আঁধারের মানুষেরা

আঁধারের মানুষেরা

প্রচণ্ড শীতের ছোবল। আর চুল-চিকন ঝিরঝিরে বৃষ্টির চামড়াছেঁড়া পিঁপড়েকামড়। সামনের কুয়াশাঢাকা ধুধু অঞ্চলের মাটির ঘরগুলো মরে গেছে, এমনকি জমিন ফুঁড়ে ওপরে ওঠা জঙ্গলে বৃক্ষগুলো পর্যন্ত।

কে বলবে আজ পূর্ণিমা?

যেন সূর্য পড়বে কপালে, অঞ্জন হাতের ছায়া কপালে ঠেকিয়ে ধূম্রজালে ঢাকা আসমান দেখে।

এরপর কোনদিকে?

রিকশা যেখানে এসে থেমেছে গ্রামের দরজায়, সেখানে দাঁড়িয়ে প্রায় অসহায় কণ্ঠে প্রশ্ন করে অঞ্জন।

মিলি ঢাকা থেকে একেবারে সৈয়দ মোস্তফা হাসানের প্রাচীরের দোর অব্দি পৌঁছানো পথের ম্যাপ এঁকে নিয়ে এসেছে।

অঞ্জনের চিরদিন মনে হয়েছে বাংলাদেশটা খুদে এক মার্বেল। হাতের তালুতেই ঘোরানো যায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি ইচ্ছে করলেই দেশটা চষে আবার সূত্রে ফেরা যায়। শুধু পা বাড়ানোর ইচ্ছেটা মাত্র। কিন্তু ভ্রমণের পথ যদি অমসৃণ আর জটিল হয়, একটা দিনের যাত্রাকে মনে হতে পারে এত দীর্ঘ, যেন কয়েক দিন কয়েক রাত ধরে তারা চলছে। বাসে উঠে ফেরিতে লম্বা অপেক্ষা।

এরপর ডিসট্রিক্ট টাউনে নেমে লক্কর-ঝক্কর লোকাল বাস। এদেশে এখনো এসব বাস আছে? অঞ্জন অবাক। তারপরও একটা চাপা উত্তেজনা, কৌতূহল ভ্রমণের কোনো হ্যাপাকেই তার গায়ে লাগাতে দেয়নি। কিন্তু এখন এখানে দাঁড়িয়ে সে যখন পেছনে তাকায়, মনে হয় আজকের ভোরে নয়, বহুদিন আগের এক ভোরে তারা পৃথিবীর শেষপ্রান্তে আসার জন্য পা বাড়িয়েছিল।

দুজনের কাঁধেই ব্যাগ। যতটা কষ্ট না সারাদিন হয়েছে, তার তিনগুণ কষ্ট হয়েছে দশ মাইল আধভাঙা পথের ছড়ানো-ছিটানো গর্তের ঝাঁকুনি খেয়ে খেয়ে সেখানে এসে থামাটা, যেখান থেকে পায়ে হেঁটে দু কদম যাওয়াই রীতিমতো দুরূহ। সামনের টিলার মতো উঁচু-নিচু পথের দিকে অবসন্ন চোখে তাকিয়ে অঞ্জন হতাশ বোধ করে।

কিন্তু যে মিলি শৈশব থেকেই শেকড়ছিন্ন, তার পিতা-পিতামহ বলে এই পৃথিবীতে কেউ আছে না মরে গেছে কোনো বিষয়েই যে কোনো তফাত্ বোধ করেনি, অঞ্জনের সাথে যখন সে সে-ই পথেই পা বাড়িয়েছে, মনের মধ্যে তখনই আঁটঘাট বেঁধে নিয়েছে—এটাই তার সহজাত প্রবণতা, সিদ্ধান্তের আগে বা পরে প্রায়ই সে থাকে দ্বিধাহীন—সেই শক্তিতেই মিলি গা থেকে ময়ূরের পালকের মতো সমস্ত অবসাদ ঝেড়ে অঞ্জনের হাত ধরে, চলো।

এর আগে, রিকশা যখন একটা ঝাপড়া গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে, মিলিই প্রশ্ন করেছে, আমাদের আর কদ্দূর হাঁটতে হবে?

রিকশাওয়ালা ছেলেটাকে ভজিয়ে এ অব্দি আনতে অনেক খ্যাচখ্যাচ করতে হয়েছে। কোনো রিকশাওয়ালাই রাজি হচ্ছিল না, এই ছোকড়ার বাড়ি ওই গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু এই ধুম শীতে সে নিজের বাড়ি পর্যন্ত যাবে, আর বাকি পথ কিছুতেই না। সে রীতিমতো বিস্মিত, মানুষ ভরদূপুরেই ওই ভূতের গেরামে যাইতে দশবার চিন্তা করে, আপনেরা পাগল অইছেন? তাও আবার হেই গেরামের ভূত মুস্তপার বাড়ি? ওই পাগলের বাড়িত মানুষ যায়?

পাগল! মিলি রীতিমতো ক্ষিপ্ত, এই ছেলে, তুমি যত টাকা ভাড়া চাও দেবো, কিন্তু সাবধান! সৈয়দ মোস্তফা হাসান সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করবে না।

বেশি ভাড়ার লোভেই ছেলেটা শীতের জড়তা ভেঙে প্যাডেলে কষে চাপ দিয়েছিল। সারা পথ একটু পরপরই ছেলেটার ফিনকি দিয়ে ওঠা বিস্ময়ধ্বনি—সত্যি কইতাছি, ওই বাড়িতে ভূতের আসর, কেউ ওই বাড়ির তিরিসীমানায় যায় না। তেনার কিছু শিইষ্য চাইরপাশে ঘুরে, তাগো আওয়াজ পাওন যায়, মুখ দেহা যায় না।

অঞ্জন বলে, কিন্তু একজন বৃদ্ধ লোক বহু বছর ধরে ওই বাড়িতে আছেন। তিনি তো একজন মানুষ, তিনি কী করে থাকছেন?

কুয়াশা-মেঘের আস্তরণ ফুঁড়ে গেলে চাঁদের চিকন একটি ফালি আলোর ঝিলিক দিয়ে ফের মিলিয়ে যায়। সামনের অনেকটা পথ এবড়োথেবড়ো।

মিলি আর অঞ্জন নেমে রিকশা ঠেলতে থাকে।

ফের রিকশায় উঠে দুজন যখন হাঁপাচ্ছে, ছেলেটা ভয়ে ভয়ে বলে, কইলে তো আবার রাগ করবেন। একজন মানুষ হারা দিন-রাইত কব্বরের লাহান একটা বাড়িতে পইড়া থাহে, হেয় মানুষ হয় কেমনে? না খায়া, না পইরা মানুষ বাঁচে?

হয়েছ, অঞ্জন থামিয়ে দেয়, তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না।

সাহেব, হেই বাড়িত যাইবেন? আপনাগো বহুত সাহস।

ছেলেটা ঝাঁকড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে যখন গামছা দিয়ে মাথার শিশির ঘাম মুছছে, মিলি ব্যাগ থেকে তার এঁকে আনা ম্যাপটা বের করে।

চারপাশের প্রায়ান্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না।

ছেলেটা এখন উবু হয়ে হারিকেনে জমে যাওয়া কুয়াশা পরিষ্কার করছে। মিলিও বসে পড়ে। ম্যাপটা সেই টিমটিমে আলোতে মেলে ডানদিকে ক্ষয়ে যাওয়া পথটা দেখে। এরপর নিজে নিজেই হাত দিয়ে বাম-ডান ইশারা করে পুরো রাস্তাটা মাথায় মুখস্থ করে নেয়।

ছেলেটা চলে যেতে যেতে এমন ভয়ার্ত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন সে কোনো মানুষ নয়, সত্যি সত্যি ভূতের আত্মীয়দের বহন করে এনেছে। দিনেরবেলা হয়তো বা তারা সাধারণ মানুষের মতো পোশাক পরে সবার মধ্যে মিশে থাকে।

এই তবে সূর্যসেনের এক শিষ্যের পরিণতি! অঞ্জনের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। মানুষের জন্য নিজের সব বিকিয়ে দিয়ে নিজে শূন্য হয়ে হয়ে জগতের কাছে আজ একজন ভূতে পরিণত হয়েছেন।

গ্রামটার নামও তো ভূতুড়ে। পিশাচপুর।

অঞ্জন মিলির ওপর ভর করে হাঁটে না মিলি অঞ্জনের ওপর, বোঝা যায় না। পুরো পথটা যেন দীর্ঘ এক বশীভূত ঘুমন্ত অজগর। কঠিন ঠাণ্ডা কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝোপ জঙ্গল টিলার ওপর দিয়ে অনেকদূর চলে গেছে। অঞ্জনদের পায়ের চাপেও নড়ে না।

মিলির হাতে টর্চ। ওদের শব্দে প্রায় ঘুমন্ত অচেনা খুদে প্রাণীগুলো মাঝে মধ্যেই এদিক-ওদিক ঝঁপিয়ে পড়ছে।

মিলি কি কিছু ভাবছে? অঞ্জন ভাবে, নিজের পিতামহের সামনে জীবনে প্রথম দাঁড়াবে, অচেনা একজন, এ নিয়ে তার মধ্যে কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে?

একবার ভাবনার মধ্যে ডুবে গেলে অঞ্জন জন্মান্ধের মতো হাঁটতে পারে, যে পথে যাওয়ার হাত-পা সে পথেই যায়। সামনের কঠিন রাস্তার কষ্ট-ক্লান্তি ধীরে ধীরে অপসৃত হতে থাকে। ঝোপগুলোর মধ্যে টুসকি দিয়ে দিয়ে জোনাকির বিন্দু বাতি, যা একচুল ওপারেও কোনো আলো বিস্তার করে না।

পা হড়কে হড়কে ঢালু জায়গা থেকে নামার সময়ই মিলি কষে অঞ্জনের হাত চেপে সাবধান করে, অ্যাই, সামনে গাছের গুড়ি।

অঞ্জন স্বস্তি বোধ করে, সে-ই মিলির কাঁধে সোয়ারি হয়েছে। তবে আর চিন্তা কী? হাঁটো। স্বদেশী আন্দোলন। ধর্মের ভেদ ভেঙে হিন্দু-মুসলিম এক হয়ে সংগ্রামে নেমেছে। সূর্যসেনের বিপ্লবী দলের অনেক শিষ্যের মধ্যে সৈয়দ মোস্তফা হাসানও একজন। অল্পবয়সে বাবাকে হারিয়েছেন। দু বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর পিতার সম্পত্তির একচ্ছত্র অধিপতি। বাল্যবিবাহ হয়েছিল তাঁর। স্ত্রী যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার পর তাঁর সান্নিধ্যে খুব অল্প সময়ই কাটিয়েছেন। মিলির বাবাকে জন্ম দিতে গিয়ে তিনি মারা গেলে স্বদেশী আন্দোলনে তুমুলভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার একমাত্র বন্ধন তাঁর পুত্র। সে তখন নানা-নানীর আশ্রয়ে। ছেলের জীবন ও পড়াশোনার খরচটুকু রেখে একে একে বিক্রি করে দিলেন সব সম্পত্তি। গান্ধীর ডাকে অহিংস আন্দোলনে যোগ দিয়ে, আন্দোলনের পেছনে সব অর্থ খরচ করে কাটাতে শুরু করলেন সংগ্রামী জীবন… বাড়িটা যত কাছে আসছে, অঞ্জনের শিরশিরে অনুভূতিতে মোস্তফা মানুষটা ততই দূরবর্তী হতে শুরু করেছে। এখন মিলি নয়, এই মানুষটার সামনে সে কীভাবে দাঁড়াবে, ওই গুহায় বসবাসরত রূপান্তরিত বৃদ্ধ কীভাবে তাদের দিকে তাকাবে, এটা ভাবতেই অঞ্জন বোধ করে তার পায়ের মধ্যে কেউ ভারী পাথর বেঁধে দিয়েছে।

সাপ! মিলির টর্চের আলোর রশ্মিতে চোখ যাওয়া অঞ্জন চিত্কার করার প্রায় সেকেন্ড আগে মিলি বাঁ হাতে ওর মুখ চেপে দাঁড়িয়ে যায়, উশ্শ্।

সাপটা বাতি পড়ায় হঠাত্ চমকে যেন ফণা তুলতে চায়। মিলি টর্চ নিভিয়ে মরার মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

পাথুরে পায়ের অঞ্জনও।

ভাবনার বর্মের মধ্যে লুকিয়ে পড়া অঞ্জন এবার লক্ষ করে, পা বাড়ানোর আগে যখন বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে ওরা ধোঁয়াশে বৃষ্টির ঝাপট খাচ্ছিল, ঝিরঝির থেমে গেলে ওরা যখন হাঁটছে, তখনো মেঘে আকাশটা ঢেকেছিল, এর মধ্যে কখন যেন চাঁদের নিচের ছায়া জমে শুষে নিয়েছে প্রকৃতি। ঠা ঠা নিচেও মিলি টর্চ জ্বালাচ্ছিল কেন? চোখের কম্পনও থেমে গেছে। সে ঠায় দেখে, উঠতে থাকা ছোবল থামিয়ে সাপটা নিঃশব্দে গড়িয়ে গড়িয়ে ওপাশের ঝোপে মিলিয়ে যাচ্ছে।

অঞ্জন! মিলি যেন অনেক দূর থেকে ডাক দেয়।

এইবার ঝাঁকুনি দেয়, প্রায় রাতেই স্বপ্নগ্রস্ত অঞ্জন। আজকাল একই স্বপ্ন বারবার দেখছে : একটা লম্বা সিঁড়ি, তার ওপরের পোড়ো মন্দিরে দাঁড়ানো দুর্গা, তার শরীর পেঁচিয়ে সিঁদুরের মধ্যে ছোবল দিচ্ছে সাপ, কখনো একটু ঘুরিয়ে পোড়ো বাড়িতে মিলি পড়ে আছে, তার পা বেয়ে সাপ উঠছে।

অঞ্জন! তুমি একটু বেশিই সাপ আতঙ্কে ভোগো। মিলি বলে, চলো তো।

অঞ্জনের শরীরের বরফ জল ছাড়ছে না, সে বলে, কিন্তু মিলি! এ যে সাক্ষাত্ সাপ!

তাকে কেউ আঘাত না করলে সাপ কাউকে আঘাত করে না। মিলি বলে, তুমি দেখলেই তো, আমার টর্চ খেয়ে ও নিজকে আক্রান্ত ভেবে ফণা তুলছিল, জাস্ট পরেই সে নিজেকে সেইফ বুঝে নিজের মতো চলে গেছে।

এই সামনের পথটা দিয়ে সাপটা গেছে। অঞ্জনের মনে হচ্ছে এ জায়গায় কিছুক্ষণ আগে চলে যাওয়া এক মোটা সাপের চিহ্ন, অঞ্জনের হাত ধরে অনায়াসে মিলি হাঁটছে। কিন্তু এটুকু পথ পেরোতেই অঞ্জনের অন্তরাত্মায় এমন থরথর কাঁপুনি শুরু হয়, সে লাফিয়ে জায়গাটা পার হতে গিয়েও কষে নিজেকে থামায়। সাহসী মিলির সামনে নিজেকে ভীতু প্রমাণ করতে আজ তার কোথায় যেন পৌরুষে বাধে। কঠিন অভিনয়ে নিজেকে সহজ করে হাঁটতে হাঁটতে সে বলে, মিলি, প্রত্যেক মানুষেরই কিছু না কিছু দুর্বলতা থাকে। সব ব্যাপারে কত সাহস তোমার, অথচ ওপরে উঠে নিচদিকে তাকাতে তোমার কী ভয়! ভাইজানের দশতলার বাসায় উঠে তুমি তো জানালার কাছে পর্যন্ত গেলে না।

আমি কি তোমাকে কোনো ব্লেইম দিয়েছি? আমি সাপের ন্যাচার নিয়ে তোমাকে বললাম। এই এই, এখন এ ডানের পথটা দিয়ে যেতে হবে।

আরে! এ পথ দিয়ে হাঁটব কী করে? চারপাশ জুড়ে তো দেখছি আখের খেত।

এখানে জ্যোত্স্না বেশি সুবিধা করতে পারছে না। দু পাশে দাঁড়ানো আখপাতার কুর্নিশে পথ আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

মিলি টর্চ ফেলে।

টর্চটা মিলি এবার আমার হাতে দাও। অঞ্জন ঝেড়ে দাঁড়ায়। সে অনুভব করে, মিলির সাহসের সামনে তার নিজের ব্যক্তিত্ব এতক্ষণ একটু বেশিই দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

বাঁ কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, হাতের প্রান্ত অঞ্জনের হাত ধরা, ডান হাতে টর্চ। অঞ্জন সারাক্ষণ যেমন ভাবনার মধ্য দিয়ে পথ চলে, মিলি তা নয়। তার কাপড় কিছুক্ষণ আগের বৃষ্টির ঝাঁপটে ভেজা, দাঁতে দাঁত টোক্কর খাচ্ছে, কিন্তু তার চোখ তাক করা রয়েছে টর্চের আলোয়। হোঁচট খেতে খেতে গন্তব্যে পৌঁছানোই যেখানে তাদের কাছে প্রধান, সেখানে কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, তার বৃদ্ধ পিতামহ তাদের সঙ্গে কী ব্যবহার করতে পারেন—এ নিয়ে তার মধ্যে কোনো ভাবনাই তরঙ্গ তোলেনি। ব্যাগভর্তি বিস্কুট-কলা আছে, সে বলেছেও অঞ্জনকে, শুনেছই তো, সারাদিন তিনি চুপ করে থাকলেও স্বভাবটা খেপাটে হয়ে গেছে। ঘাড় ধরে বের করে দিলে বারান্দায় বসে থাকব, কিন্তু খাওয়ার ব্যাপারে ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো।

হ্যাঁ, অঞ্জন হেসেছে, যা শুনেছি তাঁর সম্পর্কে তাতে আমাদের জন্য পোলাও-মাংস নিয়ে বসে থাকবেন—এটা আশা করার মতো হাস্যকর বোকামি আর হয় না।

মিলি কী বুঝে টর্চটা অঞ্জনের হাতে দেয়। এরপর খুব সচেতনভাবে ঘুরে অঞ্জনের বাঁ দিকে গিয়ে ওর কাঁধের ওপর একটু বেশিমাত্রায় ভর করে দাঁড়ায়।

টের পায় বৃষ্টির বা অভিরাম শিশিরপাতের ঠাণ্ডায় অঞ্জনের শরীরও থরথর কাঁপছে। মিলি নিজের গায়ের শাল দিয়ে অঞ্জনের কোটটা মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করে ওর গায়ের সঙ্গে নিজের গাটা সেঁধিয়ে দেয়।

এরপর আখবাগানের সরুপথ দিয়ে যাত্রা।

মিলি জন্মের পরে কোনোদিন তার পিতামহকে দেখেনি। মিলির বাবা ও দাদার পথ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছেলেবেলা থেকে যত দারিদ্র্যই থাক ভাইবোনদের সঙ্গে জড়াজড়ি করে বাবা-মা’র স্নেহে বড় হওয়া অঞ্জন মিলির এই নিঃসঙ্গতাকে ভালোই অনুভব করতে পারে। পিতার সমস্ত বিষয়সম্পদ বিক্রি করে স্বদেশী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ত্যাগকে কখনোই বড় করে দেখেনি মিলির বাবা। এ ব্যাপারে মিলির নানাবাড়ির লোকজনের প্রভাব ছিল ব্যাপক। তারা সূর্যসেনকেও কখনো শ্রদ্ধার চোখে দেখেনি।

সূর্যসেন বিপ্লবীদের বিবাহপ্রথায় আস্থাবান ছিলেন না। তিনি ভাবতেন গৃহ, সন্তান, প্রেম বিপ্লবীর পথের কাঁটা। এটা তো বিপ্লবীকে নিজের জীবন উজাড় করে ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে মস্ত এক বাধা। তবু পরিবারের অতিরিক্ত চাপের মুখে সূর্যসেন পুষ্পকুন্তলার মতো এমন এক সুন্দর মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন, যে তিল তিল করে বড় হয়েছে একজন স্বামীকে একজন প্রেমিককে সঙ্গে করে চলার স্বপ্ন নিয়ে।

কিন্তু বিয়ের রাতেই পুষ্পকুন্তলার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়।

পুষ্পকুন্তলাকে সূর্যসেন জানান, সংসারের চাপে পড়ে তিনি বিয়ে করেছেন। এ জীবনে পুষ্পকুন্তলা যেন স্বামীর কাছে প্রেম বা স্পর্শের কোনো আকাঙ্ক্ষাই না করেন। তিনি যেন একজন দেশপ্রেমিক বিপ্লবীর স্ত্রী হিসেবে নিজের প্রেম-আনন্দকে বিসর্জন দিয়ে ত্যাগের ব্রতে নিবেদিত হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করেন।

ফুলশয্যার রাতে সূর্যসেন পুষ্পকুন্তলাকে স্পর্শমাত্র না করে, অন্য শয্যায় শয়ন করে প্রভাতে নিরুদ্দেশের পথে চলে যান।

পুষ্পকুন্তলা বিবাহিতা হয়েও শ্বশুরবাড়িতে দিনের পর দিন কখনো কুমারী জীবন, কখনো বিধবা জীবন যাপন করতে থাকেন। স্বামীর দেখা বছরেও মেলে না। চিঠিও আসে না। মাঝে মধ্যেই খবর পেয়ে আঁতকে ওঠেন ইংরেজ সরকারের দমনমূলক আইনের বিরুদ্ধে মিশন করতে গিয়ে বারবার মৃত্যুর মুখে পড়ছেন সূর্যসেন, জেলে যাচ্ছেন। পুষ্পকুন্তলাকে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কোনো গভীর অনুভবের কথা না চিঠিতে না মুখে কোনোদিন জানাতেন, তাতে যদি পুষ্পকুন্তলার প্রেমিকা হূদয়, ইন্দ্রিয় জাগরিত হয়? রক্তমাংসের পুষ্পকুন্তলা বুকে বিষ চেপে নিষ্কাম প্রেমকেই সম্বল করে মানসিক নিঃসঙ্গতায় দিনের পর দিন ভেঙে পড়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেন।

সৈয়দ মোস্তফা হাসানের আদর্শ গুরু ছিলেন সূর্যসেন।

যদিও তিনি তাঁর অনেক শিষ্যের মধ্যে বলা যায় একজন হারিয়ে যাওয়া মানুষ ছিলেন, তারপরও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বিরুদ্ধে সভা-মিছিল, প্রতিরোধ, নিজের জীবন বিপন্ন করে কখনো গুহায় থেকে, জঙ্গলে আত্মগোপন করে অর্ধাহারে-অনাহারের মধ্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নানারকম আক্রমণাত্মক কাজে তিনি অংশ নিতেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলের তিনিও ছিলেন একজন সদস্য। এর মধ্যে নানা প্রতিকূলতা ভেঙে তিনি শ্বশুরবাড়িতে সন্তানকে দেখতে আসতেন। সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন, সূর্যসেন ইচ্ছে করলেই আর দশটা মানুষের মতো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখের জীবন বেছে নিতে পারতেন। পুষ্পকুন্তলাকে বঞ্চিত করে তিনি নিজেও কি ইহলৌকিক ইন্দ্রিয় প্রেমজ সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেননি? কয়জন মানুষ একটা গোটা দেশকে গৃহে রূপান্তরিত করার স্বপ্নে স্বাধীন করার প্রত্যয়ে নিজের জীবনকে ক্ষণমাত্র তোয়াক্কা করেন না? কিন্তু পুষ্পকুন্তলার বাপের বাড়ির মানুষের মতোই সৈয়দ মোস্তফা হাসানের এই জাতীয় আদর্শকে কোনোমাত্র আমলে আনেনি মিলির দাদির বাড়ির মানুষেরাও। সন্তান জন্মের সময় মিলির দাদি গোঁ ধরেছিলেন, তিনি কিছুতেই এ অবস্থায় বাপের বাড়ি যাবেন না। স্বামীর ভিটাতেই তাঁর সন্তান প্রসব হবে। মিলির বাবার জন্মের সময় মিলির দাদা সূর্যসেনের অন্যান্য আরও শিষ্যের সঙ্গে কারাগারে বন্দি। বিপ্লবী দলের অর্থের প্রয়োজন মেটাতে, আরো স্পষ্ট করে বললে অস্ত্র কেনার জন্য এক ধনীর বাড়িতে ডাকাতি করার সময় তিনি দরা পড়েন।

সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মিলির দাদি মারা যান। এসব কিছুকেই মিলির দাদির বাড়ির মানুষেরা তাঁদের দস্যু জামাতার অবহেলা হিসেবে ধরে নিয়ে মিলির বাবাকে সবার কাছ থেকে রীতিমতো বিচ্ছিন্ন করে নিজের মতো লালন পালন করতে থাকেন।

অঞ্জন, গর্ত! অঞ্জনের এক পা সামনে বাড়ালে মিলি কাঁপতে কাঁপতে বলে। মাথার ওপরে আখপাতার ঝাপট, সমস্ত শরীরে যেন বিষপিঁপড়ের কামড়ানি। সন্তর্পণে মিলিকে টেনে গর্তটা পার হয়ে অঞ্জন জিজ্ঞেস করে, খুব কষ্ট হচ্ছে না?

হচ্ছে।

অঞ্জন ওকে আরও প্রগাঢ়ভাবে নিজের শরীরের সঙ্গে গেঁথে নেয়। মিলি বলে, কষ্টের মধ্যে একটা আনন্দও আছে, কাশেম চাচা দাদার সম্পর্কে আমাদের এসব না বললে মানুষটি নিঃশব্দেই মরে যেতেন। বাবা বেঁচে থাকতেও চিরদিন আমি নিজেকে এতিম ভেবে এসেছি। এখন রীতিমতো অহংকার হচ্ছে, আমার গর্ব করার মতো পৃথিবীতে একজন পূর্বপুরুষ এখনো বেঁচে আছেন। তাছাড়া… আমার দাদার কাছে যাওয়ার জন্য তোমার আগ্রহ, তোমার ধৈর্য… বিশ্বাস করো অঞ্জন, তোমাকে আমার এত অভিন্ন এর আগে কখনো মনে হয়নি।

মিলি ছেলেবেলায় দেখেছে তার ধনাঢ্য বাবাকে। নানাবাড়ি থেকে পাওয়া সম্পত্তি তার আগেও ছিল, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে কাজ করে যুদ্ধের পর তিনি কোটিপতি হয়ে যান। সৈয়দ মোস্তফা হাসান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তাঁর জমিদারি ধাঁচের বাড়িতে প্রচুর যোদ্ধাকে আশ্রয় দিয়ে, তাদের নানাভাবে সাহায্য করে তাঁর সংগ্রামী চেতনা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ফলে যুদ্ধের এক বছর পর পুত্র যখন তাকে দেখতে যায়, তিনি ভেতর থেকে হাত নেড়ে নেড়ে বলেছিলেন, ওর মুখ দর্শন করাও আমার জন্য পাপ। ওকে আমি ত্যাজ্য করেছি। ও যেন আমার দরজায় পা না রাখে।

সেই বাবাই মিলির মাকে খুন করে এলিজাবেথ নামের বিদেশি মহিলাকে বিয়ে করে আমেরিকায় চলে যায়। মিলি বাবার পাঠানো অর্থকে তাচ্ছিল্যে মাড়িয়ে কখনো দূরাত্মীয়দের বাড়িতে থেকে কখনো টিউশনি করে নিজেকে জীবনের এই প্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে।

কাঁটাঝোপের আঁচড়ে দুজনের পা-ই রক্তাক্ত। আখবনের ফোঁকড় গলে গলে আসা কনকনে বাতাসে অঞ্জনের মনে হয় তার সারা দেহে রক্ত-মাংস কিছু নেই, সে যেন আস্ত এক হাড়-পাথরের চাঁইয়ে পরিণত হয়েছে। কুয়াশার ছত্রাকে ঢাকা ছায়া ছায়া আঁধার। এরমধ্যেও ফিনকি দিয়ে ওঠে বৃদ্ধ কাশেম আলীর মুখ, মিলি আর অঞ্জন অফিস থেকে ফিরে বারান্দায় বসে বৈকালিক চা পান করছিল। মিলির দাদার কথা বলার জন্য এই মানুষটি যেন গভীর কোনো কোটরের গহ্বর থেকে উত্থিত হয়েছিলেন। কাশেম আলী কথা বলে যাচ্ছেন। আধাকাপ চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। বারান্দার বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে, আর শেকড়ছিন্ন মিলি তার বাবার ঘৃণ্য মুখটাকে সরিয়ে আরও ওপরে হাত বাড়ানোর আকাঙ্ক্ষায় কম্পিত। তার পাশে বসে অঞ্জনও। এরকম একজন  মানুষ কী করে সবার দৃষ্টির বাইরে গিয়ে গুহাজীবনের মধ্যে বাস করতে পারেন? কাশেম আলীর চোখে আলো। ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই/দীন-দুখিনী মা যে তোদের, তার বেশি আর সাধ্য নাই।’ আহা! কী গলা মোস্তফার। দল কইরা কইরা গান করতাছে। বিলাতি পোশাক পুড়ানি হইতাছে। স্বদেশীদের গান হুনবার লাইগা হাটেবাজারে মানুষের ভিড়।

মিলির অন্তরাত্মায় হাহাকার। হায়! আমার পিতামহ, সৈয়দ মোস্তফা হাসানের পুত্র এবং মিলির জনকের জৌলুসময় বর্বরতার প্রাচীর একই আকাশের নিচে নাতনি এবং দাদাকে এতকাল কী সুবিশাল অন্ধকারের মধ্যেই না ঢেকে রেখেছিল।

আখবনটা পেরোবার মুখে হাঁটু ভেঙে মিলি বসে পড়ে।

মিলি, মিলি ওই যে। মিলির হাত টেনে অঞ্জন তার শরীরের শত আঘাত মুহূর্তে ঝেড়ে উদ্ভাসিত। মিলিও তাকায়, রূপকথার গল্পের মধ্যে যেনবা, গভীল জঙ্গলের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া কোনো মানুষ দেখল দূরে কোথাও বাতি জ্বলছে, এগিয়ে যেতে যেতে হঠাত্ দেখে, এক নিঃসঙ্গ প্রাসাদ। তার অদূরেই দাঁড়ানো পুরনো মন্দিরের মতো এক ভাঙাচোরা বাড়ি। বারান্দায় টিম টিম জ্বলছে আলো।

হঠাত্ যেন মাটি ফুঁড়ে জেগে উঠেছে এক প্রাচীন প্রসাদ। তার সামনে কঠিন মাটিতে ধাক্কা খেয়ে চাঁদ মুহূর্তে খানখান হয়ে যায়। কুয়াশা আর আঁধারের মিশেলে ক্রমশ সামনের সবকিছু ঝাপসা করে একচক্ষু বাতি ওদের দিকে তাকিয়ে।

সামনের ওইটুকু পথই অনন্ত। মিলি অনুভব করে, এতটা পথ পেরিয়ে এসে সামান্য ওই রাস্তাটুকু পেরোতে গিয়ে সে মুখ থুবড়ে পড়বে। অঞ্জনের বোধ হয়, ওই নিভৃত জীবনযাপন করা বৃদ্ধের কিছুমাত্র খোঁজ না নিয়ে গার্হস্থ্য শয্যায় বসে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো এতকাল সে যেরকম হাই তুলেছে, সৈয়দ মোস্তফা হাসানের দৃষ্টির তীরে সেসব যেন মুহূর্তে ফালা ফালা হয়ে যাবে। চতুষ্কোণ সেই সীমারেখার ভেতর দাঁড়িয়ে দুজন দেখতে পায়, সামনের জরাজীর্ণ প্রসাদটি প্রবল শব্দ তুলে ভেঙে পড়তে চাইছে।

পিশাচপুর, পা হেঁচড়ে এগোতে এগোতে অঞ্জন শুনতে পায় তার কানের পাশে কেউ এ শব্দটি উচ্চারণ করে গেল। ভয়ে অঞ্জনের রোমকূপ শিরশির করে ওঠে।

ওরা যখন বারান্দার কাছে, চোখের কুয়াশা কেটে দেয় কেউ। বাতির নিচে স্পষ্ট হয়, খাটিয়ায় শায়িত এক বৃদ্ধের লাশ। আর তার চারপাশ ঘিরে মর্সিয়া তুলে কাঁদছে একদল মানুষ।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত