লাল আকাশ

লাল আকাশ

জুলাই ১৯৯১, মস্কো

বিয়ারের খালি বোতলগুলো সারা মেঝেতে গড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অনিমেষ কী উপলক্ষে অতগুলো বিয়ার কিনে এনে ফ্রিজে সাজিয়ে রেখেছিল, জানি না। কিন্তু জানি, ফিরে এসে ও যখন দেখতে পাবে সব কটি বোতল খালি হয়ে মেঝেতে গড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তখন ঠোঁট চেপে হাসবে। কারণ, এভাবে আমার নীতিভ্রষ্ট হওয়ার, আমার পতনের, আমার পাপের, আমার ভণ্ডামির দৃষ্টান্ত দিনকে দিন বাড়তে দেখে ওর নিজেকে বিজয়ী মনে হবে। ও মনে করার সুযোগ পাবে যে আমরা নীতিবাগীশ কমরেডরা নীতিহীন স্পেকুলান্তদের কাছে শুধু হেরেই যাইনি, বেঁচেও আছি অনেকটা ওদের অনুগ্রহেই। ওরা আমাদের অঢেল অনুগ্রহ দেখাতে পারছে খুবই সস্তায়: এখানে এখন চব্বিশ বোতল বিয়ারের দাম পাঁচ মার্কিন ডলারের কম হবে। অনিমেষদের সব হিসাব-নিকাশ এখন মার্কিন ডলারে।

সুতরাং, আমার দরদি রুমমেট তার ফ্রিজ খালি করার দোষে আমার প্রতি একটুও বিরূপ হবে না। বরং উল্টো, আমি যদি ওকে বলি বিয়ারগুলো ভেজাল ছিল, এক বোতল ভোদকা আনো, গলা পর্যন্ত খেয়ে আজ মাতাল হই, তাহলে ও হেসে বলবে, ‘এখন থাক, সন্ধ্যাবেলা খাইয়েন।’

সন্ধ্যায় সে এক বোতল স্মিরনোফ অবশ্যই আনবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে তৈরি স্তালিচ্‌নায়া কিংবা মস্কোফ্স্কায়া ভোদকা নয়—এসব দেশি মাল অনিমেষরা এখন ছোঁয় না। যা কিছু সোভিয়েত, তাতেই ওরা এখন নাক ছিটকায়। যা কিছু আমেরিকান, যা কিছু ইউরোপীয়, তাতেই ওদের আকর্ষণ, তাতেই প্রেস্টিজ। সুতরাং, অনিমেষ আমার জন্য আমেরিকান ভোদকা স্মিরনোফ আনবে। সিগারেট চাইলে ওভারকোটের পকেট থেকে বের করে দেবে রথম্যানস, ডানহিল, মালবোরোর প্যাকেট।

আমি যখন যা চাই, অনিমেষ তা-ই এনে দেয়। কিন্তু আমি জানি, ওর এই উদারতা সরল নয়। বরং এটা ওর একটা কৌশল। আসলে আঘাত। এভাবে ছদ্মমধুর আঘাত হানতে হানতে সে আমাকে ভুল আর নিজেকে সঠিক প্রমাণ করছে বলে মনে মনে সুখ পায়। নইলে আমি যখন ওকে বলি, এসব চোরাকারবারি আর কোরো না, অন্তত ডলার কেনাবেচার মতো মর্যাদাহানিকর ও বিপজ্জনক ব্যবসাটা বন্ধ করো, তখন আমার কথা গায়ে না মেখে কেন সে নীরবে শুধু হাসবে?

যখন আমি খেপে যাব, যখন আমার কথাবার্তা সে একদমই আমলে নিচ্ছে না দেখতে পেয়ে তার সঙ্গে ঝগড়া বাধানোর চেষ্টা করব, তখন সে ব্যাখ্যা করে আমাকে বোঝাতে চাইবে যে গর্বাচভের নড়বড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে, ইয়েলৎসিনের স্বপ্নচারী রাশিয়ায় কোনো ব্যবসাই এখন আর চোরাকারবারি নয়। আসলে চোরাকারবারি বলে কিছু নেই, সব ধরনের আর্থিক কারবারই হলো ব্যবসা। সে আমাকে বলবে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা আমাকে মানুষ হওয়ার জন্য মস্কো পড়তে পাঠানোর সময় যেসব সদুপদেশ আমার অন্তরে গেঁথে দিয়েছেন, এখন সেগুলো মুছে ফেলা দরকার। কারণ, ওই নেতাদের ছেলেমেয়েরাই এ দেশে এসে সব সদুপদেশ ভুলে গেছে। নেতারা নিজেরাও এ দেশে অতিথি হয়ে এসে গোপনে ডলার ভাঙিয়েছেন চোরাবাজারে; সোভিয়েত আইনে কী লেখা আছে, তাতে তাঁদের কিচ্ছু যায় আসেনি।

অনিমেষ মার্ক্স-লেনিনের নাম উচ্চারণ করে আমাকে বলবে বাস্তব জীবনে তাঁদের ‘ইউটোপিয়া’র কানাকড়ি দাম নেই। বলবে, তত্ত্বকথায় যে জীবন চলে না, এটা সবাই বোঝে, বুঝি না শুধু আমি। একপর্যায়ে সে এমন কথাও বলে বসবে: ‘আপনি মন দিয়ে লেখাপড়া করে দেশে ফিরে গিয়ে হবেন নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিক, আর আমি দেশে ফিরব নীতিনিরপেক্ষ রুপার্ট মারডক হয়ে।’ এ রকম সাংঘাতিক কথা বলতে বলতে সে হাসবে; তার হাসি দেখে আমার পিত্তি জ্বলে যাবে এবং আমার চোখমুখ দেখে সেটা সে বুঝতে পারবে। তখন সে আমাকে আরও উত্তেজিত করার মতলবে আরও প্রসারিত হাসি হেসে বলবে, ‘আমার নিউজপেপারেই আপনি চাকরি করবেন। আমি আপনাকে সম্পাদক বানাব।’

আমার ওকে মারতে ইচ্ছা করবে। কিন্তু মারতে না পেরে ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেব। ওর মুখের দিকে আর তাকাবই না। সে-ও আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করবে না; শুধু মাঝেমধ্যে আড়চোখে তাকিয়ে দেখবে, আমাকে নিজের আবেগ উপভোগ করার সুযোগ দেবে।

দরজায় টোকা। খুলে দেখি, শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিন কনস্তান্তিন কাভালিওভ। সম্ভাষণ জানিয়ে সসম্মানে ভেতরে ডাকলাম। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে মেঝেতে ছড়ানো বিয়ারের খালি বোতলগুলো দেখে ভুরু কুঁচকে আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমি হেসে তাঁকে বোঝাতে চাইলাম যে আমি ঠিকঠাক আছি। তিনি অনিমেষের ডিভানে বসলেন। বললাম, ‘আপনাকে চা দিই?’ শুকনো মুখে বললেন, ‘আর কিছু নাই?’

ফ্রিজ খুলে দুটো আপেল বের করে আনলাম। দেখে ভদ্রলোকের চোখমুখে কোনো সাড়া জাগল না। নিশ্চয়ই রুটি-মাখন-সজেস প্রত্যাশা করছেন। কিন্তু কিচ্ছু নেই। কে কিনবে? অনিমেষ তিন দিন ধরে লাপাত্তা। আমার খাওয়াদাওয়া চলছে ক্যানটিনে। দেখলাম ফ্রিজের মাথায় এক খণ্ড রুটি। তিন দিন আগে কেনা হয়েছিল, খাওয়া হয়নি। এখন ওটা শুকিয়ে কাঠ, দেয়ালে পেরেক ঠোকার কাজে ব্যবহার করা যাবে।

আপেল কেটে দিলাম, কেটলিতে পানি বসালাম। কাভালিওভ এক টুকরো আপেল তুলে নিয়ে কামড় দিয়ে বললেন, ‘বিয়ার কি সব শেষ?’ আমি নিশ্চিত নই। ফ্রিজ খুলে দেখলাম, একটাও নেই। কিন্তু কী আশ্চর্য, একটা ভোদকার বোতল আছে! স্মিরনোফ! অনিমেষের কেনা। ওরা এখন আর সোভিয়েত মদ-সিগারেট খায় না।

বোতলটা কাভালিওভের নজরে পড়ল। চকচক করে উঠল তাঁর দুই চোখ। আপেলে বড় একটা কামড় বসিয়ে কসমস শব্দে চিবুতে চিবুতে বললেন, ‘ভোদকা দাও। আরও আপেল বের করো।’

কিন্তু ফ্রিজে আর আপেল নেই। আমি টেবিল থেকে একটা পানি খাওয়ার গ্লাস টেনে নিলাম। একটুখানি মদ ঢাললাম। কাভালিওভ ভদ্রতা করে বললেন, ‘আর তুমি?’

‘অনেকগুলো বিয়ার খেয়েছি।’

কিন্তু তিনি নাছোড়। মদ খাওয়ার সময় সব রুশিই এ রকম: একা খাবে না। সঙ্গী হতেই হবে। কাভালিওভ নিজে বোতলটা টেনে নিয়ে আরেকটা গ্লাসে মদ ঢেলে দিলেন। তারপর গ্লাসটা আমার হাতে দিয়ে নিজের গ্লাস তুলে নিলেন। নিজের গ্লাস দিয়ে আমার গ্লাসে টোকা দিলেন। তারপর কিছু না বলে পুরোটা মদ একবারে গলায় ঢেলে দিলেন। আমিও তা-ই করলাম, কিন্তু আমার বিচ্ছিরি লাগল। গ্লাস ভর্তি করে পানি ঢেলে নিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু পানি খেয়ে ফেললাম, তারপর কিছুই না ভেবে হঠাৎ বললাম, ‘কনস্তান্তিন ইভানিচ, ছাত্রের ঘরে গিয়ে শিক্ষকের মদ খাওয়া—এ রকম কি আগেও ছিল?’

তিনি এমন এক ভঙ্গিতে নিঃশব্দে হাসলেন যে আমার মনে হলো, তাঁর সব ব্যক্তিত্ব ধুলায় মিশে গেছে। ভুলে গেছেন যে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির মস্কো সিটি কমিটির একজন নেতা এবং সে জন্যই পাত্রিসা লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিভাগের ডিন হতে পেরেছেন।

একটু পর নিজেই গ্লাসে মদ ঢেলে নিলেন। গ্লাসের প্রায় অর্ধেকটা ভরে উঠল ভোদকায়। ঢকঢক করে তিন-চার ঢোঁকে গিলে ফেললেন সবটুকু, তারপর গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘তোমার রুমমেট কোথায়?’

আমি জানি, ভদ্রলোক আসলে টোকা দিয়েছিলেন অনিমেষের দরজায়। অনিমেষ তাঁকে মদ খাওয়ায়, হয়তো কিছু উপহার-টুপহারও দেয়। নইলে তিনজনের ঘরে আমরা দুজন বাস করার অনুমতি পেলাম কী করে।

হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কনস্তান্তিন ইভানিচ, আপনি আমার ঘরে বসে মদ খাচ্ছেন, কর্তৃপক্ষ জানতে পারলে আমার কোনো সমস্যা হবে না তো?’

হেসে বললেন, ‘কে তোমার সমস্যা করতে আসবে? তাকেও গলা পর্যন্ত মদ খাইয়ে দিয়ো।’

আবার মদ ঢেলে নিলেন, তারপর ফ্রিজের মাথায় শুকনো রুটির দিকে আঙুল তুলে বলেন, ‘ওটা নিয়ে এসো।’

আমি কাঠের মতো শক্ত পাউরুটিটা নিয়ে করাতের মতো রুটিকাটা ছুরি দিয়ে কাটার চেষ্টা করতে লাগলাম। কুড়মুড় শব্দ উঠল, ধুলোর মতো রুটির চূর্ণ ঝরে পড়ল ছুরির দুই পাশ দিয়ে। রুটির ফালি নয়, দুইটা টোস্ট বিস্কুট দেওয়া গেল তাঁকে। তিনি কড়মড় করে চিবুতে চিবুতে বললেন, ‘গরিব হয়ে গেলাম, তোমাদের ঘরে এসে একটু খানাপিনা করলে কি মহাপাপ হয়ে যাবে আমার?’

রক্ষা করো আল্লাহ! পাত্রিস লুমুম্বা গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিস্টোরি-ফিলোলজি ফ্যাকাল্টির একজন সহকারী ডিন, একজন অধ্যাপক, এই কথা বলছেন তৃতীয় বিশ্বের এক গরিব দেশ থেকে বৃত্তি নিয়ে আসা এক ছাত্রের ঘরে এসে!

‘পিরিস্ত্রোইকা শেষ হতে হতে আমরা মরে যাব। সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন আমেরিকার মতো প্রাচুর্য আসবে, তত দিনে আমাদের কবরে ঘাস গজিয়ে যাবে। যে কটা দিন বেঁচে আছি, তোমাদের ঘরে এলে একটু খেতেটেতে দিয়ো।’

টোস্ট বিস্কুটে রূপান্তরিত রুটির টুকরো চিবুতে চিবুতে পরিহাসের মলিন হাসি ফুটে উঠল কাভালিওভের মুখে। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে। ক্যাম্পাসের ক্যানটিন বন্ধ হতে আরও আধা ঘণ্টা বাকি।

‘ঘরে তো আর কিছু নাই। চলুন, ক্যানটিনে যাই।’

‘স্পাসিবা দারাগোই। অনেক ধন্যবাদ। এখন যেতে হয়। ঘর অনেক দূরে। ভালো থেকো। বেশি মদ খেয়ো না। পড়াশোনা ভালোভাবে করো।’

ঝুলিটা হাতড়ে নিয়ে কাঁধে ফেলে উঠে পড়লেন। এমনভাবে টলে উঠলেন, যেন তাঁর পায়ের তলার মাটি নড়ছে। মলিন হেসে বললেন, ‘ভালো ছেলে তুমি। অনিমেষও ভালো ছেলে। মেঝিনস্কিও ভালো মানুষ। আমি যে তোমার ঘরে এসেছিলাম, মেঝিনস্কিকে বোলো না কিন্তু। তোমরা সবাই ভালো। শুধু আমিই খারাপ। আমিই শুধু নষ্ট হয়ে গেছি। কোনো আদর্শ আর নাই, কোনো স্বপ্ন আর নাই। আমি মরে যাব। শিগগিরই আমি মরে যাব। দাসবিদানিয়া।’

মেঝেতে ছড়ানো খালি বোতলগুলো তাঁর পায়ের আঘাতে টুংটাং শব্দ করে গড়াগড়ি আরম্ভ করল। টলোমলো পায়ে বেরিয়ে গেলেন কমরেড কনস্তান্তিন ইভানোভিচ কাভালিওভ। ঘরজুড়ে গভীর বিষাদ নেমে এল। স্মিরনোফের অর্ধেক খালি বোতলটা টেবিলের মাঝখানে নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইল।

দরজাটা বন্ধ করা হয়নি, সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। ওই ফাঁক দিয়ে কেউ একজন উঁকি মারল। উঠে দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম। একটা রুশি লোক। চেনা চেনা লাগল, মনে মনে একটু হাতড়াতেই চিনে ফেললাম। গালভাঙা ছোটখাটো আমলার মতো চেহারার এই লোকটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টো পাশের দরজিখানার কাটার মাস্টার ছিল। কোনো সম্ভাষণ না করে আমার ঘরের মেঝেতে ছড়ানো শূন্য বোতলগুলোর দিকে চেয়ে আছে।

‘কী ব্যাপার?’ আমি বললাম।

‘বোতলগুলো নিতে পারি?’

‘কেন?’

‘বিক্রি করব।’

‘কেন? আপনার দরজিগিরির কী হলো?’

‘বেতন কম। কী রকম ইনফ্লেশন হয়ে গেছে দেখছেন না?’

আমার মনের মধ্যে একটা নিষ্ঠুর মতলব জেগে উঠল। আমি তাকে ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে অনিমেষের ডিভানে বসালাম। তার মুখভঙ্গি লক্ষ করে দেখতে লাগলাম। সে হয়তো ভাবছে, আমি তাকে চা সাধব, রুটি-মাখন খেতে দেব। কিন্তু না, আমি তাকে পেয়ে বসেছি। প্রায় বছর তিনেক পর।

‘আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?’ জিজ্ঞাসা করলাম।

‘না তো!’

‘মনে করার চেষ্টা করুন। বছর তিনেক আগে আপনি আমাকে আপনার দরজিখানা থেকে বের করে দিয়েছিলেন।’

‘কী? হতেই পারে না। কেন আমি আপনাকে বের করে দেব?’

‘কারণ, তখন সমাজতন্ত্র ছিল, শ্রমিকরাজ ছিল।’

‘বুঝলাম না, কী বলছেন এসব?’

‘আমি আপনার কাছে একটা প্যান্ট বানিয়ে নিতে গিয়েছিলাম। তখন ছিল শীতকাল। আমার পরনে ছিল আন্ডারগার্মেন্ট, শার্ট, তার ওপর মোটা সোয়েটার ইন করে পরে তার ওপর পরেছিলাম ওভারকোট। আপনি যখন আমার প্যান্টের মাপ নিচ্ছিলেন, তখন আমি শুধু আপনাকে বলেছিলাম, মোটা কাপড়চোপড় পরে আছি, মাপটা একটু টাইট করে নেবেন। আর ব্যস, তাতেই আপনার ইজ্জতে লেগে গেল। আপনি আমাকে বললেন, তুই আমাকে দরজিগিরি শেখাতে এসেছিস? যা, বেরিয়ে যা। আপনি আমার অর্ডারটা আর নিলেনই না। আমি সরি বললাম, আপনার হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করলাম, কিন্তু আপনি আমাকে বের করে দিলেন। কারণটা প্রথমে বুঝিনি। পরে বুঝেছি, আপনি চাকরি করেন সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের, দিনে একটা প্যান্ট সেলাই করলে মাস শেষে যা বেতন পাবেন, দশটা করলেও তা-ই পাবেন। তাহলে দশটা প্যান্ট সেলাই করার দরকার কী? তাই না?’

লোকটা চুপ করে রইল। আমি বললাম, ‘এই আপনার মতো লোকেরাই সমাজতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এখন খালি বোতল কুড়িয়ে বেড়াতে খুব সুখ লাগছে, তাই না?’

লোকটার মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর দেখতে পেলাম না। সে বেশ দরকারি ভঙ্গিতে বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন বোতলগুলো কি আমি নিতে পারি?’

আমি জেদি সুরে বললাম, ‘না। আপনাকে দেব না। সেদিনের ঘটনার জন্য আপনি একবার সরিও বললেন না।’

এবার সে তড়বড় করে বলতে লাগল, ‘দুঃখিত, দুঃখিত। ওই দিন হয়তো কোনো কারণে আমার মেজাজটা ভালো ছিল না। হয়তো আগের রাতে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল। আমার বউটা ছিল খুবই খারাপ। জীবনটা আমার একদম শেষ করে দিয়েছে। মাগি মরেছে, আমার আর এখন মেজাজ খারাপ হয় না। আসবেন, একটা কেন, দশটা প্যান্ট বানিয়ে দেব।’

‘ঠিক আছে, নিয়ে যান।’

বলামাত্র লোকটা উঠে বোতলগুলো কুড়োতে আরম্ভ করে দিল। একটা করে বোতল ঝুলিতে ভরতে ভরতে টেবিলে স্মিরনোফের বোতলটার দিকে আড়চোখে তাকাতে লাগল। তা দেখে আমার হাসি পেল।

সব বোতল ব্যাগে পুরে নেওয়ার পর লোকটা কোমর সোজা করে দাঁড়িয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে হাসিমুখ দেখাল। মনে মনে বললাম, এমন নির্লজ্জ মদখোর জাত কি পৃথিবীতে আর আছে? এরা বিপ্লব করেছিল কীভাবে?

তবু দয়া হলো। কাভালিওভের গ্লাসে ঢেলে দিলাম। ঢক করে গলায় চালান করে দিল। তারপর হাতের চেটোয় মুখ মুছে ধন্যবাদ বলে বোতলভরা ব্যাগটা কাঁধে ফেলে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। বেরোনোর আগমুহূর্তে আমার মুখের দিকে ফিরে বলে, ‘আসবেন কিন্তু প্যান্ট বানাতে।’

মনে মনে বললাম, যা ভাগ! কার্ল মার্ক্সের জন্য দুঃখ হলো, বেচারি বুঝতে পারেননি সব সম্পত্তির মালিক রাষ্ট্র হলে আসলে কোনো মালিকই থাকে না। আমি দেখেছি, খোলা আকাশের নিচে বাঁধাকপি, আলু, বেগুন, টমেটো, মিষ্টিকুমড়া, শসা, গাজর, লাউয়ের স্তূপ; পাহাড়ের মতো, সব পচে যাচ্ছে। ফেদিয়া, সাশ্‌কা, আন্দ্রেইউশকা, লিয়েন্কা, কাতিউসা, ভের্কা—সব হারামজাদা-হারামজাদিরা মদ খেয়ে গ্যাঁজাচ্ছে। বিকেল পাঁচটা বাজলেই ছুটবে ঘরের দিকে। মাস শেষে কেউ বেতনের এক পয়সাও কম পাবে না।

দরজা হালকা ভেড়ানো ছিল, হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেল, ঝড়ের মতো ঢুকে পড়ল উদ্‌ভ্রান্ত চেহারার এক তরুণী: ‘তোর ঘরে রুটি আছে?’ বলতে বলতে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেল। ফ্রিজ খোলার আগেই ওর নজরে পড়ল ফ্রিজের মাথায় রাখা শুকিয়ে যাওয়া রুটিটা, যেটার কিছু অংশ কাভালিওভ খেয়ে গেছেন। লুফে নিয়ে কড়মড় শব্দে চিবুতে আরম্ভ করে দিল। ছিপছিপে পাতলা রুশ তরুণী। গড়পড়তা রুশ মেয়েদের মতো গোলগাল নয়। গাল দুটো ভাঙা, নাক তরবারির মতো খাড়া, গ্রীবা দীর্ঘ, উষ্কখুষ্ক চুলগুলো সোনালি, বড় বড় নীল চোখে উদ্‌ভ্রান্ত, ঝোড়ো চাহনি। বিস্ফারিত চোখে রুটিটা চিবিয়ে চলেছে। রুটি শুকনো, তার মুখের ভেতরেও বোধ হয় কোনো রস নেই, ফলে ঢোঁক গিলতে পারছে না, হাঁসফাঁস করছে। লম্বা গ্রীবাটা আরও লম্বা হয়ে যাচ্ছে, গলায় শামুক আটকে যাওয়া রাজহাঁসের মতো দেখাচ্ছে ওকে।

হ্যাঁচকা টানে ফ্রিজের দরজা খুলে ফেলল; ভোদকার বোতল দেখে ফ্যাসফেসে শ্বাসরুদ্ধ গলায় উচ্ছ্বসিত ধ্বনি করে উঠল, ‘আহ্, পেয়েছি!’ বোতলটা খপ করে ধরে বের করে এনে ফোঁস করে একটা দম ফেলে অনাবশ্যক জোরে মোচড় দিয়ে ছিপি খুলল; বোতলের মুখেই মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে ভোদকা গিলতে শুরু করল, যেন নির্ভেজাল পানি খাচ্ছে। এক দুই তিন করে পাঁচটা পরিপূর্ণ ঢোঁক গিলে মুখ থেকে বোতলটা নামাল, ছিপি লাগাল, আবার ফ্রিজের ভেতরে রেখে দিয়ে দড়াম শব্দে ফ্রিজের দরজাটা বন্ধ করে এবং আমার দিকে না তাকিয়েই ‘ধন্যবাদ’ বলে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

‘কে তুমি?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

মেয়েটা ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে আগুনচোখে শুধু একঝলক তাকাল, তারপর হ্যাঁচকা টানে দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড শব্দে সেটা ফের বন্ধ করে দিল।

একটু পরই করিডর থেকে চিৎকার ভেসে এল, ‘সেদিন আর দেরি নাই। তুই আমার পায়ে ধরে কাঁদবি আর মাফ চাইবি। কিন্তু মাফ আমি করব না। গুলি করে মারব। তোর লাশ আমি কুকুর দিয়ে খাওয়াব।’

করিডরে বেরিয়ে দেখি মেয়েটা নাইজেরিয়ার এক ছেলের ঘরের দরজায় এলোপাতাড়ি লাথি মারছে আর চেঁচাচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার বাড়িয়ে দিল, ‘সব কটা বিদেশিকে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে গ্যাসের চুলায় পুড়িয়ে মারব। কুত্তার বাচ্চারা, কার খাস? কার পরিস? কার বিছানায় ঘুমাস?’

‘কী হয়েছে? এভাবে চেঁচাচ্ছ কেন?’ আমি বললাম।

মেয়েটা একটা বিচ্ছিরি গালি ছুড়ে দিল। তারপর দরজায় জোরে একটা লাথি মেরে ছুটে এল আমার দিকে, যেন পাগলা কুকুর ছুটে আসছে কামড়াতে। আমি তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিলাম। সে দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলল, ‘খোল খোল, তোকে নয়। তোকে মারব না। দরজা খোল।’

কিন্তু আমি সাড়া দিলাম না।

মেয়েটি ও বন্ধু, ও বন্ধু বলে ডাকতে লাগল। পাগল হয়ে গেছে। রাশিয়া জারের যুগে ফিরে যাচ্ছে, দস্তয়েফস্কির ম্যাডহাউসে পরিণত হচ্ছে।

‘খুলবি না? তাহলে তোকেও মারব। কালাশনিকভ দিয়ে গুলি করে সবগুলার খুলি উড়িয়ে দেব।’

একটু পরই দুটি পুরুষ কণ্ঠ, ধস্তাধস্তি এবং মেয়েটার চিল চিৎকারে আমার কানে তালা লেগে গেল।

আমার হঠাৎ লেনিনকে মনে পড়ল। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ফ্রিজ খুলে ভোদকার বোতলটা বের করলাম।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত