সন্ধ্যাটুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম

সন্ধ্যাটুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম

সুদর্শন আর প্রিয়দর্শনের মধ্যে পার্থক্য কি?আমি ঠিক জানিনা।আমার মনে হয় সুদর্শন মানে দেখতে সুন্দর আর প্রিয়দর্শন মানে যাকে দেখতে ভালো লাগে।মানুষটাকে প্রথমবার দেখে আমার প্রিয়দর্শন শব্দটাই মাথায় এসেছে।
জ্যামের মধ্যে নিউমার্কেটের সামনে বাসে বসেছি আছি।বাস প্রায় বিশ মিনিট এক জায়গায়ই আটকে আছে।জানালার পাশে বসেছি আমি।হঠাৎ-ই দেখলাম তাকে।রাস্তার উল্টোদিকে একটা হকারের পাশে দাড়িয়ে কথা বলছে তার সাথে।লম্বা,হালকা পাতলা গড়ন,শ্যামবর্ণ আর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।বিশেষ কিছু নয়।কিন্তু কেন যেন আমার চোখ তার দিকেই আটকে গেল।

ছেলেদের দিকে তাকিয়ে থাকা আমার স্বভাবের মধ্যে ভুলেও পড়েনা।এমনকি ফেসবুক ওয়ালে কোনো ছেলের ছবির দিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পর্যন্ত লজ্জা লাগে।অথচ সেই আমি সব ভুলে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
এর মধ্যে সে পানি কিনল,ফোনে কথা বলল।একবার আমার দিকে তাকালোও সে।চোখাচোখি হলো।কিন্তু দ্বিতীয় বার আর তাকায়নি।আমার কেন যেন খারাপ লাগলো।মনে হলো,আমি যদি খুব সুন্দর হতাম!সিনেমার নায়িকাদের মতো।তাহলে হয়ত সে আবার তাকাতো।আমি বলেই তাকায়নি।

একসময় বাস চলতে শুরু করলো।কিছুদূর গিয়ে আবার আটকে গেল।পাশে আরেকটা বাস এসে দাড়িয়েছে তখন।আমার ঘোরও ভাঙলো।হারিয়ে ফেলেছি ছেলেটিকে।মনটা কেন যেন খারাপ হয়ে গেল।আবার একটা অচেনা অজানা ছেলের জন্য মন খারাপ হয়েছে ভেবে নিজেরই বিরক্ত লাগলো।

পাশের বাসে জানালার পাশে এক লোক বিচ্ছিরিভাবে তাকিয়ে আছে।আমি সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম।বাসের ভেতর তাকাতেই দেখলাম ছেলেটি আমার ঠিক সামনে।বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাড়িয়ে আছে।বসার জায়গা নেই।কখন উঠলো?খেয়ালই করিনি।কাছ থেকে তাকে আরও ভালো লাগছে দেখতে।কেমন মায়াভরা চাহনি।চোখ দেখলে মনে হয় দুনিয়া সংসারের সব চিন্তা যেন তারই।আমাকে সে এবারেও খেয়াল করলোনা।সেই সুযোগেই হা করে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।

আমার পাশে এক মধ্যবয়সী মহিলা বসেছিলেন।কলেজ গেইট এসে তিনি নেমে গেলেন।বাসেও মোটামুটি ভিড় কমলো।সে যেহেতু সামনেই দাড়িয়ে ছিল,আমার পাশের খালি সিটে এসে বসলো।আমার প্রচন্ড ইচ্ছে হলো তার সাথে কথা বলি।তার কন্ঠটা একটু শুনি।কিন্তু কি বলবো?এমনিতেই আমি কথা কম বলি।অপরিচিত কারো সাথে সহজে কথা বলতে পারিনা।
একটু পর আমাকে অবাক করে দিয়ে সে নিজেই বলল,
“কোথায় যাবেন আপনি?”

আমি তখন কোথায় যাবো তাও মাথায় নেই।সে আমার সাথে কথা বলেছে!সাথে সাথে জবাব দিতে পারলামনা।কি ভাবলো কে জানে!বলল,
“আপনাকেই বলছি।কোথায় যাবেন?”
কোনোমতে বললাম,
“সাভার।”

বলেই মনে হলো আমার গলা দিয়ে এমন আওয়াজ হলো কেন?কন্ঠটা এতো নাঁকি নাঁকি শোনালো!আর যদি সে কথাই না বলে?ধুর নিতু!তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা জীবনে।আম্মু ঠিকই বলে।
কিন্তু সে কথা বলল।জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কি ইডেনে পড়েন?”
আমি মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম।
বলল,
“আমার বোনও পড়ে ওখানে।আপনি কোন ইয়ার?কোন সাবজেক্ট?”
“ফার্স্ট ইয়ার।ম্যাথ নিয়ে পড়ছি।”
“ওহ!আমার বোনও ফার্স্ট ইয়ার।অর্থনীতি।”
আমি একটু হাসলাম।কেমন যেন লাগছে।ঘামছি রীতিমত।কেন এমন হচ্ছে বোঝার সাধ্য বুঝি আমার নেই।
কিছুক্ষণ পর সে বলল,
“আপনি সাভার থেকে প্রতিদিন এতদূর আসেন ক্লাস করতে?”
“আসা লাগে।কিছু করার নেই।”

এবার সে মাথা নাড়লো আর কিছু বললনা।আমিও কিছু জিজ্ঞেস করিনি আর।কিন্তু প্রতি স্টপেই ভয় হচ্ছিল নেমে যায় যদি!কেউ পাশে থাকলেও এতটা ভালো লাগে সেটা প্রথমবার বুঝতে পারলাম।আচ্ছা এটার কি নাম দেয়া যায়?ভালোবাসা?দূর দূর!সে আবার হয় নাকি?

হেমায়েতপুর এসে একজন মহিলা ছোট বাচ্চা নিয়ে বাসে উঠলো।সিট খালি ছিলনা কোনো।সে সাথে সাথে উঠে জায়গা করে দিল।পাশ থেকে উঠে যাওয়ার পর খারাপ লাগছিল নাকি ভালো আমি বলতে পারবোনা।তার কাজটা ভালো কিন্তু….

সাভার স্ট্যান্ডে এসে নেমে গেলাম আমি।সাথে নিয়ে একরাশ মুগ্ধতা আর হতাশা।হয়তো তার সাথে এটাই প্রথম আর শেষ দেখা!

এরপর আমার কি হলো আমি জানিনা।তাকে ভোলা আমার সম্ভব হয়নি।দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেলো।
এই এক বছরে প্রতিটা দিন আমি তাকে খুজেছি।বাসে বসে তার কথাই শুধু মনে পড়তো।কতোদিন যে অর্থনীতি বিভাগের সামনে দিয়ে ঘুরেছি নিজেও জানিনা।এই আশায় যে হয়ত তার বোনের দেখা পাবো।বোনটির মুখ হয়ত ভাইয়ের সাথে মেলে!ইস্ শুধু মেয়েটির নাম জানা থাকতো যদি!

এর মধ্যে একবার আমায় বিয়ের জন্য পাত্রপক্ষ দেখতে এলো।আমি নিতান্তই অনিচ্ছা সত্তেও রাজি হয়েছিলাম শুধু এই আশায় যে,দেখতে আসা পাত্রটি যদি সে হয়?সাজিয়ে দেয়ার সময় বার বার মেজোকাকিকে জিজ্ঞেস করছিলাম,
“ছেলে কেমন?দাড়ি আছে?লম্বা না খাটো?শুকনা নাকি মোটু?বোন আছে উনার?”
মেজোকাকি বেশ অবাক হয়েছিল।আমি রাজি না তাও এসব জিজ্ঞেস করছি কেন তাই ভেবে।
বলেছিল,

“ছেলে কোনটা জানিনা।সাথে বন্ধুও আছে কয়েকজন।আর এগুলো জেনে কি হবে?ছেলে ভালো কিনা সেটা বেশি জরুরি।”

বন্ধুদের কথা শুনে আমার আশা আরেকটু বেড়েছিলো।কিন্তু সেখানে গিয়ে একপলক দেখেই বুঝেছিলাম,নাহ নেই সে।

অবশেষে তার সাথে দেখা হলো।এক বৃষ্টিভেজা স্নিগ্ধ বিকেলে।ভাবিওনি এভাবে অদ্ভুতভাবে দেখা হয়ে যাবে।আমি মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে।সারাদিন বৃষ্টির পর বিকেলে আকাশ একটু পরিষ্কার হওয়ায় হাঁটতে বেরিয়েছিলাম।হঠাৎই ফুচকার দোকানের সামনে তাকে দেখতে পাই।এখানে অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে দেখতে পাবো কল্পনাতেও ছিলনা আমার।চোখদুটো যেন এতদিন পর একটু তৃপ্তি পেলো।কতক্ষন দাড়িয়ে থেকেছি জানিনা।হুট করেই সে আমার দিকে তাকালো।আমাকে অবাক করে দিয়ে সেও আমার দিকে চেয়েই রইলো।তারপর হাসলো একটু।আমি যেন লজ্জা পেলাম খানিকটা।তখুনি চোখ

গেল পাশে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে।আরে! এটাতো শিরিন।তার মানে ওর বোন এটা?শিরিনকে তো আমি চিনি!একদিন ভাংতি ছিলনা বলে মেয়েটা আমার টাকা দিয়ে দিয়েছিল ফটোকপির দোকানে।পরে আবার দেখা হওয়ার সময় ভেলপুরি খাইয়েছিলাম।নাম জানি,মুখ চিনি।শুধু এটাই জানা ছিলনা যে ও অর্থনীতিতে পড়ে।উফ..আর ভাবতামও বা কি করে!ভাই বোনের চেহারায় কোনো মিল নেই।বোধহয় একজন বাবা,একজন মায়ের মতো হয়েছে।

শিরিন আমাকে দেখলোনা।ফুচকা শেষ করে ভাইকে বিদায় জানিয়ে রিকশায় উঠে চলে গেলো।পরে জেনেছি এখানে তাদের দাদা বাড়ি।বেড়াতে এসেছিল।সে শিরিনকে ফুচকা খাওয়াবে বলে নিয়ে এসেছিল।তারপর কাজ আছে বলে একা পাঠিয়ে দেয়।
সেই কাজটা আমি!শিরিন চলে যাওয়ার পর সে আমার কাছে এলো।হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছেন?”

আমার তখন প্রথম দিনের মতো জড়তা একদমই হলোনা।যেন কোথায় কি একটা বড় পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।আমি বেশ সাবলীলভাবে বললাম,
“ভালো।আপনি?”
সে হাসলো।বলল,
“কেমন আছি জানিনা।কেউ একজনকে খুজতে গিয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি।”
কথাটা শুনে বুকটা কেমন করে উঠলো!কি বললো এটা?আমার জন্য কি তাহলে….
সে আবার বলল,

“বাসের মধ্যে ওভাবে কারো দিকে তাকিয়ে থাকে কেউ?তার বুঝি অস্বস্তি হয়না?না দেখার ভান করে ছিলাম বলে কি ভেবেছিলে দেখিনি?সেদিন কত খারাপ কাজ করেছ জানো তুমি?নিজের ভালোলাগা নামক রোগটা আমায়ও দিয়ে গিয়েছিলে।এতটা দিন এই অদ্ভুত ভালোলাগার যন্ত্রণায় ভালো থাকাটা পর্যন্ত হয়নি!”

আমি কিছু বলার সুযোগ পেলামনা।বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো।আমরা পাশের এক যাত্রীছাউনির নিচে গিয়ে দাড়ালাম।কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছি না।দুজনেই সামনে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছি।সন্ধ্যা হয়ে আসছে।চারপাশের দৃশ্য কেমন অপার্থিব লাগছে।
এর মধ্যেই সে গেয়ে উঠলো,

“আমার সারাটা দিন,মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম”

আমার চোখে পানি চলে এলো।এত সুন্দর করে পৃথিবীর আর কেউ কি গাইতে পারবে?জানিনা আমি।শুধু জানি পাশের মানুষটার প্রতিটা নিঃশ্বাসও আমার পছন্দ।ভীষণ পছন্দ!

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত