ছাত্রী

ছাত্রী

স্যার আপনার চেহারা-মুখ দেখে মনে হচ্ছে সারাদিনে আপনার পেটে কিচ্ছু যায়নি। এইভাবে না খেতে খেতে আপনার পেট একেবারে পিটের সাথে লেগে গেছে দাঁড়ান আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসছি। না থাক লাগবে না। এত দরদ দেখাতে হবে না তুমি তোমার পড়া পড়ো। তাহলেই হবে। ধুর স্যার শুধু পড়া আর পড়া। আচ্ছা এত পড়ালেখা করে কি হবে? শেষে আপনার মত কারো গলায় ঝুলতে হবে।কিহ !! যত বড় মুখ না ততবড় কথা। নাজীফা তুমি কিন্তু দিনদিন পাকনা হয়ে যাচ্ছো। স্যার আমি কাল রাতে কি স্বপ্ন দেখছি জানেন? আমার জানা দরকার নাই। তুমি পড়তে বসো সময় খুব অল্প। না শুনলে আমি পড়বো না। এখন কি করবেন..? বিরক্ত হয়ে বললামঃ- কি বলবা বলো। দুই মিনিটে শেষ করতে হবে। দুই মিনিটে স্বপ্নের কথা বলা যায় স্যার..?? আচ্ছা যতক্ষণ মন চায় ততক্ষণ বলো। আজ আর পড়া হবে ন শুধু তোমার স্বপ্নের কথা শুনবো।

সেদিন আর পড়া হয়নি। মেয়েটা একটু পাগলী টাইপের। তবে অনেক ভালো, আমি কি করি না করি, আজকে খেয়ে আসছি কি না এসব খোঁজ নেয়। তাই এদিক দিয়ে মেয়েটাকে আমার একটু ভালো লাগে। কিন্তু একটা কথা আছে না। পড়ার সময় পড়া,খেলার সময় খেলা, গল্প করার সময় গল্প করা। এদিক থেকে মেয়েটা ভিন্ন। পড়ার সময় আমার সাথে গল্প করা শুরু করে দেয়। যদি পরিক্ষার সময় ফেইল মারে তাহলে সব দোষ আমার উপর আসবে। তার মা-বাবা বলবে এতদিনে মেয়েকে কি শিখিয়েছি। মেয়েটা যে পড়ার নাম করে আমার সাথে ইটিস-পিটিস করতে আসে সেদিকে খেয়াল নেই।

পরেরদিন আজ একটু আগেই পড়াতে আসছি। একটু আগে চলে যাবো বলে। দেরি করে আসলে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আর এই এলাকাটা একদম ভালো না। দিনেদুপুরে ছিনতাই, ডাকাতি হয়। রাতে তো কোনো কথাই নাই। আমাকে দেখে নাফীজা বললোঃ- স্যার আজ একটু আগেই চলে আসছেন যে…? একজনের সাথে দেখা করবো তাই আজ আগে আসছি আগেই চলে যাবো। কার সাথে দেখা করবেন স্যার..? কোনো মেয়ের সাথে নয়তো..? হ্যা একটা মেয়ের সাথে দেখা করতে হবে। মুখটা অন্ধকার করে বললোঃ- মেয়েটা আপনার কি হয়.? এতকথা কেমনে বলো নাফীজা..? কষ্ট হয় না? স্যার আমি যা বলছি তার উত্তর দিন নয়তো আমি আপনাকে এখান থেকে যেতে দিব না। আজব ! আমার বান্ধবী ফারিহা। একসাথে পড়তাম। তার স্বামীকে নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে আসছে।

এইবার খুশি তো..? অনেক খুশি। আরেকটা প্রশ্ন স্যার আবার কি প্রশ্ন..? এতদিন ধরে আপনাকে চিনি, আপনার পড়া পড়ে আমি অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছি। এত প্যাঁচাল না পেঁচিয়ে সোজাসুজি বলো। স্যার আপনার দেশের বাড়ি কই। কিশোরগঞ্জ, কেন..? এমনি স্যার,,, বিয়ে করলে। বিয়ে করলে কিশোরগঞ্জেই করবা এইতো..? সমস্যা নাই কাল তোমার বাবার সাথে এ বিষয়ে আলাপ করবো। এখন দয়া করে বইটা খুলে বের করে দেখো। নাফীজা মেয়েটা আমার জন্য অনেক পাগল হয়ে গেছে। মেয়েটার সামনে অন্য আরেকটা মেয়ের কথা বললে। খুব রাগ করে মুখটা আকাশের মেঘের মত কালো হয়ে যায়। ভাবছি টিউশনি ছেড়ে দিবো। কিন্তু টিউশনি ছেড়ে দিলে চলবে কি করে?

কিছুদিন পর অনেক কষ্টে, অনেক ধৈর্যের পর একটা চাকরি পেলাম। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এখন আর টিউশনি করবো না। নাফীজাকে আর পড়াতে পারবো না। শেষদিন পড়া শেষে এই কথা বললাম। সাথে সাথে মেয়েটা কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। কান্না শুনে পাশের রুম থেকে তার মা ছুটে আসছে। বললোঃ- কি হইছে কান্নাকাটি করেছিস কেন? চোখ মুছতে মুছতে বললোঃ- স্যার কাল থেকে আর পড়াবে না। নাফীজার মা আমার দিকে তাকিয়ে বললোঃ- কেনো পড়াবে না..? টাকা আরো বাড়িয়ে দিবো সমস্যা নাই। আমি বললামঃ- টাকার জন্য না আন্টি। আমার একটা চাকরি হয়ে গেছে এখন টিউশানি করতে হবে না। নাফীজার মা অনেক কাকুতিমিনতি করে বললো আমিও না করতে পারলাম না। একজন মা আমাকে এত করে বলছে না করি কিভাবে? কিন্তু এখন থেকে আর এই টাইমে পড়াতে পারবো না। রাতে এসে পড়াতে হবে।

পরেরদিন অফিসে জয়েন করতে বাসা থেকে বের হইলাম। পথে নাফীজার সাথে দেখা। স্কুলে যাচ্ছে সাথে বান্ধবীরাও আছে। আমাকে দেখে বান্ধবীরা হাসাহাসি করছে। নাফীজা তার এক বান্ধবীকে চিমটি দিয়ে ফিসফিস করে কি জানি বললো। তারপর থেকে তারা চুপচাপ। একপর্যায়ে নাফীজা মুচকি হেসে বললোঃ- স্যার আপনাকে অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে। স্যার ঠিক এইভাবে সেজেগুজে আমাকে পড়াতে আসবেন। আমি কি তোমাদের বাড়িতে শুটিং করতে যাবো নাকি বেড়াতে যাবো? যে এত সাজগোজ করতে হবে। নাফীজা মুখটা ভেংচি দিয়ে বললোঃ- ওকে আসা লাগবে না। ঠিক আছে আর আসবো না। আরে আমি বলছি এত সাজগোজ করে আসতে হবে না। এত ভুল বুঝেন কেন? আচ্ছা আমি এখন যাই আজকে অফিসের প্রথম দিন তাই একটু আগেই চলে যাই। স্যার সাবধানে যাইয়েন আর সুযোগ পেলে আমাকে ফোন দিয়েন। রিক্সা থেকে পিছনে থাকিয়ে বললামঃ- তোমাকে ফোন দিব কেন?  এমনি,, ছাত্রী হিসেবে স্যারের একটু খোঁজ নেওয়ার জন্য। তোমার খোঁজ না নিলেও চলবে। এই বলে নাফীজা থেকে আমি অনেক দূর চলে গেছি। আমার কথাটা শুনছে কিনা জানি না।

অফিস শেষ করে বিকেল ৫ টায় বাসায় আসলাম। রুমে কিছুই ছিলো না যে খেয়ে পড়াতে যাবো। বাইরে থেকে শিঙাড়া নিয়ে খেতে খেতে হাটতে লাগলাম। অনেক লোক আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। তাকানোর কথাই এইভাবে কেউ খায় নাকি। কিন্তু কেউ আমার অবস্থাটা বুঝবে না। নাফীজাদের বাসায় ঢুকতেই হেচকি শুরু হলো। আমাকে দেখে নাফীজা পানি নিয়ে আসলো। তারপর মাথায় আস্তে করে হাত বুলিয়ে দিলো। হেচকি এমন একটা জিনিস এত সহজে যায় না। হেচকি নিয়েই নাফীজাকে পড়াতে বসলাম। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বললোঃ-স্যার আপনি মনে হয় আর বাঁচবেন না। বলতে বলতে কেঁদে দিলো। আমি ধমক দিয়ে বললামঃ- এই মেয়ে হেচকি উঠলে মানুষ মরে যায় কই শুনছো? আর আমি বাঁচবো নাকি মরবো তাতে তোমার কি..? আমার ধমকি শুনে নাফীজার মা-বাবা দুজনেই এখানে আসলো।

আমি কথা ঘুরিয়ে বললামঃ- আপনাদের মেয়েকে বুঝান ঠিকমত পড়ছে না। সামনে পরিক্ষা এখন থেকে আরো ভালো করে পড়তে হবে। তারপর নাফীজার মা-বাবা তাকে ধমকি দিয়ে কয়েকটা কথা বলে চলে গেলো। যেতে না যেতেই নাফীজা অট্টহাসি দিয়ে বললোঃ- স্যার এই কারণেই আপনাকে আমার ভালো লাগে। নাফীজার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললামঃ- কোন কারণে..? এইযে আপনি কত সুন্দর করে মিথ্যে কথা বলে আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন। আমি আমার মানসম্মানের কথা চিন্তা করে বলছি। স্যার পাশের বাসার রিহান ভাই নতুন বিয়ে করছে চলেন বউ দেখে আসি। আমি আপনাকে নিয়ে দেখবো বলে এখনো দেখতে যাইনি। আমি কি তোমার বন্ধু নাকি প্রেমিক..? যেখানে তোমার ইচ্ছা হয় সেখানেই যেতে বলবে..? সরি স্যার। তাড়াতাড়ি বই বের করো। এইটা কি বই বের করছো? বই দেখে আমার মাথা ঘুরে গেলো,,, “স্যারকে পঠানোর টিপস” নাফীজা তাড়াহুড়ো করে বইটা লুকিয়ে ফেললো। স্যার এইটা আমার না। এইটা তোমার নাকি অন্য কারো সেটা আমার জানা দরকার নাই। কাল থেকে আর পড়াতে আসবো না।

দাঁড়ান,, আপনি নিজেকে কি মনে করেন..? স্যার হয়ে গেছেন বলে আপনি যা ইচ্ছা তাই করবেন..? ছাত্রী হিসেবে স্যারকে ভালো লাগতেই পারে এটা দোষের কিছু না। যেদিন প্রথম আপনি আমাকে পড়াতে আসেন সেদিন থেকেই আপনার প্রতি আমার ভালো লেগে যায়। এতদিন ধরে আপনি আমাকে পড়াচ্ছেন কোনোদিন বলতে পারবেন আমাকে ভালোভাবে পড়াইছেন..? কারণ আপনি পড়াতে আসলে পড়তে মন চায় না। আপনি আসলে মন চায় পড়ালেখা বাদ দিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। নীরব একটা জায়গায় বসে দুজনে প্রেম করবো। আর একটা কথা হলো। জুনিয়র ছেলেরা যদি ম্যাডামের সাথে প্রেম করতে পারে তাহলে আমি স্যারের সাথে প্রেম করতে পারবো না কেন..? নাফীজার কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

মেয়েটা যে এত কথা জানে আগে জানতাম না। আমাকে পঠানোর জন্য। “স্যার পঠানোর বই কিনে আনছে। সবে মাত্র ক্লাস দশে পড়ুয়া মেয়ে যে এতকিছু জানে তা আমার আগে জানা ছিলো না। মেয়েটার সামনে এস.এস.সি পরীক্ষা এখন তাকে পড়ায় মনোযোগ দেওয়া দরকার। পরেরদিন অফিস যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে আছি নাফীজার জন্য। মেয়েটাকে একটু বুঝাবো বলে। মিনিট দশ মিনিট পর নাফীজা ও তার বান্ধবীরা এদিকে আসছে। কাছে আসতেই নাফীজাকে নিয়ে একটু এদিকে আসলাম। বললামঃ- সামনে তোমার পরিক্ষা মন দিয়ে পড়ালেখা করো বাকিটা পরিক্ষার পর জানাবো। স্যার বাকিটা প্লিজ এখনি জানান না। প্লিজ স্যার। সারপ্রাইজ আগে বলা যায় না। ওকে,, থাক বলতে হবে না। তারপর আমি নাফীজাকে ভালোবাসি বলে একটা রিক্সায় উঠে পরলাম। পিছনে চেয়ে দেখলাম নাফীজা খুশিতে নাচতে লাগলো।

রাতে পড়াতে আসার সময় অনেক লজ্জা করছিলো। দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েদের মত লজ্জা লাগছে। অবশেষে দরজায় কলিং বেল চাপ দিতে দেরি হইছে খুলতে দেরি হয় নাই। নাফীজা আমার অপেক্ষায় ছিলো। মেয়েটা আজ নীল শাড়ি পরছে। শাড়িতে নাফীজাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। বললামঃ- শাড়ি পরছো কেন..? বুঝেন না কেন পরছি..? না, একটু বুঝিয়ে দাও।

স্যার আপনার হাতে কিসের বই..? তুমি যেমন স্যার পঠানো টিপসের বই পরে আমাকে পঠিয়েছো আমিও পাগলী মেয়েদের শায়েস্তা করার বই পরে তোমাকে শায়েস্তা করতে আসছি.. এই বলে আমি হাসতে লাগলাম। আমার হাসি দেখে নাফীজা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। মনে হচ্ছে এক্ষুণি আমাকে ভাজি করে ফেলবে। তারপর মেয়েটা আমার কাছে এসে বুকের মধ্যে কিল,ঘুষি দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললোঃ- শয়তান স্যার।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত