স্বাধীনতা

স্বাধীনতা

“তিন্বী, আয় দিদিভাই, একটু তেল মাখিয়ে দি।”
“দাও, জানো তো দিদান, আমি বাড়িতে তেল মাখিই না। মা তোমার মতো মাসাজ করতেই পারে না। শুধু মামাবাড়ি এসে তোমার হাতেই তেল মাখি।”

“তোর মাও তো ছোটবেলায় তেল মাখতো না। তাকে তেল মাখানো ? বাবারে সেকি ঝক্কি!”
“হিহিহি। এদিকে মা যে বলে মা তোমার সব কথা শুনতো।”

“সব শুনতো, শুধু তেল মাখা টা ছাড়া। তা দিদিভাই, বাড়ি গিয়ে কি করবি? তুই নাকি এবার কলেজে যাবি। কোন কলেজে যাবি রে?”

“দেখি শাল্মী যেখানে পড়বে, আমিও সেখানে পড়বো। আমরা দুজনেই তো জিয়োগ্র্যাফি নেব। তাই একসাথে পড়বো। আচ্ছা দিদান তুমি কলেজ গেছিলে?”

“নারে দিদিভাই, আমার আবার কলেজ! তখন দেশ স্বাধীন হচ্ছে, ঘরের বাইরে বেরোতেও বুক ধুকপুক করতো, চারিদিকে পুলিশ আর মানুষে-মানুষে কাটাকাটি। ইস্কুল কলেজে বাড়ির মেয়েদের আর কে পাঠাবে!”
“যাহ তুমি কোত্থাও যেতে না তাহলে? কি করতে ঘরে বসে বসে?তোমার কোনো বন্ধু ছিল না? এই আমার আর শাল্মীর মত?”
“বন্ধু!”

“ও দিদান, কি হলো। চুপ করে গেলে কেন?”
“হ্যাঁ রে বন্ধু ছিল। বোনও বলতে পারিস, সে ছিল এক ভারী ডাকাতে মেয়ে। আর ঘরে কেন থাকবো রে? গাছে গাছে পেয়ারা, আম চুরি করতাম, পুকুরে,খালে, নদীতে সাঁতার কাটাতাম। শুধু ইস্কুলেই যেতাম না, এই যা।”
“তুমি গাছে উঠতে পারো? সাঁতারও কাটতে পারো? ”

“হ্যাঁ রে বাবা, গাছে উঠতে পারবো না? আমি কি আর তোর মত শহরের মেম! তবে সাঁতার কাটতে পারতো আলোকা, আমাদের সবার থেকে ভালো। স্রোতের উল্টো দিকেও তরতর করে চলে যেত।”

“কে আলোকা, দিদান?”
“আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। এক সাথে দুজনে বড় হয়েছিলাম। তবে সে ছিল ঠিক আমার বিপরীত। নিয়ম মানতো না। মাঝে বৃহঃস্পতি বারও মাছের বড়া বানিয়ে খেত। এলো চুলে সন্ধ্যে বেলা ঘুরে বেড়াতো। সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেত। আর বারণ করলে বলতো, ‘মা সরস্বতী কি কুল না খেলে আমায় ইস্কুলে যেতে দেবেন?’ পাপ-পুন্য কিছুই মানতো না সে!”

“এগুলো আবার কি নিয়ম? আমিও তো মানিনা। আলোকা দিদান তো দারুন। আমাদের বাড়ি নিয়ে আসবে একদিন। প্লিজ।”

“একি দিদান! তুমি কাঁদছো? আলোকা দিদানের কথা মনে পড়ছে? ফোন নাম্বার টা বলো আমায়। এখুনি কথা বিলিয়ে দিচ্ছি।”

“তাকে আর কই পাবো?সে কবে পালিয়েছে। ”
“পালিয়েছে! কোথায় পালিয়েছে? কেন পালিয়েছে?”
“বলছি রে বাবা বলছি, তখন দেশে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন হচ্ছে। আমার রমেন দাদাও স্বদেশী করতো। তার মুখে কত গল্প শুনতাম, যুদ্ধের, পুলিশের, বিপ্লবী দের। দাদাই আমায় আর আলোকাকে লেখাপড়া সেখাত। মাঝে মাঝে বই এনে দিত। আলোকা পড়তে খুব ভালোবাসতো। ”

“বাহঃ দিদান। ফুলদাদু ফ্রীডম ফাইটার ছিল?”
“কি ছিল?”
“উমম, ও কিছু না। তুমি তারপর বলো।”
“হ্যাঁ, তারপর। তারপর আস্তে আস্তে বড় হলাম। অলোকার তখন বয়স ১৪, আমার থেকে ও একটু বড় ছিল বয়সে আর চেহারাতেও। তাই তো ওকে নিয়ে ওর মা-বাপের দুশ্চিন্তাও বেশি ছিল। তখনকার দিনের বামুনের মেয়ে। ১৪ পেরোনোর আগে বিয়ে না দিলে সমাজে ঢিঢি পড়ে যাবে। পরিবারকে একঘরে করে দেওয়া হবে। সে কত নিয়ম! কিন্তু ব্রাহ্মণ ছেলেও পাওয়া যায় না ওর জন্য। আর পাওয়া গেলেও হয় রাশিতে মেলে তো গণে মেলে না, আর গণে মেলে তো পণে মেলে না। শেষমেশ আলোকার বিয়ে ঠিক হয় এক বৃদ্ধের সাথে। কুলীন ব্রাহ্মণ সে। কন্যাদায়গ্রস্ত বাপেদের কাছে সে ছিল ভগবানের দূত! কিন্তু আলোকা সেই মরমর বুড়োর সাথে কিছুতেই বিয়ে করতে চায় না। জোর করে, মেরে ধরে, তার মা তাকে বাধ্য করলো। আমার দাদা আলোকাকে বোনের চোখে দেখতো। দুজনে একসাথে দাদাকে ফোঁটা দিতাম কিনা। তাই দাদা আর এই অন্যায় সহ্য করতে না পেয়ে নিবারণ কাকাকে বোঝাতে গেল। কিন্তু দাদার কোনো কথাই ধোপে টিকলো না। সেদিন আলোকা কে দেখে দাদা কাঁদ কাঁদ গলায় বলেছিল, ‘দেশ স্বাধীন হচ্ছে রে, মানুষের মন টা স্বাধীন হল না। তোকে কি করে বাঁচাই বল তো বোন?’ আলোকা হাসতে হাসতে বলেছিল,’কি করে বাঁচাবে রমা দা, তুমি কি আমায় বনফোঁটা দিয়েছিলে? তাই আমার জন্যও জোমের দুয়ারে কাঁটা পড়েনি।’

চোখের সামনে আমার প্রাণের বন্ধুটার জীবন শেষ হতে যাচ্ছিল, দেখছিলাম, কিন্তু কোনো প্রতিবাদের সাহস আমার ছিল না। বিয়ের দিন আলোকা কে সাজানোর দায়িত্ব আমার ছিল। দেখি কেমন যেন গুম মেরে বসে আছে। আমি ডাকতে বলল,’আমি পাপ করবো চারু।’

আমি বললাম ‘কি পাপ করবি?’
বলল সে নাকি পালয়ে যাবে। আমি বললাম,’এমন কথা বলিস না। তোর মা বাপকে গলায় দড়ি দিতে হবে যে।’ আমার কথা শুনে সে চুপ করে গেল। বিয়েও হয়ে গেল আলোকার। ”

“দিদান তারপর কি হলো?”
“তারপর দীরাগমনে সে বাপের বাড়ি এল। পান পাতার মত মুখ খানা তার সিঁদুরে মুড়ে কি সুন্দর যে লাগছিলো দিদিভাই। কিন্তু অদৃষ্টের সাথে কে পারে টেক্কা দিতে! দীরাগমনের দিনই তার স্বামী মারা গেল। সবাই বলল আলোকা নাকি সতী, তার নাকি সতীদাহ হবে। যদিও সরকার থেকে তখন এসবে নিষেধ ছিল। কিন্তু সেসব কথা মানতো কজন! ধর্মের কাছে যে আইন কানুনও অসহায় হয়ে পড়ে! নিরাপদ কাকা আর কুসুম কাকিমাও না না করে শেষে রাজি হয়ে গেল, আলোকার পর আরো চারটে মেয়ে তাদের। তার উপর বিধবার খরচ চালানো কি কম বড় ঝক্কি! আর তারা গত হলে ও মেয়েকে যে সমাজের পাপ ছিঁড়ে খাবে, তার চেয়ে সতীর মত স্বর্গে যাক আলোকা, এতে মেয়ের মা-বাপের স্বর্গের সিঁড়িও পাকা হবে। এসব শুনে আলোকা কিন্তু একটুও কাঁদেনি। ভিটের দাওয়ায় দাঁত কামড়ে বসে ছিল। আমি কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিলাম। সে আমায় শান্ত ভাবে বললে,’ কাঁদছিস কেন? আমি যে আজ পাপ করবো চারু, নরকে যাবো তাও ভালো,স্বর্গ আমার সইবে না।’”

“দিদান ফুলদাদু কেন বাঁচলো না আলোকা দিদান কে?”
“সেদিন তো ১৫ই আগস্ট, ১৯৪৭। দাদা কে আর পায় কে? সে তখন স্বাধীনতার উৎসবে সামিল।”
“তারপর কি হলো দিদান? ওরা তোমার বন্ধুকে পুড়িয়ে দিল?”

“তারপরের গল্পটা আমারও শোনা রে দিদিভাই। শ্মশানে যে আমার যাওয়ার অনুমতি ছিল না। সেদিন ঘরের দরজায় ওকে শেষবার দেখি। কিন্তু মরার সাথে যারা গেছিল তাদের মুখে সে এক অন্য গল্প শুনলাম।”
“কি গল্প দিদান? আলোকা দিদান কি ফিরে এসেছিল?”

“নারে দিদিভাই, সবাই বলল সতীদাহের আগে ওকে নাকি স্নান করাতে গঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখন নদীতে ভরা জোয়ার। স্রোতের টানে নাকি ওর হাত ছাড়িয়ে যায়। তারপর আর ওকে পাওয়া যায়নি। সবাই তো দারুন খুশী, মা গঙ্গা নাকি সতীর বিসর্জন নিয়েছেন। কিন্তু যে আলোকাকে আমি চিনি সে নদীতে ডুবে মরার মেয়ে নয়। জোয়ারের জলে ও কতবার সাঁতরেছে নদীতে, স্রোতের উল্টো দিকে সাতঁরাতো আর বারণ করলে বলতো,’স্রোতের সাথে শুধু মরা মাছ ভেসে যায় রে চারু।’”

“তাহলে কি আলোকা দিদান বেঁচে গেল পরে?”
“জানি নারে দিদিভাই। সেদিন মিষ্টি হাতে দাদা ঘরে ঢুকেছিল। তারপর খবরটা শুনে হাউহাউ করে কেঁদেছিল ও। আমি বললাম ‘কাঁদিস না দাদা, আজ তো দেশ স্বাধীন হয়েছে। আলোকাও স্বাধীন হল রে, এখানে থাকলে ওকে যে সবাই পুড়িয়ে মারতো রে দাদা।’ মনে মনে আমি আজও বিশ্বাস করি, সেদিন একমাত্র আলোকাই স্বাধীন হয়েছিল। ধর্মের জ্বালা, বৈধব্যের জ্বালা, পচে,গলে এই পাপের জীবনে জীবন ভোর জ্বলার জ্বালা থেকে সেদিন একা আলোকাই বুঝি মুক্তি পেয়েছিল।”

“আর তোমরা? আমরা? আমরা কেউ মুক্তি পাইনি, স্বাধীন হইনি দিদান?”
“আমরা! আমাদের তো মুক্তি নেই রে দিদিভাই, আমরা তো যেদিকে সমাজের স্রোত যায়, সেদিকেই ভেসে যাই, মরা মাছের মত। মরার আবার স্বাধীনতা! আমাদের মধ্যে ঐ কি যেন বলে,’বিদ্রোহ’ করার জো আছে নাকি? আলোকা একাই হয়ত ঘাড় কাত করে সবকিছুকে মেনে নিতে শেখেনি। হয়ত ও একাই জানতো নদীতে ভেসে ভেসে সমাজের এই নোংরা স্রোতের উল্টো দিকে কোথায় মুক্তির একটা ঠিকানা পাওয়া যায়! তাই ওর হারিয়ে যাওয়াতে আমার খুব গর্ব হয়েছিল রে। স্বাধীনতা দিবসে আমি প্রতি বছর আলোকার জন্য মন্দিরে পুজো দি। কেউ যাকে সতী বলে চেনে, ধর্ম যাকে হয়ত পাপী ভাবলেও ভাবতে পারে, তার জন্য ভগবানের কাছে মঙ্গল কামনা করি। যদিও আমি জানি নারে দিনটা তার মৃত্যু দিবস না স্বাধীনতার দিন!

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত