা বলতে হবে ’

তৃণা কর্নেলকে জানান দিয়েই রান্না ঘরে চলে এলো।
এখানে আসার পর তৃণার মন ভালো হয়ে গেছে। এই সভ্যতাবিবর্জিতপ্রায় চড়াই-উতরাই-ধামে এমন মনোরম বাংলো বাড়ি কল্পনাই করা যায় না। বাড়ির অর্ধেক অংশে লাল টালি ছাওয়া ঢালু ছাদ, বাকি অর্ধেক সমতল। বাড়ির সামনে বিরাট লন। লনের সমস্ত ঘাস সমান করে কাটা। লনের প্রান্ত ঘেঁসে সারি বাঁধা গোলাপ আর গাঁদা ফুলের টব। আরেক পাশে অনেকগুলো কড়ুই গাছ। গাছগুলোর নীচের অর্ধেক সাদা রঙ করা। বাড়ির পেছনে কাপ্তাই হ্রদের একটা অংশ সরু হয়ে ঢুকেছে। হ্রদের পার ধরে একটা হরিণের বাচ্চা টেনিস বলের মত লাফাচ্ছে। কগুলো নীল প্রজাপতি কোত্থেকে এসে হরিণের পিঠ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে।
বাড়ির ভেতরই বা কম কীসে? ড্রইংরুমে মার্বেল পাথরের ফ্লোরে পারস্যের গালিচা বিছানো। মাঝে বার্ণিশ করা গাছের গুঁড়ির উপর পুরু কাঁচ বসানো চায়ের টেবিল আর সেগুন কাঠের কারুকার্যময় সোফা। রান্না ঘর দেখে মাথা খারাপ হবার যোগাড়। অ্যামেরিকান স্টাইল ডবল-ডোর ফ্রিজ, ইন্ডাকশন কুকার, বড় মাইক্রো ওয়েভ ওভেন, কী নেই? ওয়ার্কটপের মাঝে স্টেইনলেস স্টিলের ডাবল সিঙ্ক। সিঙ্কের সামনে লম্বা জানালা দিয়ে পাহাড় দেখা যায়। পাহাড়ের তরঙ্গে তরঙ্গে যেন সবুজের আংরাখা পাতাঃ গাড় সবুজ, হাল্কা সবুজ, নীলাভ সবুজ, জলপাই সবুজ, কলাপাতা সবুজ।
তৃণা মুগ্ধ মন নিয়ে ইলেক্ট্রিক কেটেলে চা চড়াল। এক মিনিটের ভেতরেই ভোস ভোস করে পানি ফুটা আরম্ভ করেছে। সেই শব্দ ভেদ করে ড্রইং রুম থেকে ফেরদৌসের গলা ভেসে আসছে। তৃণা দরজার কাছে আসতেই ওদের কথোপকথন স্পষ্ট শুনতে পেলঃ
‘লাশ কি আইডেন্টিফাই করা গেছে?’
‘না স্যার, এখনো যায়নি’
‘কোন ট্রাইব?’
‘মারমা স্যার’
‘তাও ভালো। চাকমা হলে আগড়ম বাগড়ম বেশী লাগে। দোচোয়ানি কই?’
‘জী স্যার?’
‘তোমাকে না বললাম শনিবার পার্টি হবে দোচোয়ানি লাগবে?’
‘দোচোয়ানি?মঙ্গলবার আসবে স্যার। স্যার ডেড বডি কি করব?’
‘কি?’
‘ডেড বডি কি করব স্যার?রেইপ কেইস, পরে ঝামেলা লাগবে স্যার।’
‘পুলিশ কি করছে?ওরা হ্যান্ডল্ করে না কেন?’
‘আমাদের লোক ইনভল্ভ্ড্ স্যার’
‘হাউ ডু দে নো দ্যাট’
‘উইটনেস আছে স্যার’
‘উইটনেস?চাকমা?’
‘না স্যার, বাঙ্গালী’
‘বাঙ্গালী?তাহলে উইটনেস বলছ কেন? দোচোয়ানি কয়টা অর্ডার করেছ?’
‘দোচোয়ানি?ছয় বোতল স্যার। হবে তো?’
’হুম, হয়েও থাকবে। থ্যাঙ্ক ইউ লেফটেন্যান্ট, ইউ আর ব্রিলিয়ান্ট। কর্নেল সিরাজ বলেছে রেড ওয়াইন আনবে। তুমি আসছ তো শনিবার?’
‘জী স্যার। স্যার ডেড বডির ব্যাপারটা, উইটনেস…’
তৃণা চা হাতে ড্রইং রুমে ঢুকতেই আলাপ থেমে গ্যালো। কর্নেল ফেরদৌস বললোঃ
‘তৃণা তুমি চা আনতে গেলে কেন, ওরা কোথায়?’
‘ছুটিতে, বিকেলে আসবে। আমরা তো আগে পৌঁছে গেছি। ’
তৃণা চলে যেতেই ক্যাপ্টেন রিমন প্রসঙ্গে ফিরে এলোঃ
‘উইটনেস পেচকি লাগাচ্ছে স্যার। থানায় জিডি করবে। ওসি জিডি নেয় নাই।’
‘জিডি করবে, প্রমান কি?’
‘উইটনেস মোবাইলে ছবি তুলেছে’
‘ছবি?’
‘ভিডিও ক্লিপ স্যার…কিন্তু কোথাও পাঠাতে পারে নাই।’
কর্নেল ফেরদৌস জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
লেফটেন্যান্ট রিমন এইবার চোখ ছোট করে বললোঃ
‘মোবাইলে সিগন্যাল নাই। সিগন্যাল থাকলে এতক্ষণে ফেইসবুক, ইউটিউব হয়ে মানবাধিকার কমিশনে চলে যেত স্যার। এই সিভিলিয়ান হারামজাদা ইঞ্জিনিয়ার, ঢাকা থেকে এসেছে সিগন্যাল সারাতে।’
‘ফোনটা কোথায়?’
‘ওসি কনফিস্কেইট করেছে। উইটনেসকেও আটকে রেখেছে। ’
‘হুম, ব্রিং হিম ইন টুমরো।’
‘ঠিক আছে স্যার। ডেড বডি কি করব স্যার?’
‘উইটনেস কাকে আইডেন্টিফাই করেছে?’
‘আগের জন স্যার। ও এক্সপোজড হলে আপনাকেও টানবে স্যার।’
‘কাল দেখব কী করা যায়’
‘জী স্যার, আর ডেড বডি…মর্গে পাঠাবো?’
‘না‘
‘ডিপ ফ্রিজে?’
‘হুম… আগের মত।’

তৃণা চা হাতে রান্না ঘরে। চায়ে আর চুমুক দেয়া হলো না। গা গুলিয়ে বমি আসছে।

৪.লটিয়া শুটকি
হলিউডের সিনেমা দেখে ইন্টারোগেশন রুম সম্পর্কে জামিলের মনে একটা পূর্ব-ধারণা জন্মে ছিল। ইন্টারোগেশন রুমগুলো খুব ছোট হবে। ঘরের ভেতর কতগুলো লোহার চেয়ার আর টেবিল থাকবে। টেবিলের একপাশে আয়না থাকবে পুরো দেয়াল জুড়ে। আয়নার পেছন থেকে সব দেখা যাবে।

প্রায় আঠারো বাই চব্বিশ ফুটের এই ঘরটা নিশ্চয় ইন্টারোগেশন রুম না। ঘরের ঠিক মাঝে একটা বার্মাটিকের টেবিল আর দুটো থ্রী-সিটার সোফা। সোফার কোনায় একটা লম্বা ফ্লোর ল্যাম্প দিনের বেলায়ও জ্বলছে। উল্টোদিকের দেয়ালে ৪২ ইঞ্চি এল সি ডি টিভি। টিভির নীচে বেমানানভাবে রাখাএকটা লম্বা ডিপ ফ্রিজ। বাম পাশের দেয়ালে চিতা বাঘের চামড়া ঝুলছে।
উৎকণ্ঠার রেশ কমতেই জামিলের চোখে রাজ্যের ঘুম নেমেছে। তন্দ্রাভাবটা তীব্র হয়ে মাথাটা যেই সোফায় নুইয়ে পড়ছে ঠিক তখনি কর্নেল ফেরদৌস ঘরে ঢুকলেন। কর্নেলের হাতে একটা মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোনটা জামিলের দিকে এগিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেনঃ
‘এটা আপনার?’
‘জী’
‘আই ফোন ফাইভ এস, ওয়াও, দারুন, না?’
‘জি, অফিস থেকে দিয়েছে।’
‘ক’টা ভিডিও ক্লিপ রাখা যায় এতে?’
‘বলতে পারব না।’
‘শেষ ক্লিপ্টা কী আপনার তোলা?’
‘জী। আপনি কে?’
কর্নেল ফেরদৌস পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। জামিলের দিকে প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বললেনঃ
‘চলবে?’
‘আমি স্মোক করি না।’
কর্নেল ফেরদৌস সিগারেট ধরালেন। জামিলের দিকে গুইসাপের মত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাতাসে একটা ধোঁয়ার রিং ছুঁড়ে দিলেন। তারপর কথার রঙ পাল্টে বললেনঃ
‘ভিডিওটা কি করবেন?পত্রিকায় পাঠাবেন?’
‘কে আপনি?’
‘পত্রিকায় গেলে কি হবে জানেন?’
‘এখানে কি হচ্ছে তার টিপ অফ দা আইসবার্গ জনগণ জানতে পারবে’
কর্নেলের স্বর হঠাৎ পালটে গেলো। শীতল গলায় বললেনঃ
‘কি জানবে?আমরা আদিবাসী মেয়ে ধরে ধরে রেইপ করি?’
‘করেন নাকি?’
কর্নেল হঠাৎ ছুটে এসে জামিলের গলা চেপে ধরেছেন,
‘কপি কোথায়?’
‘কি করছেন?গলা ছাড়ুন।’
‘কপি কোথায়?
‘বলব না। এটা ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি, আমার রাইট আছে।’
‘সিভিলিয়ানের বাচ্চা সিভিলিয়ান, নীতি দ্যাখাস?লেট মি টেল ইউ দা ট্রুথ, ইট ইজ আওয়ার পলিসি টু ভায়োলেইট দেম সিস্টেমেটিক্যালী অ্যান্ড ক্রিয়েট অ্যা মিক্সড্ রেইস। দিজ ইস হাউ উই ডু কালচারাল অ্যাসিমিলেশন। তোর মত একটা ট্রেইটর সেটা আটকাতে পারবে না।’
কর্নেলের হাতের মুঠো ক্রমশঃ শক্ত হচ্ছে।
শেষ নিঃশ্বাসটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় জামিলের মাথায় একটা কথাই ঘুরছিলঃ মা’র জন্য এবার চিটাগং থেকে লটিয়া শুটকি নেয়া হলো না।

৫. পূর্ণিমা
পার্টির শেষ পর্ব ছিল ছাদে পানাহার। পানপাত্র শূন্য করে অতিথিরা বিদায় নিয়েছে। কর্নেল ফেরদৌস তৃণাকে নিয়ে এখনো ছাদে রয়ে গ্যাছে। আকাশে ন্যাপথলিনের মত ফকফকা চাঁদ হ্যাজাকবাতির মত আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোয় কর্নেলের গ্লাসের স্বচ্ছ পানীয়টি ক্রিস্টালের মত চকচক করছে।
এই ক’ বছরে এখানকার এই একটা জিনিসই কর্নেল ফেরদৌস পছন্দ করেছে, দোচোয়ানি। দু গেলাস দোচোয়ানি গেলার পর ওর মশার কয়েলের মত প্যাঁচানো মনে একটা তিক্ত ভাব বিষাক্ত ধোঁয়ার মত কুণ্ডলী পাকিয়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়। গলা ছেঁড়ে গাইতে ঈচ্ছে করে ‘দুনিয়াকো লাথ মারো/ দুনিয়া তুমহারি হ্যায়’। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের পশ্চাৎদেশে কশে লাথি মারলে ওর মিলিটারি বুট জোড়া শান্তি পেত। শান্তির কথা ভাবতেই মেজাজটা আরও বিগড়ে গ্যালো। শান্তি বাহিনীর কথা মনে পড়লো। ‘উই উইল ক্র্যাশ দা রিমেইনিং ফ্র্যাকশনস অফ দা ব্লাডি শান্তি বাহিনী। জে এস এস, ইউ পি ডি এফ…অল। উই উইল ডিভাইড দেয়ার মেন, উই উইল ভায়োলেইট দেয়ার উইমেন’।
একটা ঝাপসা ছায়া ওর দিকে টলতে টলতে এগিয়ে আসছে। ক্রমশঃ ছায়াটি পরিস্কার হলো। তৃণা। দু চুমুক দোচোয়ানি গিলিয়ে দিতেই কেমন বিগড়ে গ্যাছে মেয়েছেলেটা। লাটিমের মত টলতে টলতে ছাদময় ঘুরছে। তৃণা কাছে এসে চেয়ার টেনে বসলো। বললো,
‘ফেরদৌস, কান পেতে শোন আমার হৃদয়ে বাজছে আনন্দের তোপধ্বনি।’
‘কামান দাগা আনন্দ দেখা যাচ্ছে।’
‘হবে না কেন?দ্যাখো কি দোর্দণ্ড প্রতাপ আজ চাঁদের। চাঁদ যেন এক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। ওনার নির্দেশে নন-কমিশন্ড জোছনার কণাগুলো প্যারাট্রুপারের মত দল বেঁধে আকাশ থেকে নামছে। সবুজ উর্দি পরা উপত্যকা জুড়ে তাই রুপালী আলোর কুচকাওয়াজ। দেবদারু গাছগুলো সুবেদারদের মত সার বেঁধে দাঁড়িয়ে ব্রিগেডিয়ার চাঁদকে গার্ড অফ অনার দিচ্ছে। স্যালুট ব্রিগেডিয়ার চাঁদ, স্যালুট রাঙ্গামাটির বৃক্ষবাহিনী, স্যালুট কর্নেল ফেরদৌস।’
কর্নেল সতর্ক হলো। মেয়েছেলেটা পাগলাপানির অছিলায় ওর সঙ্গে মকারি করে নিচ্ছে। শান্তি বাহিনীর চর না তো? সি নিডস আ গুড লেসন, সুনার দ্যান লেইটার। কর্নেল বিরক্ত মুখে বললঃ
‘তোমার কথা সারকাস্টিক শোনাচ্ছে।’
‘সারকাস্টিক হচ্ছি না স্বামী-কাম-সমর দেবতা। পার্বত্য চট্টগ্রামের মত আমিও আমার নারী সত্ত্বার প্রকাশকে মিলিটিসাইজ্ড্ করছি।’
বহু দূরে একটা আবছা উপত্যকায় অসংখ্য আলোর বিন্দু জোনাকির মত মিটমিট করে জ্বলছে। তৃণা সেদিকে তাকিয়ে আছে আর ওর গাল বেঁয়ে মাধবকুণ্ডের ঝর্ণার মত শীর্ণ একটা জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। কর্নেল বলেই ফেললেন,
‘ডিসগাস্টিং।’

৬. সমাপ্তি কিম্বা যে গল্পের শেষ নেই
খদ্যোত-খোচিত উপত্যকাটির নাম লিলাইছড়ি। লিলাইছড়ির মানুষের চোখে আজ ঘুম উধাও। রাত পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাশু মারমার মেয়ে শেফালীর ঘরে ফেরার নাম নেই।
সাংগ্রাই উৎসবের শেষ দিন ছিল কাল। পুরো পাহাড় আর উপত্যকা মজে ছিল জলকেলির আনন্দে। শেফালীর গায়েও ছিল উৎসবের ভেজা সাজ। বৃদ্ধা থই মারমা সবিতাকে দেখেছিল ক্যায়াং ঘর থেকে বেরিয়ে ফুল হাতে ঝর্নার দিকে যেতে। এই গ্রাম ঘেঁষে বড় কোন নদী নেই। কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকেই শেফালী বিজু উৎসবের মত করে ঝর্ণার জলে ফুল ভাসায়। দেবতার উদ্যেশে ফুল ভাসাতে শেফালীর খুব বেশী ভালো লাগে। ঝর্ণার ওপারে সরকারী রেশন খাওয়া বাঙ্গালী সেটেলারদের আনাগোনা। ওদের চোখের নজর থেকে শুরু করে হাত নাড়াচাড়া সবই কেমন ইশারা ইঙ্গিতময়। কি এক অজানা আতঙ্কে থই মারমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
রাতে ফানুস ওড়ানোর কথা ছিল। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ- নানা রঙের ফানুস। ফানুস জ্বালানো হলো কিন্তু ওড়ানো আর হলো না। অসংখ্য আকাশ-প্রদীপের না ওড়ানো আগুন এখন উদ্বিগ্ন আলো ফেলে শেফালীকে খুঁজছে ।
আলো-অন্ধকার ছিঁড়েফুঁড়ে রাতের প্রথম আর্তনাদটা ভেসে এলো বুড়ো কংচাই মারমার কণ্ঠ থেকে। সবাই ছুটে গ্যালো ঝর্ণা বরাবর । ঝর্ণার ধারে বুড়োটা অথর্বের মত হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে। পাশেই একটা পাথরের চাইয়ের উপর থোকায় বাঁধা টকটকে লাল জবা ফুল। বুড়োর হাতে ঝর্ণার ধারে কুড়িয়ে পাওয়া শেফালীর এক পায়ের ঘুঙুর। বুড়োর মাথার ঠিক নেই। এমন সঙ্কট কালে একমাত্র নাতির ঘুঙুরটিতে হাত বোলাচ্ছে আর বিড়বিড় করে গাইছেঃ
‘য়েল য়েল আমা দেজ মোন-মুড়োগুন
য়েল য়েল আমা দেজ ঝারানি
রাঙা রাঙা মানজোর মনানি।’

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত