দ্বিতীয় মা

দ্বিতীয় মা

বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে বউ নিয়ে বাড়ি উঠলেন। অনেকেই চাপাস্বরে বলছিল, “আশরাফ উদ্দিন সরকার এই বুড়া বয়সেও কচি মেয়ে বিয়ে করে এনেছে। মেয়েটার যে কী হবে কে জানে?”

বাবা খুব রাগী ছিলেন। আমার চাচারাও বাবাকে খুব ভয় পেতেন। আর আমাদের ভাই বোনদের যখন ডাক দিত তখন বুকের ভিতর পানি শূণ্যতা টের পেতাম। ভয় পেতো না শুধু আমাদের মা। মা’কে যদি ধমকও দিতেন বাবা তখন মা পাল্টা ধমক দিয়ে বলতেন, “বাচ্চাদের সামনে এমন করতে তোমার লজ্জা করেনা? ছেলে মেয়ে কী শিখবে তোমার কাছে?”

নতুন বউকে বরণ করার মত কেউ ছিলনা। বাবা বড় চাচীকে পাশের বাড়িতে খবর পাঠালেন। চাচী আসাতে বাবার উর্ধমুখী স্বরে হাক তুলে বলা, “কিগো ভাবী? নতুন বউকে কতক্ষন বাইরে দাড় করিয়ে রাখবে? ধান দুর্বা কী বাড়িতে নেই?”

আমার মা’কেও এই লোকটি একবার এই বাড়িতে বউ করে এনেছিল। ধান দুর্বা দিয়ে বরণ করেছিল আমার দাদী। আজ দাদী বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে বাবার পিঠে আজ লাঠি ভাঙ্গত। বাবা পুরো বাড়ি শাসন করলেও বাবাকে একমাত্র দাদীই লাঠি হাতে শাসন করতে পারতো।

বড় চাচী বউকে বরণ করে ঘরে নিয়ে গেলেন। আমি বারান্দার একপাশে দাড়িয়ে মানুষ দেখছিলাম। কে কী বলে শুনছি। এলাকার মানুষজন নতুন বউ দেখতে এসেছে। আশরাফ উদ্দিন সরকারের নতুন বউ।

আমার পাশে এতক্ষন ছোট বোন দ্বীপা ছিল। বাবা ডেকে নিয়ে কোলে বসিয়ে আহ্লাদ করে বলছে, “আমার মেয়েটা মা মা বলে আর কান্না করবেনা। দ্বীপা আমি তোমার জন্য মা নিয়ে এসেছি। মায়ের কাছে যাবে?”

এই প্রথম বাবা দ্বীপাকে আদর করছে। দ্বীপাকে যতটুকু আদর এখন করলেন এতটুকু আদরও আমি পাইনি বাবার কাছে। সবসময় রাগ নিয়ে থাকতেন। ধমক আর শাসন ছাড়া কিছুই বুঝতনা।

বাবা দ্বীপাকে নিয়ে ঘরে গেলেন। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি। বাবা দ্বীপার ছোট হাত ঘোমটা দেয়া মহিলার হাতে দিয়ে বলছে, “এই যে সুফিয়া, আজ থেকে আমার মেয়ে কিন্তু তোমারও মেয়ে। দ্বীপা এটা তোমার মা। মা বলে ডাকো।”

আমি জানালা দিয়ে চিৎকার করে বললাম, “দ্বীপা না, এটা আমাদের মা না। আমাদের মা মরে গেছে।”
কথাটা বলেই আমি দৌড়ে চলে গেলাম। আমি জানি আজ আমাকে পেলে বাবা খুব মারবে। এখন মারতে না পারলেও সকালে যে মারবে এটা হলপ করে বলতে পারি।

মারবেল খেলার জন্য একবার মেহগণি গাছের ডাল দিয়ে পিটাচ্ছিলেন। মা এসে সামনে দাড়ালেন। আমাকে বাঁচাতে মা সেদিন দুই তিন ঘাঁ খেয়েছিলেন।

আজ তো আর মা নেই। আমাকে বাঁচাতে কে সামনে এসে দাড়াবে? মা তো সেই ছয়মাস আগেই মরে গেছে।
রাতে আমি খড়ের গাদার নিচে শুয়েছিলাম। বাঁশের মাচার উপর খড় রাখা আর নিচে ঢুকে আমি শুয়েছিলাম। সকাল হতেই চলে গেলাম বাড়ির বাইরে। বড় চাচী আমাকে ডেকে তাদের বাড়ি নিয়ে গেলেন। সকালবেলা গরম ভাতের থালা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “খেয়ে নে। তোর বাবা পেলে তোকে আস্ত রাখবেনা। যে কথা বলেছিস কাল সবার সামনে।”

আমি জোর গলায় বললাম, “বলেছি ভালো করেছি। আমাদের মা মরে গেছে। অন্য কাউকে মা ডাকব কেন?”
মা মারা যাবার পর পনেরোদিন আমি স্কুলে যাইনি। পুকুরের উপর বাঁকা হয়ে থাকা নারকেল গাছে বসে থাকতাম গালে হাত দিয়ে। ছোটো বোনটা যখন দৌড়ে এসে বলত, ‘ভাইয়া মা কোথায়? আমি খুঁজে পাচ্ছিনা।”

দ্বীপাকে কোলে নিয়ে বলতাম, “মা বেড়াতে গেছে, চলে আসবে। তুমি যেদিন নানির বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলে তার পরদিনই মা বেড়াতে গেছে।”
-ভাইয়া মা কবে আসবে?
-তুমি একটু বড় হলেই চলে আসবে।
দ্বীপার মাথার চুলে আমার চোখের পানি পড়ত।
চাচী বললেন, “হইছে এবার খেয়ে নে। নয়তো সারাদিন আর ভাত জুটবেনা।”
আমি আলুভর্তা কচলিয়ে মুখে ভাত পুরে দিচ্ছি।
হঠাৎ মনে হল দ্বীপার কথা। দ্বীপা খেয়েছে?
“চাচী দ্বীপা খেয়েছে?”

চাচী মুখে ভেংচি কেটে বলল, “তোর নতুন মা দ্বীপাকে কোলে তুলে খাওয়াচ্ছে দেখে এলাম। তারপরইতো তোকে আমি ডেকে আনলাম খাওয়ার জন্য।”

-একদম নতুন মা বলবেনা চাচী। আমার মা মরে গেছে, অন্য কাউকে মা বলতে পারবনা।
বাবা এই প্রথম মোলায়েম স্বরে আমাকে ডাকলেন। তবুও আমি ভয়ে ভয়ে সামনে যাচ্ছি। যমের মত ভয় পাই বাবাকে। একবারতো ধমক খেয়ে কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছিলাম। তবে এত মোলায়েম স্বরে এখন ডাকার কারণ খুঁজে পাচ্ছিনা। সেদিনের ঐ কথা বলার পর দৌড়ে চলে গিয়েছিলাম, সে মার এখনো মারেনি। বাবার কাছে যেতেই বাবা আমার হাত ধরে কাছে নিলেন।

প্রায় ছয়ফুট উচ্চতার মানুষটি বসে আমার মুখোমুখি হলেন।
-তোমার মা’কে আল্লাহ নিয়ে গেছেন। তোমার ছোট বোনটা সারাদিন মা মা করত। তোমাদের দেখাশুনার জন্যতো একজন মা দরকার। তাই তোমাদের মা এনে দিয়েছি। দেখোনা দ্বীপা কত সুন্দর মিশে গেছে নতুন মায়ের সাথে। তুমি বড় হয়েছো, তুমি না বুঝলে কে বুঝবে? তুমিও মা বলে ডেকো।”
-আমার মা মরে গেছে, অন্য কাউকে মা বলে ডাকতে পারবনা।

কথাটা বলে নিজেই বোকা হয়ে গেলাম। বাবার যে রাগ, না জানি এখন আছাড় মারে আমাকে।

বাবা কিছুই করলেন না। চুপ করে ঘরে চলে গেলেন।
দ্বীপা কয়েকদিন ধরে আমার কাছে আসেনা। সারাদিন ঐ মহিলার কাছে থাকে। এই মহিলা নাকি তার মা। যেদিন মা মারা গিয়েছে সেদিন ছোট্ট দ্বীপার চোখেও পানি ছিল। অথচ আজ অন্য এক মহিলাকে মা বলে ডাকছে। কোলে উঠে ভাত খাচ্ছে। ছোটতো, তাই হয়তো মাতৃঅভাব এর জন্য আপন করে নিয়েছে ঐ মহিলাকে।

শীতের দিন রোদে বসে আছি। গত দু’দিন রোদ উঠেনি বলে গোসল করিনি। আজ রোদ উঠাতে উঠোনে বসে আছি। ঐ মহিলা দ্বীপাকে গোসল করিয়ে দিল। এবার আমাকে ডাকছে।
“দ্বীপু গোসল করতে আসো। বেলা অনেক হয়েছে।”
-আমার যখন ইচ্ছে তখন গোসল করব। আপনাকে বলতে হবেনা।

মহিলা মন খারাপ করে চলে গেল। কী আমার মন খারাপ রে। এই মহিলার ছেলে মেয়ে হলে তখন আর খোঁজও নিবেনা আমাদের। সৎ মা কখনো আপন হয়না।

পুকুরে ঘন্টার পর ঘন্টা লাফিয়ে গোসল করে জ্বর বাঁধিয়েছি। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকার মত মা মা বলে ডেকেছি অনেকক্ষন। মা এলেন আমার কাছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “আমার দ্বীপু ভালো হয়ে যাবে। কমলা খাবি দ্বীপু? মাথায় পানি ঢেলে দিচ্ছি, তারপর কমলা দেব।”

আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি, ঐ মহিলা আমার মাথায় পানি ঢালছে। আমি উঠে যেতে চেয়েও উঠতে পারছিনা। এটা আমার মা না। মা আমাকে কত ভালোবাসত। পেট ব্যথায় কেউ মরে যায়? কয়েকদিন পেট ব্যথা পেট ব্যথা বলে মা চিৎকার করত। একদিন প্রচন্ড পেট ব্যথায় মা’কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মা আর কথা বলেনি। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর পর আর সজাগ হয়নি।

দ্বীপা এসে ডাকতেছে, “ভাইয়া, ভাইয়া। মা কাঁদতেছে।”

আমি দ্বীপার গালে চড় বসিয়ে দিলাম। আমাদের মা মরে গেছে। আর সে এসে মহিলার কথা আমার কাছে বলে যে মা কাঁদতেছে। সাত আটমাস আগেও দ্বীপা এমন করে এসে বলেছিল, “ভাইয়া মা কাঁদতেছে।”

সেদিন দৌড়ে গিয়ে জাতে চেয়েছি, “মা তোমার কী হয়েছে? মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “পেটের ভিতর ব্যথা করে বাবা। ”

দ্বীপা কাঁদতে কাঁদতে ঐ মহিলার ঘরে গেল। বাবা বাড়ি নেই। আমি একটু এগিয়ে গেলাম জানালার কাছে। পেটে হাত দিয়ে ঐ মহিলা কাঁদতেছে। নিশ্চয় এই মহিলার পেটে বাচ্চা। ছোট চাচীর পেটে যখন তারেক ছিল তখন তিনিও এভাবে ঘরের ভিতর চাপা স্বরে কান্না করতেন। চাচির পেট উঁচু ছিল। কিন্তু এই মহিলার পেট উঁচু না। হঠাৎ মনে হল আমার মা কাঁদতেছে। মরে যাবার আগে এভাবে কাঁদত। আমাকে ডাকার পর ছুটে গিয়েছিলাম মায়ের কাছে।
মহিলা আমাকে ডাকতেছে, “দ্বীপু একটু ঘরে আসো।”

অবিকল আমার মায়ের মত ডাকতেছে। এক পা এগিয়ে গিয়ে আবার পিছন ফিরে দৌড়ে চলে এসেছি। এই মহিলা আমার মা না।

মহিলার এপেনটিসাইড হয়েছে। অপারেশন করতে হবে। আচ্ছা, আমার মায়েরও এপেনটিসাইড হয়েছিল? অপারেশন করলে কী মা বেঁচে যেত?

মহিলাকে রিক্সায় করে বাবা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। আমার মা’কে যখন এমনি করে বাবা নিয়ে যাচ্ছিলেন। মা তখন বাবার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এই মহিলাও কী ঘুমিয়ে পড়বে?

চাচী আমাকে আর দ্বীপাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন। একটু পরই অপারেশন হবে। মহিলা আবার ডাকতেছে, “দ্বীপু একটু কাছে আসোনা। ”

আমি কী এক মায়ায় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম। আমার হাত ধরে মহিলা বলছে, “দ্বীপু আমাকে একবার মা বলে ডাকবে?”

আমাকে চুপ থাকতে দেখে মহিলা আর কিছু বললনা। বাবা অন্যদিকে মুখ করে দাড়িয়ে আছে। মহিলার চোখ বেঁয়ে পানি নামছে। আমার খুব ইচ্ছে করছে বলতে, “মা তোমার কিছু হবেনা। তুমি ভালো হয়ে যাবে।”
কিন্তু উনিতো আমার মা নয়।

অপারেশনের জন্য মহিলাকে নিয়ে যাবে এখনই। আমার খুব কান্না পাচ্ছে। মহিলা আমার জন্য কাঁদলেন কেন তখন? আমার হঠাৎ কী হল জানিনা। আমি দৌড়ে মহিলার কাছে গেলাম। আমি উনার হাত ধরে বলছি, “মা তোমার কিছু হবেনা। তুমি ভালো হয়ে যাবে মা।”

মায়ের চোখ বেঁয়ে পানি পড়ছে। এই পানি দুঃখের নয়, সুখের পানি।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত