নিরাশার আরও একদিন

নিরাশার আরও একদিন

আজও চাকরিটা হল না ঋকের। গত ছ’মাস ধরে চাকরির খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে সে। বাড়িতে অসুস্হ বাবা আর কর্মরতা মা। আর্থিক অবস্হার অবনতির পরিপ্রক্ষিতে স্নাতকতার প্রথম বর্ষেই কলেজ ছাড়তে হয়েছিল তাকে। তারপর থেকেই চলছে চাকরির সন্ধান।

দিনের পর দিন, একটার পর একটা ইন্টারভিউ দিয়েই আসছে ঋক,কিন্তু একটা নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের “অল্প শিক্ষিত” ছেলেকে চাকরি কেই বা

দেবে। সবাই শুধু কাগজপত্র খুলে দেখে, একবারও কেউ দেখেনা,ঋকের মতো ছেলেগুলোর মনের ভিতরের সত্যিকারের অবস্হাটা।

আজ যে চাকরির ইন্টারভিউটা দিতে এসেছিল সে, সেখানে বাতিল হওয়ার কোন প্রশ্ন হয়ত ছিলনা, তবুও সেই ব্যর্থতা। দিনের পর দিন এগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে, মনের মধ্যে দুঃখ নামক বস্তুটাই
অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছিল। একটা বেপরোয়া ভাব যেন চেপে বসছে তার মাথায়।প্রথম প্রথম

বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়, মা-বাবা আশীর্বাদ করতেন, আজকাল তারাও যেন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সত্যি হয়তো ঋকের দ্বারা কোনদিনই কিছু হবেনা।

অফিস থেকে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগল সে।বিকেল সাড়ে পাঁচটা মতো বাজে।আকাশের কোণ থেকে ঘন কালো মেঘটা ইতিমধ্যেই পুরো আকাশটাকে ছেয়ে

ফেলেছে, ঠান্ডা জোলো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ঋক হাতের কভার ফাইল টাকে আঁকড়ে ধরে হাঁটতে শুরু করল।টিপটিপ করে বৃষ্টি ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। কি কুক্ষনে যে ছাতাটা আজ বাড়িতে ভুলে এলো সে। এদিকে মনে হচ্ছে আজ বেশ ভালোই ভিজবে কলকাতা। সামনে একটা বাসস্টপের শেড দেখে তার নিচে এসে দাঁড়াল ঋক। আর ঠিক সাথে সাথেই যেন ঝেঁপে বৃষ্টিটা শুরু হল। আশেপাশে আরও দু’চারজন পথযাত্রী এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই বাসস্টপে। চারপাশ থেকে বৃষ্টির ফোঁটা অনিমন্ত্রিত অতিথিরমত এসে ঋককে বেশ ভালরকম ভিজিয়ে দিচ্ছিল। সেই সঙ্গে অনবরত মেঘেদের গর্জন। এক অদ্ভুত অসহায় পরিবেশ। তবু মাথার উপর ছাদ থাকার দরুন “কাকভেজা” ব্যপারটা এখনো হয়ে ওঠেনি সে। ভেজা হাতেই পকেট থেকে শেষ সিগারেটটা বার করে, অত্যন্ত সাবধানে

দাঁড়িয়ে টানতে লাগল ঋক।সিগারেটটা শেষের দিকে অগ্রসর হলেও বৃষ্টির শেষ ব্যপারটা ঘন্টাখানেকের আগে হবে বলে মনে হচ্ছিল

না। যদিও তাতে কিছু এসে যায়না তার। কারন সে খুব ভাল করেই জানে তার জন্য কোথাও কেউ অপেক্ষা করে নেই। বাড়িতে সবাই জানে যে তার অন্য কোন যাওয়ার জায়গা নেই, ফিরতে তাকে হবেই। বন্ধুবান্ধবও যে বিশেষ আছে তার, তাও নয়। চিন্তার সাথে সাথে কখন যে চোখের পাশটা ভিজে এসেছে নিজেও খেয়াল করেনি ঋক।হাতের প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটার তাপে সম্বিত ফিরল তার।

পাশ থেকে কেউ যেন তার শার্টটা ধরে টানছে।মুখ ফিরিয়ে ঋক দেখল একটি বছর সাতেকের
বাচ্চা ছেলে। রাস্তাতেই থাকে মনে হয়, গায়ের ময়লা পোশাক দেখে অন্তত তাই মনে হয়।ঋক ফিরে তাকাতে ছেলেটি চমকে গিয়েছিল, সামলে নিয়ে বলল, খুব ক্ষিদে পেয়েছে দাদা, কিছু
খেতে দেবে?”

তুমুল বৃষ্টির মধ্যে একের পর এক বজ্রপাত হয়েই চলেছে।
ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে ঋক বুঝলো, কিছু পাওয়া যাবেনা জেনেই সে এসেছে তার কাছে, তবু যদি কোন অলৌকিক উপায়ে ঋক কিছু দিয়ে ফেলে ওকে। হঠাৎ নিজের কথা মনে পড়ল
ঋকের। চাকরির আশা নেই জেনেও অফিস কর্তাদের দুয়োরে দুয়োরে হন্যে হয়ে বসে থেকেছে সে, যদি কোন অলৌকিক উপায়ে কর্তাদের মনের পরিবর্তন ঘটে।

আবার যে কখন চিন্তায় ডুবে গেছিল, নিজেই খেয়াল করেনি ঋক। তার থেকে কোন উত্তর না পেয়ে অভ্যাসবশতঃ চলে যাচ্ছিল ছেলেটি। ঋক ডাকলো ওকে,”ওই শোন”, ছেলেটি তৎক্ষণাৎ
যেন মন্ত্রমুগ্দ্ধের মতো এগিয়ে এল তার দিকে।
-“নাম কি রে তোর?”
একটু সময় চুপ করে থেকে ছেলেটি বলল,”আলি।”
-“আলি? বেঁড়ে নাম। দাঁড়া।”

বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মা যাতায়াত খরচ ছাড়াও একশোটা টাকা বেশী দিয়ে দেন সব সময়। খুব দরকার না পড়লে সেটা খরচ করতে বারণ করে দেন।

মানিব্যাগ খুলে টাকাটা বার করে ছেলেটির হাতে দিল ঋক,”এটা নে, আর এখন রাস্তায় ঘুরিস না, বাড়ী পালা।”
কথাগুলো শেষ করে ঋক খুব দ্রুত নেমে এল বৃষ্টি ভেজা রাস্তায়।বৃষ্টি তখনও হচ্ছে মুষলধারায়।একটা অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছিল তার।

একবার পিছন ফিরে দেখে নিল ছেলেটি তাকে দেখছে কি না। নাঃ দেখছে না। চলে যাচ্ছে, আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টিতে, হয়ত বাড়ীতেই, অথবা হয়তো আবার ভিক্ষে করতে।

বৃষ্টি ভেজা ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা প্রশ্ন সমস্ত আনন্দের মাঝখান থেকে বেরিয়ে এসে ঋকের মনটা আবার বিষাদে ভরিয়ে দিল।

হঠাৎ একশো টাকাটা ঋক ওকে দিল কেন? ওর সাহায্যের জন্যে, নাকি ওর কাছে নিজেকে খুব বড় হিসেবে প্রমান করার জন্যে।তাই কি টাকাটা ওর হাতে দেওয়া মাত্রই ওখান থেকে বেরিয়ে এল সে?
এতটাই কি স্বার্থপর সে? উত্তর জানা নেই তার।

বৃষ্টিটা ক্রমেই বাড়ছে।সামনের রাস্তাটা বৃষ্টিফোঁটার সাদা চাদরে নিজেকে মুড়ে নিয়েছে। একা নিষ্প্রাণ ভাবে নিজের বড্ড বেশী ভারী হয়ে যাওয়া শরীরটাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঋক।।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত