অতীতের স্মৃতি

অতীতের স্মৃতি

পঞ্চম শ্রেণীতে যখন পড়তাম তখন আমি। একদিন রাস্তায় এক মেয়েকে সরাসরি আই লাভ ইউ বলে দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসি। আসার সময় পিছনে চেয়ে দেখলাম মেয়েটা হা বা না কিছু বলে কি না। দেখলাম মুখ নিচু করে হাটতেছে। ভাবছি আমার হয়ে গেছে। রাতে স্কুলের দেওয়া পড়া পড়িতেছিলাম। সবার স্কুলের একটা স্যার থাকে যার পড়া পড়তেই হয়। স্কুলের স্যাররা আমাদের কয়েকজন বন্ধুকে পড়া জিজ্ঞেস করেনা কারণ স্যার ভালো করেই জানে আমরা স্যারের পড়া পড়ে আসি না তাই আর জিজ্ঞেস করে না। বাবা বাজার থেকে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো পড়ালেখা কেমন হচ্ছে। আমি নিঃসংকোচে বলে দিলাম অনেক ভালো। বাবার মুখে হাসি আসলো ভাবলাম আমি তাহলে মিথ্যে কথা বলে বাবাকে খুশি করাতে পারি। কিন্তু কথায় আছে ‘চোরের দশদিন গেরস্থের একদিন ‘। গেরস্থ মানে কৃষক।

প্রতিদিন কোনো না কোনো একটা মিথ্যে বলে বাবাকে বুঝাই। আমার কথাও উনি বিশ্বাস করে ফেলে। বাবা আমার পাশ থেকে উঠে চলে গেলো। বাবাকে দেখে মনে হচ্ছিলো না উনি আমার উপর রেগে আছে কিন্তু একটুপর যখন শুনতে পেলাম বাবা রান্নাঘর থেকে বটি নিয়ে জঙ্গলে গেলো। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না কারণ উনি এখন আমাকে বাঁশ দিয়ে পিটাবে। বই, খাতা নিয়ে দিলাম এক দৌড়। পাশেই আমার নানু বাড়ি। চুপিচুপি গিয়ে নানুর কাছে বসে পড়লাম। আমি ভালো করেই জানতাম গ্রামের অন্য কারো বাড়িতে গেলে সেখানে গিয়ে হলেও আমাকে পিটাতো। তাই চালাকি করে নানু বাড়িতে আসলাম। বসে মনেমনে ভাবছি কাহিনী কি বাবা আমাকে মারতে আসলো কেন? অহ বুঝতে পারছি ঐ মেয়েটা নিশ্চয় আমার বাপের কাছে বিচার দিছে। যাইহোক বাড়ির পাশে নানু বাড়ি থাকার কারণে আজকের মত বেঁচে গেলাম।

সেদিন বেঁচে গেলাম। দুইতিন দিন আমি নানু বাড়িতেই থেকে যাই। বাবার রাগটা কমলে আবার বাড়ি ফিরে যাবো। আজকে আমাদের এলাকায় বাউলগানের আসর বসবে। আজকে রাতে বাড়ি থেকে বাউলগানের কথা বলে বের হই। রাত তখন ১২:২৫ বাজে। সেদিনের কথা আমি জীবনেও ভুলবো না। গ্রামের অনেকের বাড়িতে নারিকেল গাছ আছে কিন্তু জগলু চাচার নারিকেল অনেক ভালো তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম উনার গাছের নারিকেল খাব। বন্ধুদের মাঝে আমি একটু চালাকচতুর ছিলাম যার কারণে আমি গাছে উঠি না। অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করবেন না। সেটা আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।

যাইহোক মূল ঘটনায় আসি। জগলু চাচার বাড়ির পাশে যেতেই দেখি উনি গানের আসরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছেন। আমরা সবাই লুকিয়ে দেখছি কখন উনি বাড়ি থেকে বের হবেন। মিনিট ২০ মিনিট পর উনি বাড়ি থেকে বের হলেন। আমরা চারজন ছিলাম। আমি নিচে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলাম। যদি কেউ আসে তাহলে তাদেরকে সতর্ক করা। একটুপর ওরা তিনজন দুইটা করে ছয়টা নারিকেল পেড়ে আনলো। সবাইকে নিয়ে একটা অন্ধকার জায়গায় গেলাম। এমনিতে খুব শীত ছিলো তার উপর কুয়াশা। কিছুই দেখা যায় না। তারপর নারিকেল এর খোসা ছাড়িয়ে খেতে খেতে প্রায় ২ টা বেজে যায়। তাও কারো হাতে একটা কারো হাতে অর্ধেক নারিকেল আছে। হাটতে হাটতে বাড়ি ফিরছি পথে কাউকেই দেখতে পেলাম না।

পরেরদিন সকালবেলা জগলু চাচা আমার বাবার কাছে বিচার দিয়ে গেলো উনার নারিকেল গাছের সব নারিকেল কে জানি পেড়ে নিয়ে গেছে। আমার বাবা এ গ্রামের মাতবর। ঘুমন্ত অবস্থায় আমি মুখ চেপে ধরে হাসতেছি। মাত্র ছয়টা নারিকেল আনলাম আর উনি এসে বলে গেলো সব। এইদিনই আমি বাবার কাছে ধরা খেয়ে যাই। আমি যদি চালাক হই তাহলে আমার বাবা কেমন চালাক এইবার বুঝেন। অর্ধেক নারিকেল পড়ার টেবিলের ভিতর রাখছিলাম পরে খাব। কিন্তু উনি এসে সব চেক করে টেবিলের ভিতর পেয়ে গেলো। তারপর আমাকে খুঁজতে লাগলো। বাবা ভালো করেই জানে এ কাজ আমাদের। বাবা যখন আমার টেবিল আলমারি চেক করে তখন আমি কই ছিলাম জানেন..? খাটের নিচে। বাবা যখন আমার বিচার করে তখন আমার একটা শয়তান বোন আছে সে কি করে জানেন..? মুখ চেপে ধরে হাসে। আমার শত্রু। আমাকে বিচার করলে ও খুব খুশি হয়। সেদিন আমি খাটের নিচে গিয়েও পার পায়নি। শয়তান বোনটা এসে বাবাকে বললোঃ-

__বাবা সব জায়গাতেই তো খোঁজলা একবার খাটের নিচে গিয়ে দেখবা। সেদিন শয়তান বোনটার কথাটা শুনে মন চাচ্ছে তার গলা চেপে ধরি। তারপর বাবা বললো বুড়ো হয়েছি এখন নিচু হতে পারবো না। একদিকে আমার রাগ হচ্ছে আরেকদিকে আমার ভয় করছে। রাগটা হচ্ছে বোনের উপর আর ভয়টা করছে বাবার উপর। শয়তান বোনটার জোরাজুরিতে বাবা একটু নিচু হতেই আম্মু ডাক দিয়ে বললোঃ-
__এই বুড়ো বয়সে নিচু হওয়ার কি দরকার?? যদি কোমরটা ভেঙে যায়? মায়ের কথাটা শুনে বাবা আর নিচু হলো না আমিও দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললামঃ- বেঁচে গেছি। আস্তে করে খাটের নিচ থেকে বের হইলাম। পিছনের দরজাটাও আস্তে করে খুললাম। তারপর দৌড়তে দৌড়তে একটা গাছের নিচে বসলাম আর হাপাতে লাগলাম। রাস্তায় অনেকেই জিজ্ঞেস করছে দৌড়ে কোথায় যাচ্ছি। কোনো কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ চলে আসলাম।

কয়দিন পরপর এসব করতাম আর ধরা খাইতাম। প্রত্যেকদিন বাবার কাছে বিচার আসতো। একটা সময় সবাই আমাদের ঘৃণা করতো। বলতো মাতবরের ছেলে মানুষের এই করে সেই করে। আর উনি আসছে বিচার করতে। এসবের কারণে একদিন বাবা হার্ট এট্যাক করছিলো। তারপর থেকে এসব ছেড়ে দেই। মনোযোগ দেই পড়ালেখায়। আজকে আমি পড়ালেখার জন্য ঢাকায় আসছি। মাঝেমধ্যে যখন ছুটিতে বাড়িতে যাই তখন যাদের গাছ থেকে নারিকেল,জাম্বুরা লুকিয়ে পেড়ে খাইতাম। তারাই এসে আমাকে দিয়ে যায়। আর বলে আমার নাকি অনেক পরিবর্তন হইছে। তারপর আমি তাদেরকে একটা কথাই বলি। “মানুষ পরিবর্তনশীল”
আজকে যে খারাপ সে হয়তো একসময় খুব ভালো ছিলো। সময়ের সাথে সাথে মানুষের পরিবর্তন আসে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত