হত্যাকারী

হত্যাকারী

কিচেন রুম থেকে নারী কন্ঠে গুনগুন করে গাওয়া গানের শব্দ আসছে। এই সময় কাজের বুয়া আমেনা থাকে কিচেন রুমে। কিন্তু এটি আমেনার গলা নয়। আমেনার কর্কশ কন্ঠের কথা শুনতে অস্থির লাগে হাবিবের, এতো সুমধুর কন্ঠে গান গাইবে সে এটা কল্পনাও করতে পারেনা হাবিব। তাছাড়া বাসায় হাবিব আর আমেনা ছাড়া কেউ নেই। কেউ থাকারো কথা না, হাবিবের স্ত্রী আর দুই সন্তান তিন মাস আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে।

গানের সুরটা আরো স্পস্ট হয়ে হাবিবের কানে লাগে। কৌতূহল মেটাতে হাবিব রান্নাঘরের দিকে যায়।আমেনার শাড়ির আঁচলে একটা আগুনের শিখা জ্বলছে হাবিবের চোখ পড়ার সাথে সাথে দাউ দাউ করে আগুন আমেনার পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। আমেনা চোখ বড় বড় করে হাবিবের দিকে তাকায়, চোখ দুটো রক্তিম বর্ন ধারন করেছে। আমেনা চেঁচিয়ে বলে উঠে, “ভাইজান আপনে এহান থেইক্কা যান, আগুন আপনের দিকে বাইয়া আইতাছে।” হাবিব কিছু না বলে সেখান থেকে চুপচাপ চলে আসে। হাবিবের মাথায় কোন কাজ করছে না। কোন অদৃর্শ্য শক্তির বলে সে ওখান থেকে এভাবে চলে এসেছে তাও বুঝতে পারছে না। তার তো উচিত ছিলো আমেনাকে বাঁচানো।

আমেনা চায়ের কাপ হাতে রুমে প্রবেশ করে। “ভাইজান, আপনে চা খাইবেন এইডা কইলে তো অয়। আমি তরকারি রাইখা চা কইরা লইতাম। আপনে কিছু না কইয়া চইলা আইছেন দেইখাই আমি বুঝাবর পারছি আপনে অহন চা খাইবেন।” হাবিব আমেনার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমেনা অক্ষত শরীরে দাড়িয়ে! আমেনার পরনে সেই একই শাড়ি যেটাকে সে পুড়ে যেতে দেখেছিল, কিন্তু উজ্জ্বল লাল শাড়িতে কোথাও একটু পোড়া দাগ দেখা যাচ্ছেনা! হাবিব কিছু বলতে পারছেনা, তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাত দিয়ে ইশারা করে চায়ের কাপটা টেবিলের উপরে রাখার জন্য।

আমেনা চায়ের কাপটা রেখে আবার জিজ্ঞেস করে, “ভাইজান আপনে আইজ কোথায় যাইবেন কইছেন, যাইবেন না?” হাবিব মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোধক জবাব দেয়। আমেনার চোখ মুহূর্তের মধ্যেই লাল বর্ন ধারন করেছে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠে, “ভাইজান আপনে কই যাইবেন? আপনে না আপনের বাপেরে কথা দিছেন আমারে একা কইরা আপনে কোথাও যাইবেন না।” কথাটা শুনে থ হয়ে যায় হাবিব। সে তার বাবাকে এই রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ঠিকই তবে আমেনাকে নিয়ে নয় রিয়াকে নিয়ে।

রিয়া হাবিবের ছোট বোন সাত বছর আগে অগ্নি দুর্ঘটনায় মারা গেছে সে। পাশ থেকে আমেনা আবারো বলে উঠে, “ভাইজান আজকের দিনডার কতা মনে আছে আপনের?” সাথে সাথে পুরোনো সেই সব স্মৃতিগুলো হাবিবের চোখের সামনে ভাসতে থাকে। আজকের এই দিনটাই ছিলো সেইদিন। যেদিন ছিলো রিয়ার আঠারো তম জম্মদিন । হাবিব রিয়ার জন্য একটা লাল শাড়ি এনেছিলো। শাড়িটা পরে রিয়া ভাইয়ের জন্য চা করতে যায় আর অগ্নি দুর্ঘটনায় নিহত হয়। এতটুকু পর্যন্ত সকলে জানে তবে হাবিবের স্মৃতিতে আরো কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। শাড়িটা রিয়াকে পরানোর আগে হাবিবের স্ত্রী পুরো শাড়িতে কেরোসিনের ছিঁটা দিয়েছিলো। হাবিব কিচেন রুমের দরজায় দাড়িয়ে একটা জলন্ত দিশলাই এর কাঠি নিক্ষেপ করেছিল রিয়াকে লক্ষ করে। আগুনের শিখাটি রিয়ার আঁচলে গিয়ে পড়ে আর মুহূর্তের মধ্যে রিয়ার পুরো শরীরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। রিয়া দরজার সামনে হাবিবকে দাঁড়ানো দেখে চিৎকার করে বলেছে, “ভাইয়া সরে যা আগুন তোর দিকে যাচ্ছে।” হাবিব সেদিন সেখান থেকে চুপচাপ হেঁটে আসে। ঠোঁটের কোনে এক পৈশাচিক হাসি দিয়ে মনে মনে বলে, “পাগলী আমি কি তোর সাথে পুড়ে মরবো বলে এখানে এসেছি?” এরপরে অবশ্য হাবিব স্ত্রী সন্তান নিয়ে তার পিতার বাড়িটি ত্যাগ করে। লোকচোখে তার কারণ এ বাড়িতে তাকে তার বোনের মৃত্যুর শোক তাড়া করে তাই এতো দিন এ বাড়িতে পা রাখেনি। কিন্তু আবার এখানে ফিরে আসার কারণ স্ত্রী সন্তানের মৃত্যুর পর কোথাও সে একটু শান্তি পায়নি এ বাড়িটা ছাড়া। হাবিবের ভাবনার দেওয়ালে ছেদ পড়ে আমেনার ডাকে। হাবিব ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখে আমেনা নয় তার সামনে রিয়া দাড়িয়ে! সেই মায়াবতী চেহারার মেয়েটি! ঠোঁটের কোনে মৃধু হাসি! পরনে লাল শাড়ি, আমেনার ময়লা শাড়িটা নয় হাবিবের কেনা দামী শাড়িটি।

“ভাইয়া চলনা আর কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকবি? চলনা কেক কাটতে হবে তো।একটু অভিমানের স্বরেই কথাটি বলে রিয়। কাঁপা কাঁপা গলায় হাবিব বলে উঠে, “রিয়া তু তু তুই এখানে!” রিয়ার মায়াবী চোখ দুটো জ্বলে উঠলো মনে হচ্ছে ওর চোখ দুটো দিয়ে এখনই ভষ্ম করে দেবে হাবিবকে। খুব উত্তজিত হয়ে রিয়া বলতে শুরু করে, “আমার মাকে তুই তোর হিসেবে কখনো ভাবিসনি, আর আমাকে বোন বলে মনে করিসনি। তোর লোভ ছিলো মায়ের সম্পত্তির দিকে। তুই বাবার প্রথম পক্ষের সন্তান আর আমি বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান তাই বলে তুই আমাকে শত্রু ভাবতী? আমি কি তোর বোন ছিলাম না? সামান্য সম্পত্তির জন্য তুই আর তোর বউ মিলে কি করে পারলি আমার সাথে এমন করতে? তুই তো শুধু আমাকে হত্যা করিস নি আমার মাকেও হত্যা করেছিস।” ভীতু দৃষ্টি নিয়ে হাবিব রিয়ার দিকে তাকায়, রিয়ার চেহারায় রাগ আর ঘৃণা প্রকাশ পাচ্ছে।” অবাক হচ্ছিস? ভাবছিস মায়ের মৃত্যুর কথা আমি কি করে জানলাম? মৃতরা সব জানে, কিচ্ছু তাদের কাছে গোপন থাকে না।” বলেই হা হা শব্দ করে পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে হেসে উঠে রিয়া। চারদিকটা অন্ধকার হয়ে আসে রিয়ার হাসির শব্দে।হাবিব তখনই জ্ঞান হারায়।

চোখ মেলে হাবিব নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে। হাবিব হাত পা নাড়াতে পারছেনা, কথা বলতে পারছেনা, শুধু চোখ বুলিয়ে চারপাশ দেখছে। এটাতো হাবিবের বানানো বাড়ি! হাবিবের স্ত্রী ঝর্না ডাক্তারের সাথে কথা বলছে, তাদের কথোপকথন হাবিবের কানে আসছে। ডাক্তার ঝর্নাকে বার বার বোঝাচ্ছে হাবিবের জন্য স্থান পরিবর্তনটা খুব জরুরি। রিয়া এসে হাবিবের মাথার পাশে দাঁড়ায়।” তুই দেখিস আমি ঠিক তোকে ওখানে নিয়ে যাবো। আর হ্যা এতো তাড়াতড়ি ভেঙ্গে পড়িস না, এখনো তো কিছুই ঘটে নি।” কথাটা বলেই আবার বিকট শব্দে হেসে উঠে রিয়া। রিয়ার এ হাসির শব্দ বাকিদের কানে পৌঁচাচ্ছে কিনা হাবিব বুঝতেছেনা। এতো বিকট শব্দেও তাদের কারো মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া নেই।

হাবিব ক্যালন্ডারে দিকে তাকায়, সত্যিই তো আর তিন মাস বাকি আছে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত