অবশেষে বাড়ি ফেরা

অবশেষে বাড়ি ফেরা

মিতু প্রতিদিন মোবাইলে কল করে কান্না করতে করতে বলে কবে বাড়ি ফিরবো।আর কতদিন পর ফিরবো। আমিও মিতুকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বলতে থাকি পাগলী এইতো সামনের ঈদে বাড়ি ফিরছি। আর তো কয়েকটা মাস, একটু অপেক্ষা করো। মেয়েটা আমার কথায় একটু শান্ত হয়। ঈদ চলে যায় বাড়ি ফেরা হয় না।আবারো কল করে কাঁদতে থাকে,আবারো মিথ্যা আশ্বাস দেই। এভাবে বছর পার হয়ে যায় কিন্তু বাড়ি ফেরা হয় না।কারণ আমি আর মিতু দুজন যে দুই ভুবনের বাসিন্দা। আমরা চাইলেও একসাথে থাকতে পারিনা,চলতে পারিন,হাত ধরে পাশাপাশি বসে কথা বলতে পারি না।

মিতুকে বিয়ের এক মাস যেতে না যেতেই আলাদা জীবন শুরু করতে হয়েছে। বিয়ের একটা মাস দুজনের অনেক ভালো সময় কেটেছে। এই একটা মাসের মধ্য অপরিচিত মিতু আমার মনের মধ্য এমন ভাবে যায়গা করে নিয়েছে বলে বোঝাতে পারবো না। মিতুকে ছেড়ে আসতে অনেক কষ্ট হয়েছে আমার।কিন্তু কি করবো বলেন বাস্তবতা যে অনেক কঠিন। ছাড়তে চায়না কেউ কিন্তু ছাড়তে বাদ্ধ হয় মানুষ।এক মিতুর ভালোবাসা বাঁচাতে গেলে যে অনেক মিতুই কষ্ট পাবে।তাইতো মিতুর ভালোবাসা, মায়া মমতা,আদর সোহাগ কবর দিয়ে পাড়ি জমাতে হয়েছে জীবন ও জীবিকার সন্ধানে।

যেদিন মিতুকে ছেড়ে চলে আসি সেদিন ওর চোখের দিকে তাকানোর ক্ষমতা আমার ছিলো না।মিতুকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার হারিয়ে গিয়েছিলো। মিতু একটু পর পর আমাকে জড়িয়ে ধরে গুমরে গুমরে কেঁদে উঠছিলো। আমারও কান্না আসছিলো কিন্তু কাঁদতে পারছিলাম। কারণ আমি কাঁদলে ও আরো ভেঙ্গে পড়বে। মিতুকে নানান বাহানা দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলাম।কিন্তু এত সহজে কি বুঝে উঠে বলেন। মার হাতে মিতুকে তুলে দিয়ে বললাম, মা তোমার তো মেয়ে নেই মিতুকে মেয়ের মত আগলে রেখো।কখনো কোন কিছুর অভাব বুঝতে দিওনা। মিতুুর ভিতরে তোমার এই ছেলেটাকে খুজে নিও। মা আমাকে কথা দিলো কখনো মিতুর অসম্মান করবে না,মেয়ের মতো আগলে রাখবে। মিতুকেও বললাম মাকে সবসময় নিজের মায়ের মতো করে দেখে রেখো। কারণ সেও তো সন্তানহীন হয়ে যাবে।মিতুও মাকে দেখে রাখার কথা দিলো।

সবার কাছ থেকে এক এক করে বিদায় নিলাম। পরিবার থেকে শুরু পুরো গ্রামের মানুষের কাছে বিদায় নিলাম,ক্ষমা চেয়ে নিলাম।কারণ বলা তো যায়না কখন কি হয়ে যায়,যদি সুস্থ হয়ে না ফিরতে পারি।
পাড়ি জমালাম কাজের উদ্দেশ্য নিজ দেশ ছেড়ে অন্যের দেশে।

মিতুকে ইনিয়েবিনিয়ে নানান অজুহাত দেখিয়ে পার করলাম ৭টা বছর। মিতুর যেমন কষ্ট হয়েছিলো,মিতুও যেমন দিনের পর দিন কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়েছে আমি কেঁদেছি রাতের আধারে। কেউ দেখতে পাই নি আমার কান্না,রাতে বালিশের নিচে মাথা গুজিয়ে কেঁদেছিটা।আবার সকাল হলে চোখের জল সবার অগোচরে মুছিয়ে কাজে গেছি। শুধু আমি না প্রবাসের প্রতিটা বাঙ্গালি ভাইয়েরা এমন করে কাঁদে প্রতিদিন। শুধু পরিবারের কথা ভেবে সব কষ্ট সহ্য করে নেয়,কাটিয়ে দেয় বছরের পর বছর।

৭টা বছর প্রবাস জীবন পার করে আজকে কাউকে কিছু না জানিয়ে ফিরছি। সবাই কে চমকে দিবো বলে, চমকে দিবো মিতুকে।

দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নিজ গ্রামে এসে ঢুকতেই মনটা জুড়ে গেলো। কত সুন্দর আমার এ গ্রামটা। চারদিক ফজরের আজান দিচ্ছে, পাখির কিচিরমিচির শব্দ আহা পরাণ টা জুড়ে গেলো। বাসায় গিয়ে জানালা দিয়ে মা বলে ডাকতেই মা জানালে খুলে চিৎকার দিয়ে উঠলো খোকা । বুড়ো মা আমার দৌড়ে বাহিরের দরজা খুলেই গলা জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলো।কপালে চুমু, মাথায় চুমু, দুই গালে চুমু, পারলে মনে হয় কলিজার ভিতরে টেনে নেয় এমন অবস্থা।আমিও নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না।আমার দুচোখ বেয়প অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরতে লাগলো। আমার মায়ের কান্না শুনে মিতু ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে চলে আসলো। এসে আমাকে দেখে কান্না শুরু করলো। এদিকে বাবাও কান্না,চারদিকে কান্নার রোল পড়ে গেলো। আশেপাশের সব মানুষ ছুটে আসলো

আমাকে দেখেই সবার চোখের কোণে একটু জল চলে আসলো। সবাই বুকে জড়িয়ে আদর করতে থাকলো।খুব ভালো লাগতে থাকলো আমার। সকাল হতে পুরো গ্রামের মানুষের আনাগোনা শুরু হলো।এক অন্যরকম পরিবেশ পেলাম আমি অনেক দিন পর। সবার সাথে কাটালাম সারাদিন গল্প আর গুজবে। কোন ক্লান্তি আসলো না মনের ভিতর। এভাবে তিন মাস পার করলাম মিতুর সাথে। তিনটা মাস মিতু আমাকে ছাড়া একটা রাত একা কাটায় নি। সবসমেত আমার সাথে সাথে, আমিও ওকে এক মিনিটের জন্য চোখের আড়াল করিনি। যেখান গিয়েছি সাথে করে নিয়েছি।

তিনমাস শেষে আবারো ফিরতে হবে। সবার চোখেমুখে কেমন জানি একটা ভাব। মনে হয় আবার হারিয়ে যাচ্ছি। এ কয়েকদিনে সবার প্রতি আমার মায়াটাও বেড়ে গেছে। গ্রামের প্রতিটা মানুষ থেকে শুরু করে গাছপালা, এককথায় সব কিছুর প্রতি মায়া। ছাড়তে ইচ্ছে করছে না,মনটা ফিরতে চাইছে না।তবুও ফিরতে হয়, বাস্তব যে অনেক কঠিন। তবে এবার মিতুকে কথা দিয়েছি একবছর পর পর ফেরার চেষ্টা করবো।

আবারো বিদায়ী মুহূর্ত, আবারো এক করুণ পরিবেশের তৈরি। তবুও সব মায়া ত্যাগ করে যাচ্ছি।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত