আয়না নায়আ

আয়না নায়আ

প্রচন্ড আলোর ঝলকানিতে চোখ মেলে তাকাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল সূর্য বুঝি একেবারে চোখের সামনে এসে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। আমি আবার চোখ বন্ধ করলাম। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। পিঠে কেমন যেন চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে। আমি আবারো চোখ মেলে তাকালাম। এবার আর কোন আলোর ঝলকানি নেই। আমার মুখের উপর কয়েকজন ঝুঁকে আছে। হয়তো ভেবেছে আমি মারা গেছি। আমাকে চোখ মেলতে দেখে একজন চিৎকার করে অদ্ভুত ভাষায় কি যেন বললো। যা বললো তা অনেকটা এমন,

— ছেয়েকিতা লেমে খচো ও, ডগ ইমা ও।

সাথে সাথে কয়েকজন একসাথে আমার চেহারার উপর ঝুঁকে পড়ে অদ্ভুত ভাষায় বাদানুবাদ করতে লাগলো। একটা মেয়ে এসে হঠাৎ একটা টর্চ এনে আমার চোখের উপর আলো ফেললো। সাথে সাথে আবার আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। তারপর আবার আমি চেষ্টা করলাম চোখ খোলার। কিন্তু এবার আর চোখের পাতা খুলতে পারলাম না। মনে হচ্ছে কেউ আঠা দিয়ে দুচোখের পাতা এক করে জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে।

— বেরক তিক্ষ নকো রদেমাআা সে?
— ইনে তামক্ষ ইসে রও।
— ছেগে য়েমিঘু কি ও?
— তচিউ য়াওযা য়েমিঘু।
— ওযা জেকা রযা রযা ইবাস।

নিজেদের মধ্যে কি সব কথা বলছে ওরা কে জানে। নিশ্চয়ই আমি ঘুমিয়ে আছি এবং কোন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছি। এখনি হয়তো চোখ খুলে দেখবো যে আমি শুয়ে আছি আমার বিছানায়। সিলিংয়ে ঝুলছে একটা মরচে ধরা ফ্যান আর ঝুলছে একটা বাদুড়।

আমি আবারো চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু এবারো ব্যার্থ হলাম। তবে এবার আর আমি জেগে থাকতে পারলাম না। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

— আবির তোমার সাথে এটাই আমার শেষ দেখা। হয়তো আর দেখা হবে না।
— রোদেলা আমাকে একটা সুযোগ দেয়া কি দরকার ছিলনা? আমি হয়তো চেষ্টা করলে তোমার বাবা মাকে রাজী করাতে পারতাম।

— তোমাকে অনেক সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছিলে। তাই আর তোমাকে সুযোগ দেয়ার সুযোগ আমার নেই। ভাল থেকো।

— রোদেলা যাওয়ার আগে শেষ বারের মত আমাকে জড়িয়ে ধরবে না?

— আমার অালিঙ্গনে আবদ্ধ হওয়ার অধিকার তোমার আর নেই আবির। আমি চললাম। আর হ্যা শোনো, আমার বিয়েতে আসবে না। আমার বরের চেহারা দেখে লজ্জা পাবে।

রোদেলা আমাকে রেখেই চলে গেল। আমি রোদেলার পথপাণে চেয়ে আছি। অাশ্চর্য আমার একটুও কান্না পাচ্ছে না। একটুও মন খারাপ হচ্ছে না। রোদেলার প্রতি ঘৃনা হচ্ছে না। কারন এখানে রোদেলার দোষ নেই। কারন রোদেলা আমাকে ওর বাবা মায়ের সাথে কথা বলার অনেকগুলো সুযোগ আমায় করে দিয়েছিল। কিন্তু আমি প্রত্যেকটা সুযোগ হেলায় হারিয়েছি। আসলে আমি বেকার একজন মানুষ। একজন বাবা কখনো তার মেয়েকে বেকার ছেলের হাতে তুলে দেয় না। তো আমি কিভাবে রোদেলার দেয়া সুযোগ কাজে লাগাতাম? আজ যখন রোদেলা চিরদিনের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে তখন আমার মনে কষ্টের বদলে অনুশোচনা হচ্ছে। ইশ সুযোগের সদ্বব্যাবহার করলে হয়তো আজ রোদেলা আমার পাশেই বসে বসে বাদাম খেত আর বলতো,
— বাদামকে ভালবাসার প্রতিক হিসেবে ঘোষনা করলে কেমন হতো?

এসব কথা চিন্তা করতে করতে কখন যে মহাসড়কের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছি তা আমার খেয়াল নেই। হঠাৎ বিকট হর্ণের শব্দে আমার ঘোর কাটলো। একটা বড় ট্রাক সবেগে ছুটে আসছে আমার দিকে। আমি সজোরে লাফ দিলাম রাস্তার পাশের দিকে। কিন্তু শেষ রক্ষা বোধহয় হয়নি। কারন লাফ দেওয়ার পর কি হয়েছিল তা আর আমার মনে নেই।

চোখ খোলার পর কি হয়েছে তাতো আপনারা জানেনই। প্রবল আলোর ঝলকানি, অদ্ভুত সব কথাবার্তা ইত্যাদি।
আমি এখন বসে আছি একটা ছোট্ট কামরায়। যার সবকিছুই সাদা। দেয়াল সাদা, টেবিল সাদা, চেয়ার সাদা এমনকি আমার গায়ের পোশাক ও সাদা। শুধু আমার গায়ের রঙটাই কালো। হয়তো আমি মারা গিয়ে মৃত্যুর পরের জগতে চলে এসেছি। এবং বোধহয় পূন্যবান মানুষদের জগতে চলে এসেছি। সাদা হচ্ছে পবিত্রতার চিহ্ন। মনে মনে অনেক খুশি হলাম। জীবিত থাকা অবস্থায় অনেক পাপ করা সত্বেও আজ আমি এখানে? ভাবতেই অবাক লাগছে।
তিন

— লেএ নেখাএ বেভাকি মিতু না ছিরপা তেঝবু রামআ?
আমার বরাবর একটা অল্পবয়সী মেয়ে বসে আছে। মেয়েটার বয়স কত হবে তা ধরতে পারলাম না। তবে মেয়েটা যথেষ্ঠ পরিমানে রূপবতী এবং একইসাথে মায়াবতী। সাধারনত মেয়েরা রুপবতী হলে মায়াবতী হয়না আবার মায়াবতী হলে রূপবতী হয়না। কিন্তু এই মেয়ে কিভাবে দুটো জিনিস একসাথে পেল? হয়তো মৃত্যুর পরের জগত বলেই এখানে সবকিছুই সম্ভব। মেয়েটার গলার স্বর মিষ্টি। কিন্তু আফসোস তার কথা বুঝতে পারলাম না। কথাগুলো আমার কাছে চাইনিক ভাষা বলে মনে হচ্ছে কিন্তু মেয়েটাকে দেখে চাইনিজ মনে হচ্ছে না। আমি মেয়েটার কথার উত্তরে বলে উঠলাম,

— ওহে রমনী কি বলছো কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি কি চায়নিজ মেয়ে? তোমার নাক কিন্তু বোঁচা না। তোমাদের চায়নায় তাহলে নাক উঁচু মেয়ে আছে?

মেয়েটা হা করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। মনে হচ্ছে মেয়েটাও আমার কথা বুঝতে পারছে না। মেয়েটা হয়তো বাংলা জানে না। আচ্ছা এখানে কি গুগল ট্রান্সলেটর আছে? থাকলে মেয়েটার সাথে কথা বলে ভাব জমানো যেত।
— নিরিপা তেঝবু থকা রমাতো।

— কি বলছো? তুমি কি ইংলিশ জানো? ইংলিশ জানলে ইংলিশে কথা বলো। আমি মোটামুটি ইংলিশ পারি।
— না ছিরপা তেঝবু।

মেয়েটা উঠে চলে গেল। আমি আগের জায়গায় বসে রইলাম। চোখ জ্বালা করছে আমার। মাথার ভেতর ভোতা যন্ত্রনা কিলবিল করছে। মনে হচ্ছে এখনি বুঝি মাথা ছিড়ে দেহ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে গ্যাংনাম স্টাইলে নাচতে শুরু করবে। আচ্ছা মাথার তো হাত পা থাকবে না। তাহলে সে গ্যাংনাম স্টাইলে নাচবে কিভাবে?

এসব কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ সেই মেয়েটা হাতে টুপির মত কিছু একটা নিয়ে আবার আমার সামনে বসলো। একটা টুপি সে নিজের মাথায় পরলো এবং অন্য টুপিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি বাক্যব্যায় না করে টুপিটা হাতে নিলাম। মেয়েটা ইশারায় আমাকে মাথায় টুপি পরতে বললো। আমিও মেয়েটার কথামত মাথায় টুপি পরলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার সাথে সাথে মাথাব্যাথা বন্ধ হয়ে গেল। এই টুপিতে কি মাথাব্যাথা ভাল করার কোন গুণ আছে? তাহলে মেয়েটা মাথায় টুপি কেন পরলো? তারও কি মাথা ব্যাথা করছে?

— তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো?

হঠাৎ মেয়েটা কথা বলে উঠলো। এবার সে স্পষ্ট বাংলায় কথাগুলো বলে উঠলো। মেয়েটা তাহলে বাংলা জানে? নাকি মাথায় টুপি দেওয়ার ফলে তার ভাষা আমার মস্তিষ্কে বাংলা হয়ে ধরা দিচ্ছে?

— বুঝতে পারছি, খুব ভাল করেই বুঝতে পারছি। তুমি তাহলে বাংলা জানো?
— না আমি জানি না।
— তাহলে বাংলা কিভাবে বলছো?
— ল্যাঙ্গুয়েজ কনভার্টারের মাধ্যমে। যেটা এখন তোমার আর আমার মাথায় লাগানো আছে। তুমি ভালমত আমার দিকে তাকাও।

— তাকালাম।
— কি দেখতে পাচ্ছো?
— তোমার ঠোঁট নড়ছে না। তবুও আমি তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি।

— তুমিও কিন্তু কথা বলছো না। তবুও তোমার কথা আমি শুনতে পাচ্ছি এবং উত্তর দিচ্ছি।
এবার আমার খেয়াল হলো যে আমি কথা বলছি না। আমার মনের ভেতর যেসব কথা চলছে সেগুলো আমার সামনে বসা মেয়েটা শুনতে পাচ্ছে। এবং খুব স্পষ্টভাবেই শুনতে পাচ্ছে।

— আচ্ছা এখন আমি কোথায় আছি?
— আয়নার ভেতর।
— মানে?
— তুমি আয়নার জগতে চলে এসেছো।

বুঝতে পারলাম মেয়েটা আমার সাথে রসিকতা করার চেষ্টা করছে। মাথার ব্যাথাটা আবার বাড়তে শুরু করেছে। কপালের উপর একটা শিরা থাকে, শিরাটা দপদপ করছে। মনে হয় লাফাচ্ছে।

— তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
— তুমি এখন পৃথিবীতে আছো আবার পৃথিবীতে নেই। তুমি এখন অবস্থান করছো আয়নার জগতে। যেখানে সবকিছুই আয়নার ভেতরে অবস্থান করছে।

— সত্যি এটা আয়নার ভেতরের জগত? কিভাবে বিশ্বাস করবো?
— তোমার সামনেই একটা আয়না আছে। আয়না মুখের সামনে নিয়ে এসো।

সত্যিই আমার সামনেই একটা আয়না রাখা আছে। কিন্তু এতক্ষন আমার চোখে পড়েনি এটা। আয়নার রঙ সাদা। ধবধবে গাঢ় সাদা।

আমি আয়না হাতে নিলাম। এবং চমকে উঠলাম। আয়নায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আচ্ছা এটা কি আয়না নাকি অায়নার মত দেখতে অন্যকিছু?

আমার কাছে খুবই অস্থির লাগছে। অস্থির লাগার কারন অবশ্যই আছে। আমি কোন এক কারনে আয়না জগতে আটকে গেছি বা এসে পড়েছি। কিভাবে আমি এই আয়নার জগতে চলে এলাম তা এখনো বুঝতে পারিনি। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটা চলে যাওয়ায় আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি।
আয়নায় আমি নিজেকে না দেখে মেয়েটাকে প্রশ্ন করেছিলাম,

— এটা তো আয়না না। আয়না হলে তো আমি নিজেকে নিজে দেখতে পেতাম।
— আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে এবার এই জিনিসটা মুখের সামনে ধরো।

মেয়েটা একটা ইটের মত বস্তু আমার সামনে রাখলো। তবে জিনিসটা ইট নয়, অনেকটা ইটের মতই শক্ত এবং ভারী। আমি বুঝতে পারলাম না এই জিনিস মুখের সামনে ধরলে কি হতে পারে।

আমি জিনিসটা মুখের সামনে ধরলাম। আমার চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, অনেকটা আয়নার মত। তবে আয়নার মত এত স্পষ্ট নয়, একটু কেমন যেন ঘোলাটে।

আমি এই ঘটনায় পুরোপুরি অবাক হয়ে গেলাম। কি ঘটছে এসব? কোনকিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার।

— এই জিনিসটা কি?
— তোমাদের পৃথিবীতে এই জিনিসটার নাম ইট । আর আমাদের পৃথিবীতে এই জিনিসটার নাম আয়না। তোমারা যেমন আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখো ঠিক তেমনি আমরা এই ইট দিয়ে নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখি।
— হোয়াট দ্যা… তারমানে তোমারা আয়না দিয়ে দেয়াল বানাও?
— ঠিক ধরেছো।

তারপর হঠাৎ যান্ত্রিক স্বরে কে যেন কথা বলে উঠলো। সাথে সাথে মেয়েটা উঠে চলে গেল। আর আমি অতল ঘুমে তলিয়ে গেলাম। এখন আমি বসে আছি সেই জায়গায় যেখানে মেয়েটার সাথে শেষবার কথা হয়েছিল।
কিছুক্ষন পর মেয়েটা ঘরে প্রবেশ করলো। তারপর আমার মাথায় এবং তার মাথায় একটা টুপি পরিয়ে দিল। মেয়েটাই সবার প্রথম কথা বলে উঠলো,

— শুভ মধ্যরাত্রী।
— শুভ মধ্য…. মধ্যরাত্রী মানে? এখন মাঝরাত?
— হ্যা অবশ্যই মাঝরাত।
— তোমরা ঘুমাও না?

— মধ্যারাতে কি সবাই ঘুমায় নাকি? যারা নিত্যান্তই অলস প্রকৃতির শুধু তারাই মধ্যরাতে ঘুমায়। ওহ বলতে ভুলে গেছি আমাদের এই পৃথিবীতে সবকিছুই উল্টো হয়। যেমন তোমাদের পৃথিবীতে সকাল হলে সবাই জেগে উঠে আর আমরা রাত হলে জেগে উঠি।

— আহা কি নিয়ম। আচ্ছা আমার একটা প্রশ্ন আছে। আমি এই পৃথিবীতে কেন? কিভাবে এলাম আমি এখানে?
— এই প্রশ্নটা আমিই তোমাকে একবার করেছিলাম। তখন তুমি উত্তর দাওনি। এখন বলো তুমি কিভাবে আমাদের এই আয়না পৃথিবীতে চলে এলে?

— বাহ আমার প্রশ্ন আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছো? আমি জানি না আমি কিভাবে এখানে এলাম।
— তাহলে তো সমস্যা। আচ্ছা আসল পৃথিবীতে থাকা অবস্থায় তোমার সর্বশেষ কোন ঘটনাটা মনে আছে।

মেয়েটার এই প্রশ্নে আমি মাথায় তীব্র ব্যাথা অনুভব করলাম। আমি চোখ বন্ধ করলাম। তখনই আমার চোখে ভেসে উঠলো একটা বড় ট্রাক আমার দিকে ছুটে আসছে।

— একটা ট্রাক আমার দিকে ছুটে আসছিল। এটাই শুধু আমার মনে আছে।
— মানে তুমি ট্রাকটার সাথে ধাক্কা দিয়েছিলে?
— নাহ ট্রাকটা আমায় ধাক্কা দিয়েছিল।

— ব্যাপারটা একই। তারমানে তুমি মারা গেছো বা মারা যাচ্ছো। তোমার পুরো শরীর রয়ে গেছে আসল পৃথিবীতে আর তোমার ভেতরের আত্মা কোন এক অজানা কারনে আয়না পৃথিবীতে ঢুকে গেছে। কিন্তু এটার কারন কি?
পাঁচ

আমি এখন বাথরুমে বসে আছি। আমরা যেমন তিনবেলা খাবার গ্রহন করি এই আয়না পৃথিবীতে হয় তার উল্টো। এখানে সবাই নিয়মকরে তিনবেলা হাগু করে।

আমরা যেমন নিম্নচাপে পড়লে হাগু করি ঠিক তেমনি তারা নিম্নচাপে পড়লে খাবার খায়। কি আজব নিয়ম। অনেকক্ষন চেষ্টা করেও কাঙ্খিত ফল লাভ করতে না পেরে বের হয়ে এলাম বাথরুম থেকে। সাথে সাথে সেই মেয়েটাও পাশের একটস ঘর থেকে বের হলো।

— শুভ সকাল, সকালের প্রাকৃতিক কাজ শেষ? তোমার ঘুমের ব্যবস্থা করতে পারি?
— করতে পারো।

— আমরা তোমার মস্তিস্কে একটা নিউরনিক সার্চ মেশিন পাঠিয়েছিলাম। সে তোমার ভুলে যাওয়া কিছু স্মৃতিকে জাগ্রত করার চেষ্টা করছে। হয়তো ঘুমের মাঝে সেই স্মৃতি জাগ্রত হবে। আর সেই স্মৃতির মাঝে হয়তো লুকিয়ে আছে তোমার এই পৃথিবীতে আসার রহস্য।

মেয়েটা আমাকে শুইয়ে দিল। সাথে সাথে আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে লাগলাম। মাথায় একটা নিউরনিক সার্চ মেশিন নিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে। কে জানে কি স্মৃতি জাগ্রত করে?

ঘুমের মধ্যে আমার মাথায় সিনেমা চলতে শুরু করলো। একের পর এক দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। প্রতিটা দৃশ্য আমি নিজ চোখে অবলোকন করেছি পৃথিবীতে।

একটা দৃশ্য দেখে হয়তো ঘুমের মাঝেও আমি হেসে উঠেছিলাম। কারন এই দৃশ্য দেখে আমি আমার আয়না পৃথিবীতে আসার রহস্য সম্পর্কে বুঝতে পেরেছি।
আমার ঘুম ভাঙ্গার পর মেয়েটা আবার আমার সামনে এসে হাজির হলো।

— ট্রাকের সাথে ধাক্কা খাওয়ার আগে তুমি মনে মনে একটা আয়না খুঁজছিলে। হঠাৎ আয়না খোঁজার কারন কি ছিলো?
— মানে? তুমি কিভাবে জানলে এই ব্যাপারটা?

— নিউরনিক সার্চ মেশিন তোমার প্রতিটা স্মৃতির ব্যাপারে অবগত করেছে। এমনি এক বন্ধুর বিয়েতে টয়লেটে ঢোকার পর পানি শেষ হয়ে যাওয়ার…

— থাক আর গভীরে যেতে হবে না।
— তুমি আয়না কেন খুঁজছিলে?

— কারন একটা মেয়ে মানে যাকে আমি ভালবাসতাম সে আমায় ছেড়ে যাওয়ার আগে বলেছিল “আমার বিয়েতে আসবে না। আমার বরের চেহারা দেখে লজ্জা পাবে।” এই কথা শোনার পর একটা আয়না খুজছিলাম নিজের চেহারা দেখার জন্য। আমার চেহারা সত্যিই এতটা খারাপ?

— মানে তোমার মৃত্যুর শেষ মূহুর্তে মস্তিষ্কে তুমি একটা শব্দই বারবার পাঠাচ্ছিলে। আর তা হলো আয়না। একারণেই আজ তুমি আমাদের পৃথিবীতে।

— আমি কি মারা গেছি?

— এখনো যাওনি। তবে তোমার শেষ সময় চলে এসেছে। যেকোন দিন হয়তো তুমি হারিয়ে যাবে কালের গহ্বরে চিরদিনের জন্য। তাই এই কয়দিন এই আয়না পৃথিবীতেই তোমাকে আটকে থাকতে হবে।

আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। তারমানে আর পৃথিবীতে ফেরা হবে না? আর মায়ের মুখ দেখা হবে না? বোনের মুখে ভাই ডাক শোনা হবে না?

মেয়েটা চলে গেল। আর আমাকে শুইয়ে দেয়া হলো বিছানায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি হারিয়ে গেলাম অজানায়।
চোখ খুলে দেখি মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। একটানা ক্যাচক্যাচ শব্দে ঘরের ভেতর মুখরিত। মনে হচ্ছে আমি পৃথিবীতে চলে এসেছি। কিন্তু আমার তো আর পৃথিবীতে আসার উপায় নেই। নিশ্চয়ই এটা আয়না পৃথিবীর বিভ্রম।
হঠাৎ মাথায় সাদা টুপি পরা একটা অল্পবয়সী মেয়ে আমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়লো। ঠিক পৃথিবীর নার্সদের মত। তারপরই একটা বিকট চিৎকার দিয়ে উঠলো সে।

— রোগীর জ্ঞান ফিরেছে ডাক্তার সাহেব।
আমি আবার ফ্যানের দিকে তাকালাম। আমি কি পৃথিবীতে চলে এসেছি? কিন্তু ওই মেয়েটা তো বলেছিল আমি মারা যাবো, হারিয়ে যাবো অতল গহ্বরে। নাকি মেয়েটা মজা করেছিল আমার সাথে? তাছাড়া মেয়েটার নাম জানা হয়নি।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত