কিছু টুকরো মেঘের গল্প

কিছু টুকরো মেঘের গল্প

মেঘ গল্প ১. মেঘের বাঁশি মেঘ হয়ে যাক ..
মরিয়মের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আবুল খায়ের । বড় অভিমানী তার বউটা , নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে টুকটাক খুঁটিনাটি নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া লাগতেন তিনি এবং মরিয়ম , কতরাত যে না খেয়ে ঘুমোতে চলে গিয়েছিলো তার অভিমানী বউ , এখনো দেখে মনে হচ্ছে ঘুমোচ্ছে ! মুহুর্তেই বিশ বছর আগে চলে যান তিনি , যখন ছিলেন টগবগে তরুন । প্রতিদিন পাটোয়ারীদের সুপারি বাগান পাহারা যে দিতে হতো ! দিন রাত ভুতুড়ে বাগানটায় একাকি নিজে আর সময় কাটানোর একমাত্র সঙ্গী বাঁশের বাঁশি !

সেই বাঁশির সুর যে টেনে আনবে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ , তার জীবন সঙ্গীনিকে তা কি তিনি কোনদিন ভেবেছিলেন ? লাকড়ি খোঁজার বাহানায় আসতো মরিয়ম ,তারপর চলতো দুজনের স্বপ্নবোনা । কিছুটা অসম্ভব স্বপ্নই , বাবার একমাত্র ছেলে , দেখতে সুপুরুষ , স্বাভাবিক ভাবেই বাবা চাইতেন একটু অবস্থাপন্ন পরিবারে বিয়ে দিয়ে মোটা অংকের যৌতুক নিবেন । দুজনেই পরিবারকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বিয়েও করে ফেলেছিলেন , গ্রামের ছেলে মেয়ের জন্য সে এক অসাধ্য ! অসাধ্য সাধন তো হলো কিন্তু বাবা যতো দিন বেঁচে ছিলেন ঘরে জায়গা দেননি । কতরাত কতদিন না খেয়ে কেটেছে , কত বৃষ্টির দিন ভিজে কেটেছে , কই সেই দুর্যোগেও তো মরিয়ম তাকে ছেড়ে যায়নি ! আজ কীসের অভিমানে মরিয়ম চলে গেলো ? বড় মেয়েটা পালিয়ে গেলো বলে ? পাঁচ পাঁচটি মেয়েকে কাঁধে দিয়ে তিনি গরীব বাবা , মেয়েদের যৌতুক দিয়ে বিয়ে দেয়ার সামর্থ্য নেই , মেয়ে ভালোই করেছে এটা তো মরিয়ম কাল রাতেই তাকে বুঝিয়েছে ! তবে আজ কেন মরিয়ম কীটনাশকের বোতলটা মুখে তুলে নিলো ?
আবুল খায়েরের চোখটা হঠাত্ ই গরম বাষ্পে ভরে যায় , টপটপ করে পানি পড়তে থাকে , কানে ভেসে আসে মরিয়মের প্রথম বলা কথা … আফনে এমন মেঘের মতোন বাঁশি বাজান ক্যান ? বিষ্টির আসার মতন বুকে কেমন করে …

মেঘ গল্প ২.
ছেড়া জুতো ,ঘুম আর মেঘের গল্প…
আমি ঘুম ! আমার বাবা মা এরকম একটা অদ্ভূত নাম কেন রাখলেন এটা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে ! কিন্তু আমি এবং আমার নিকট আত্মীয় মানেই জানে যে এই নাম রেখে তারা কোন ভুল করেন নাই , চব্বিশ ঘন্টার একটা দিনে যে বিশ ঘন্টাই ঘুমিয়ে কাটায় তার আর কি নাম রাখা যেতো ? কিন্তু এই আমার গত ছমাস ঘুম নাই হয়ে গেছে , গত ছ মাসে আমি আমার নামের সার্থকতার সাড়ে তেরোটা বাজিয়ে জেগে থাকছি তো থাকছিই ! চোখ দুটো গর্তে চলে গেছে , খুব সহজেই আলিফ লায়লার সোফানিসবার চরিত্রে এখন অভিনয় করতে পারবো , একদম স্ক্রীনটেস্ট ছাড়াই ডাইরেক্ট ইন ! একজন মেঘকুমার আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী , তার আর কি দোষ , সে তো আর জানেনা , কোথাকার কোন ঘুম গত ছমাস সকাল ৬.৩০ মিনিটে বারান্দার ঘন গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দুচোখ বের করে থাকে কিংবা কখনো লিফটের সামনে দেখা হলে দুরু দুরু কাঁপন বুকে নিয়ে তাকিয়ে থাকে ! আর যদিবা কখনোও হাই হ্যালো কথা হতেও নেয় , সেখান থেকে ছুটে পালায় , পালিয়ে বাঁচে !

আমার কেন যেন মনে হয় মেঘকুমার আমার চোখের দিকে তাকালেই সব টের পেয়ে যাবে , আমি তা কখনোই চাই না , দূর থেকে দেখি , একরাশ ভাল লাগা নিয়ে , সামনে পড়লেই মাটির আধ হাত নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করে , এই দেবশিশুর মত অতিমায়া কাড়া চোখের অধিকারী ছেলেটার সামনে তাই আমি পারত পক্ষে পড়ি না ! বা পড়লেও এমন হুড়োহুড়ি করি যেন এক্ষুনি আমার ট্রেন ছেড়ে দিবে … **** জুতো ছেঁড়া একটা অতীব ভাল লক্ষন , এতোটাই যে ইচ্ছে করছে প্রতিদিন একটা করে জুতো ছিঁড়ে ফেলি ! আচ্ছা জুতো বাঁধাই করার কি কোন নিয়ম আছে ? থাকলে এই দেড়শো টাকার অতিমাত্রায় ভাল জুতোকে আমি বাঁধাই করে রাখতাম এমন কি বিয়ের পর আমার বেডরুমে তা ঝুলিয়ে রাখতাম , আমার বাচ্চা কাচ্চা বড় হলে দেখাতাম , দ্যাখ এই সেই ঐতিহাসিক জুতো যেটার জন্য আজ তোরা দুনিয়া দেখতেসিস আর মেঘকুমারের মতন একটা অসাধারণ বাপ পেয়ে গেছিস !

আজকের ব্যাপার টা ঘটেছে ঠিক এইরকম , সিডির দোকানে গিয়েছিলাম ভ্যাম্পায়ার ডাইরিজ এর নতুন সেশন এর সিডি এখনো জোগাড় হয়নি , রাতে টিভিতে তেমন কিছু দেখায় না , পড়াশোনা তো আমার এক নম্বুরী শত্রু , কদিন যদি ডেমোন সালভেটরকে দেখে পার করা যায় মন্দ কি .. কিন্তু দুর্ভাগ্য .. উঁহু সৌভাগ্যজনক ভাবে সিডির দোকানে দেখা পেলাম মেঘকুমারের ! এই ছেলেকে দেখলে আমার মাথা আউলে যায় , যদি ডানদিকে যাওয়ার কথা থাকে আমি আগ পিছ না ভেবে বাম দিকে যাওয়া শুরু করি ।

এবং আমি ডেমন সালভেটরের সিডি সাইডে রেখে বুয়েট থেকে টেক্সটাইল পাশ করা অতীব ট্যালেন্টেড নম্বর ওয়ান শাকিব খানের সিডি কিনে আউলা মাথায় হাঁটতে গিয়ে হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম ! জুতোটা অনেকদিন থেকেই এইবার বিদায় দে টাইপ সংকেত দিচ্ছিলো আমি পাত্তা দেই নাই , এখন আমাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পগাড়পার হয়ে গেছে , মানুষ অধিক শোকে পাথর হয় , আমি অধিকতর শোকে একদম ঝামা পাথর হয়ে গেলাম , সিডির দোকানে চার পাঁচজন যারা ছিলো সবার চোখেই মিস্ বিন কে দেখতে পাওয়ার আনন্দটা স্পষ্ট ! আর আমি তো বেআক্কলামির চূড়ান্ত প্রমান হিসেবে চোখ মুখ কাঁদো কাঁদো করে ছেঁড়া জুতো দেখছি ! এমনি সময়ে মেঘকুমার এসে ঝাড়ি লাগালো , এই মেয়ে উঠে দাঁড়াবে তো নাকি ? জুতো নিয়ে কেউ এভাবে বসে থাকে মাঝ দোকানে ? এই রে সেরেছে ,মাথা আবার আউলে গেছে! এখন যেন আমি কি করবো ? হ্যাঁ হ্যাঁ ঝেড়ে দৌড় লাগাতে হবে , আশপাশ ইতিউতি তাকালাম , কোনদিক থেকে দৌড় দিলে দ্রুত মেঘকুমার থেকে পালানো যাবে …
ছেলে আবারো ঝাড়ি লাগালো এই মেয়ে উঠছো না কেন ? উঠতে পারছো না ? হাতটা ধরো তো দেখি , চলো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেই , ইস বেশি লেগেছে না ? …. আমার কানে কিছুই ঢুকছিলো না , এই ছেলেকে দেখলেই আমার এমন হয় , সত্যি কথা বলতে কেমন যেন বুকে ব্যাথা করে , মনে হয় অতিরিক্ত আনন্দে বা অতিরিক্ত ভয়ে .. হঠাত্ ই আমার ভেতর থেকে কেউ বলে উঠলো , হাতটা ধর গাধী , এমন সুযোগ আর পাবি না । আমি ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খপ করে উনার হাত ধরলাম … তারপর কি কি হয়েছে এগ্জেট মনে নাই , আমি আবিষ্কার করলাম আমি মেঘকুমারের মোটর সাইকেলে বসে আছি এবং আরো আবিষ্কার করলাম সে আমাকে বলছে , সবসময় এরকম হুড়োহুড়ি করলে চলবে ? আমার বাসায় সবাই যদি এমন হুড়োহুড়ি করে তাহলে ভবিষ্যতে বাসায় ননস্টপ ম্যারাথন লেগে থাকবে ! আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না এই লোকের কি মাথা খারাপ ? কি বলে এই গুলা ? মেঘকুমার মনে হয় মাইন্ডরীডার , আমাকে আবার বেআক্কেল বানিয়ে বলতে লাগলো দেখো মেয়ে , আমি তোমাকে খুবই পছন্দ করি , মনে হয় ভালোওবাসি , আমি নিজে খুব হুড়োহুড়ি করা পাবলিক , সেরকম একটা বৌ পেলে মন্দ হয়না , হুড়োহুড়ি করা জামাই তোমার পছন্দ হবে তো ? আমি আবার টের পেলাম আমার মাথা আউলে যাচ্ছে , বুকে ব্যাথা হচ্ছে , আচ্ছা এটাকেই কি বলে সুখের মতো ব্যাথা ?? … তারপর সারা রাস্তায় ঘুমকন্যা আর মেঘকুমারে মিলে কোন জায়গায় জুতোর ফ্যাক্টরী দিবো তা নিয়ে ক্যাচাল করতে করতে বাসায় ফিরলাম কারন আমরা ঠিক করেছি প্রতিমাসের আজকের তারিখটাতে খুব হুড়োহুড়ি করে জুতো ছিড়বো ! একটু অন্যরকম সেলিব্রেশন হলে মন্দ কি !

মেঘ গল্প ৩. ভালবাসা মেঘ হয়ে থাক !

১০.০২.২০১২
রাত ০৮.২০ মিনিট ..
হাত মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি , উদ্দেশ্য ফেবার ক্যাসলের রঙ পেন্সিলের টিনটা খুঁজে বের করা ! ১৪ ফেব্রুয়ারী আসছে , ভালবাসা দিবস ! মাকে একটা খুব সারপ্রাইজ দিবো ভাবছি ! গত কয়েকদিনে বাবার বেশ কয়েকটা ছবি এঁকেছি , বাবা অননেএএক খুশি হয়েছে , এতো খুশি হয়েছে যে আমাকে বলেছে এরপর আর ডাক্তার আঙ্কেলের কাছে নিয়ে যাবেনা , তারমানে আমাকে আর ইনজেকশন ও দিতে হবে না ! এমন কি বাবা আমাকে এই ঠান্ডাতে একটা শেল এন্ড কোর খেতে দিয়েছে তারপর ঘাড়ে ঝুলিয়ে দোকান থেকে বাসা পর্যন্ত নিয়ে এসেছে ! আম্মুর ছবি আঁকি নাই দেখে আম্মু একটু কষ্ট পেয়েছে মনে হয়, আম্মুকে যখন আমাদের তিনজনের ছবিটা দিবো আম্মু নিশ্চয় অনেক খুশি হবে ! আমাকে বাবার মতো ঘাড়ে নিয়ে হয়তো ঘুরতেও যাবে ! আম্মু আর কি কি করতে পারে চিন্তা করতে করতে ছবিটা আঁকা হয়ে গেলো , বাবার চোখে চশমা, আম্মু লাল জামা আর আমি নীল শার্ট পড়েছি ছবিটাতে ! বাবা আর আম্মুকে কি সুন্দর লাগছে ! ছবিটা ভাঁজ করে লুকিয়ে রাখতে রাখতে শুনলাম দরজা খুঁট করে খোলার আওয়াজ , নিশ্চয় আম্মু এসে গেছে ! আজ আমি আম্মুকে একটুও বিরক্ত করবো না , চুপটি করে খেয়ে নিবো , আম্মু অনেক খুশি হবে নিশ্চয় ! ইস যদি বাবাটাও এখন আসতো , সবাই একসাথে খেতাম …

১১.০২.১২
আমি কি করবো বুঝতে পারছি না , বাবা আর আম্মু নিচে শুয়ে আছে । বাবার দেখি পা বাঁধা ! আম্মু আর বাবার চারপাশে অনেক লাল রঙ , একদম আমার তুলির রং এর মতো , কিন্তু এগুলো রক্ত , আমি জানি ! আমি ডাক্তারের কাছে যখন গিয়েছি তখন রক্ত দেখেছি , আচ্ছা আম্মু আর বাবা কথা বলছে না কেন ? ওরা কি মরে গেছে ? বাবা বলেছে রক্ত বের হলে মানুষ মরে যায় , আচ্ছা মরে গেলে কি হয় ? বাবাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি । এখন তো বাবা আর কথাও বলে না । আমি এখন কী করবো ? আমি কী নানুকে ফোন করবো ? নানুকে বলতে হবে আরেকটা বাবা আর আম্মু যেন নিয়ে আসে , কাল রাতে আঁকা ছবি তো এখন ও দেখানো হয়নি ওদেরকে …

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত