দেবদাস

দেবদাস

মিথি আর সজলের যখন ব্রেকাপ হলো আমরা তো অবাক।

ওদের দুজনের ব্রেকাপ হতে পারে এটা আমরা কস্মিনকালে ও ভাবি নি।।

ওরা ছিলো আমাদের ব্যাচের একদম যাকে বলে পারফেক্ট কাপল।
আর ওদের কিনা ব্রেকাপ হয়ে গেলো। এত বছরের সম্পর্ক ওদের!

তখন আমরা বন্ধুরা পড়লাম এক অদ্ভুত দোটানায়।

মিথি আর সজলের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ওরা দুজন ই যেহেতু আমাদের বন্ধু যেকোনো কিছুতেই দুজন কেই রাখতে হত।

কিন্তু এমন বিরূপ পরিস্থিতি তে দুজন কে নিয়ে এক ছাদের নিচে বসা মানে মাথা ফাটাফাটি ও হয়ে যেতে পারে এমন অবস্থা ছিলো।

কি নিয়ে ওদের ব্রেকাপ এটা ও খোলাসা করে বলে নি দুজনের কেউ ই।

ওদের এক করতে না পেরে আমরা ভাবলাম আলাদা আলাদা কিভাবে দুজনের সাথেই বন্ধুত্ব বজায় রাখা যায়।

কিন্তু ব্যপার টা আসলে অনেক কঠিন ছিলো।

এরই মাঝে আরো কঠিন হয়ে গেলো যখন সজল দুম করে ভার্সিটি তে আসা বন্ধ করে দিলো।

ফোন বন্ধ। আমরা বুঝতে পারলাম ও দেবদাস হতে চলেছে।

আমাদের বন্ধুদের মাঝে একটা ব্যাপার সব সময় ছিলো যেকোনো বিপদে বা দুঃসময়ে যে করে ই হোক সে বন্ধুকে টেনে ওঠাতে হবে সবাই মিলে।

সবাই মিলে আলাদা আলাদা মিথি আর সজল কে সাপোর্ট দেয়ার জন্য লেগে গেলাম।

সজল আর আমার বাসা পাশাপাশি ছিলো। তাই সজল কে প্রতিদিন কান ধরে ভার্সিটি তে নিয়ে আসার মহান দায়িত্ব টা আমার ই পড়লো।

সজলের অবস্থা একদম শোচনীয় হয়ে গেলো। ও নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দাঁড়ি না কামিয়ে একদম গোল্লায় গেছে।

আমি যখন ওর বাসায় গেলাম ওকে ভার্সিটি তে নিয়ে যেতে আন্টি কেঁদে ই ফেললো ছেলের কি হয়েছে বুঝতে না পেরে।

আমি আন্টিকে আশ্বস্ত করে সজলের রুমে ঢুকলাম। কড়া সিগারেট এর গন্ধে পুরো রুম ভরে ছিলো। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো আমার।

কোনো রকমে ওড়না দিয়ে মুখ চাপা দিয়ে ওই গাধাটাকে বিছানা থেকে টেনে উঠালাম।

সজল আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললো,
” আমার সব শেষ হয়ে গেলো রে জয়া।”

সজল এর চোখ দুটো ফুলে ঢোল হয়ে ছিলো। বুঝতে পারলাম সারা রাত কেঁদেছে। উস্কোখুস্কো চুল।

দেখে খুব মায়া হলো আমার। চোখে পানি চলে এলো।

ওকে কড়া করে একটা ধমক লাগিয়ে আমি আর আন্টি মিলে ওকে ভদ্রস্থ করে কোনো রকমে দুইটা পাউরুটি খাইয়ে ওকে নিয়ে আমি ভার্সিটি
তে গেলাম।

ও কিছুতেই ক্লাস করবে না। আমি ওর পাশে বসে ক্লাসে সারাক্ষণ ওর পায়ের উপর আমার পা দিয়ে রাখলাম যাতে ও পালাতে না পারে। চোখ বুজলেই ওর মাথায় গাট্টা মারলাম যাতে ক্লাসে মনোযোগ দেয়। এভাবে ওকে দিয়ে ক্লাস করাতে লাগলাম।

ক্যান্টিনে ও খেতে চাইতো না আমি জোর করে ওর পাশে বসে ওকে ছোট বাচ্চাদের মতন জোর করে খাওয়াতাম।

আমি জানতাম ও ক্লাসে মনোযোগ দিতো না।

তাই আমি আমার ক্লাস নোট ওকে ফটোকপি করে দিতাম। রাতে বার বার ফোন দিতাম যাতে পড়া শেষ করে।

কিন্তু ও করতো না তাই আমি ওর পড়া ধরা শুরু করলাম। একদিন দুই দিন তাও ওরা কোনো পরিবর্তন নেই।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ক্লাস শেষে লাইব্রেরি তে ওকে পড়াবো। যেই ভাবা সেই কাজ।

এত বড় ছেলে কে পড়ানো তো চাট্টিখানি কথা না। ও খালি আনমনা হয়ে পড়তো। মিথির কথা ভাবতো। তাও আমি হাল ছাড়িনি।

ওকে কড়া মাস্টারনির মতন জ্বালিয়ে মারতাম। ও বাধ্য হত পড়তে।

বন্ধুরা আড্ডা দেয়ার সময় এক প্রান্তে বসতো সজল আর আরেক প্রান্তে মিথি। আমি সজলের পাশে বসতাম সব সময়। ওকে খেয়াল করে রাখতাম। যাতে ও উল্টাপাল্টা কিছু করে না বসে।

মাঝে মাঝে ছুটির দিন গুলো তে সজল যখন মুষড়ে পড়তো ওকে নিয়ে আমি ঘুরতে যেতাম।

এভাবেই মাস ছয়েক কেটে গেলো। আমি লেপ্টে ছিলাম সজলের সাথে।

আস্তে আস্তে সজল স্বাভাবিক হয়ে আসতে লাগলো। ওই দিকে মিথি ও অনেক টাই নিজেকে সামলে নিয়েছিলো।

মোটামুটি তখন আমরা চিন্তা মুক্ত ওদের নিয়ে।

একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমি ভাবলাম, “সজলের এখন নিজের মতই চলা উচিত। আমি আর ওকে জালাতন না করি। ”

এটা ভেবে ই আমি একা একা রিকশা নিয়ে ভার্সিটি তে চলে গেলাম। সকালে সজল কে ঘুম থেকে ওঠার জন্য ফোন ও দিলাম না।

রিকশায় একা আসতে কেনো জানি আমার খুব কষ্ট হলো। ছয় মাস পর আমি একা রিকশায় যাচ্ছিলাম।

আগে ও একা ই যেতাম। কিন্তু মাঝের ছয় মাস আমার রিকশার ডান পাশ জুড়ে বসতো সজল।

অবাক লাগলো নিজের এমন ভাবনায়।

প্রথম ক্লাস পেরিয়ে গেলো। সজল এলো না।
দ্বিতীয় ক্লাস শুরুর খানিক আগে ও ক্লাসে ঢুকলো। ঢুকেই সোজা আমার কাছে এলো।
বললো,

” তুই আমাকে নিয়ে এলি না কেনো?”

” তুই কি ছোট খোকা যে তোকে প্রতিদিন নিয়ে আসতে হবে? তুই এখন থেকে একা একা ই আসবি।”
আমি বললাম।

সজল কোনো কথা না বলে পিছনে চলে গেলো বসতে। আমার পাশে সজল বসলো না।

অথচ গত ছয় মাস ধরে আমার পাশের সীট টা ওর জন্য ই বরাদ্দ। ভালো ই হলো ও নিজের মতন চলুক তখন এটাই মনে হলো আমার। কিন্তু কেমন জানি কষ্ট হচ্ছিলো ।

ক্যান্টিনে সেই আড্ডা চলছিলো আমাদের। সবাই সিংগাড়া, সমুচা , চা খাচ্ছে। আমি চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম। আড়চোখে দেখলাম সজল খাচ্ছে না। আমি ধমকিয়ে উঠলাম,

” খাচ্ছিস না কেনো?”

সজল তখন একটা সমুচা নিয়ে চিবুতে লাগলো।

বাসায় যাওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছিলাম । সজল সামনে এসে দাঁড়ালো বললো,

” তুই কি কোনো কারণে রাগ করেছিস আমার উপর? ”

” রাগ করি নি রে। আমার মনে হলো তুই তোর দেবদাস অধ্যায় কাটিয়ে উঠতে পেরেছিস এখন তুই তোর দেখাশুনা করতে পারবি।”

” ও আচ্ছা। ভালো। দয়া করেছিস এই কয় দিন আমার উপর এই জন্য আমি কৃতজ্ঞ।”

” আমি আসলে এভাবে তোকে বলতে…”
বলে শেষ করতে পারলাম না। চলে গেলো সজল।

খুব খারাপ লাগছিলো আমার। কান্না পাচ্ছিলো। কেনো তাই বুঝতে পারছিলাম না।

শুধু এটা বুঝতে পারছিলাম আমার খুব ইচ্ছে করছে সজলের পাশে থেকে সব সময় ওর দেখাশুনা করতে।
.
কয় দিন সজল ওর মতন ই ছিলো। সব বন্ধুদের সাথে মিলেমিশে । আর আমি আমার মতন।

কিন্তু সজল কে সবার মাঝ থেকে ও আমি খেয়াল করতাম। কেমন জানি অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করতো।

এভাবে ই দিন কয়েক গেলো।

এর মাঝে সজল আবার নিরুদ্দেশ। ওর ফোন বন্ধ। দুদিন ধরে ক্লাসে ও আসছিলো না।

অগত্যা ওর বাসায় আসলাম। ওর রুমে ঢুকতেই কড়া সিগারেট এর গন্ধ। আমি তাকিয়ে দেখলাম ওর চুল উস্কোখুস্কো। ফোলা লাল চোখ।

আমার খারাপ লাগছিলো খুব। ইচ্ছে করছিলো জড়িয়ে ধরে সজল কে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে তোর?

কিন্তু নিজেকে ছোট মনে হচ্ছিলো এসব মনে করে।

সজল আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।

আমি বললাম,
” আবার দেবদাসে পেয়েছে নাকি?”

সজল চুপ।

মিনিট দশেক কেটে গেলো। ও চুপ ই রইলো।

রাগ হলো আমার।

” কিছু তো বল? চুপ করে কেনো?”

ধমকে উঠলাম।

” জয়া তোকে আমার দরকার।”

” বল। আমি তো তোর পাশে ই আছি।”

” এভাবে না। ঠিক যেভাবে আমার দেবদাস কালীন সময়ে ছিলি। না হলে আমি আবার ডুবে যাব রে। আমাকে কেউ আর উঠাতে পারবে না।”

আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না।

গত পঁয়ত্রিশ বছর যাবত সজলের সাথেই আছি।

এখনো মাঝে মাঝে যখন রাগ করে হুমকি দেই বাপের বাড়ি চলে যাবো।

সজল তখন বলে উঠে,
” তুমি চলে গেলে কিন্তু আমি আবার দেবদাস হয়ে যাব কেউ আমাকে আর ফেরাতে পারবে না।”

নাতনীদের তাদের দাদুর আর আমার পুরোনো দিনের গল্প বলে শেষ করলাম এবার ছাদ থেকে নিচে যেতে হবে সজলের ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত