বিদায় বন্ধু

বিদায় বন্ধু

হাসপাতাল থেকে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে এসে সোফায় বসে পড়লাম। শরীরে কোথাও জোর পাচ্ছি না। পুরো ঘরে কেমন একটা নিঃসঙ্গতা। এই ঘরে আমার আর ফিরতে ইচ্ছে করে না। তবুও রোজ ফিরে আসি- ফিরতে হয়। দরজার তালা খুলতে খুলতেই মনটা বিষিয়ে উঠে। জানি দরজার ওপাশে কেউ আমার জন্য অপেক্ষায় নাই। এই কিছুকাল আগেও কলিংবেল বাজাতেই দরজার ওপাশ থেকে শোনা যেত, ‘আরে বাবা আসছি তো… একটু দাঁড়াও না… উফ! একটু যদি ধৈর্য থাকে মানুষটার!’

মাত্র দু’জন মানুষ আমরা এই ঘরে। বউ তিন মাস হলো হাসপাতালে। আমাদের সবাই আছে। কিন্তু কেউ নেই। নিজেদের মতো বিয়ে করে আমরা আলাদা একটা দ্বীপ হয়ে গেছি। এই দ্বীপে কেউ কখনো পা রাখেনি। রাখতে চায় না। আমরা সেতু বানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অন্য পার গুলো দিনের পর দিন কেবল দূরেই সরে গেছে।

হাসপাতালে যতক্ষণ থাকি ততক্ষণ বউয়ের হাতটা ধরে থাকি। কপালের সিথানে হাত বুলাই। আমি টের পাই আমার হাতের মুঠোয় বউয়ের হাত আর বেশিদিন ধরে রাখতে পারবো না। বউও টের পায়। ও কেমন যেন পাগলের মতো আমার আঙ্গুলের ফাঁকেফাঁকে ওর আঙ্গুল ঢুকিয়ে আমায় আঁকড়ে ধরতে চায়। ওর স্পর্শটুকু আমি বুঝি। ও আমায় ছাড়া এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে চায় না। কিন্তু সময় ফুরিয়ে আসছে। বুকের ভিতরে কেমন এক শূন্যতা টের পাই। আমার অফিস করতে সমস্যা হবে বলে আমাকে জোড় করে ও বাসায় পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু আমার তো রাতে ঘুম হয় না। এই সোফা, এই জানালার পর্দা। বিছানা বালিশ সবখানেই যে বউয়ের গায়ের গন্ধ। অথচ ও নেই এই ঘরে। ওর গায়ের গন্ধ ওর শূন্যতাটা আরো বেগবান করে।

আজ হাসপাতাল থেকে আসার আগে ও বলল ওর খুব বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে। এখানে ওর আর ভালো লাগছে না। যা হবে হোক ও বাসায় যাবে। বউ কি বুঝে গেছে তাহলে ওর আর বাসায় ফেরা হবে না। ওকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত রেখে অনেক কষ্টে শান্ত করলাম। ও আমার বুকে হাত রেখে গুমরে গুমরে কাঁদছিলো তখনো। হঠাৎ আমার শার্ট খামচি দিয়ে ধরে বলল, ‘এই তোমার বুক এমন করে ধড়ফড় করছে কেন! কি হয়েছে তোমার?’ আমি ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলি, ‘কিছু হয়নি। বোকা হৃৎপিণ্ডটা তোমার হাতের ছোঁয়া পেয়ে তোমায় ছুঁয়ে দিচ্ছে।’ বউ কান্না চোখে হেসে দিলো।

আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। তখন ও বলল, ‘তুমি এতো সুন্দর করে মিথ্যে কিভাবে বলো!’ আমি চুপচাপ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। ও ঘুমিয়ে পরে। আমার হাতে ওর চুলের গন্ধ নিয়ে ঘরে ফিরি। একদিন ওর চুলের গন্ধ, গায়ের গন্ধ আমার কাছ থেকে আলোকবর্ষ দূরে চলে যাবে।
আমার জীবনে সবচেয়ে কাছের বন্ধু আমার বউ। যখন এই শহরে দু’জনে ছোট্ট একটা ঘর বাঁধি তখন কিছুই ছিল না আমাদের। ওর জন্য একটা ড্রেসিং টেবিল পর্যন্ত কিনতে পারিনি এক বছরে। মেঝেতে ছিল আমাদের বিছানা। জানালায় পর্দা। আর একটা মাত্র টেবিল। কোন চেয়ার ছিল না। একটা রুমে আমাদের সংসার পাতি। কোনদিন কোনকিছু নিয়ে ওর কোন আপত্তি শুনিনি। আমার রোজগার ভালো ছিল না। ওর শখের কোন কিছু কিনে দেওয়ার সাধ্য ছিল না।

ও হুইলচেয়ার ক্যারি করতো। তাই নিচতলায় আমাদের বাসা নিতে হয়েছিলো। বাসাটা একটু অন্ধকার ছিল। কিন্তু পুরো ঘরে আলো হয়েছিলো আমার বউটা। সেই আলো এখন আস্তে আস্তে করে নিভে যাচ্ছে। আমার হাতের মুঠোয় থেকে সরে যাচ্ছে সব উষ্ণতা। সব আদর। সব দস্যুতা। রোজ সন্ধ্যায় ফোন করে জিজ্ঞাস করা, ‘আর কতক্ষণ তোমার বউটাকে একা একা রাখবে?’ সব কথা, সব আদুরে অভিমান ধীরেধীরে মিইয়ে যাচ্ছে।

আমাদের সংসারে আজ তো কোনকিছুর কোন অভাব নেই। অনেক সুন্দর বড় ঘর আমাদের। একদিন এমনো সময় গেছে এক প্লেট ভাত দু’জনে খেয়েছি। রাতে সব সময় আমিই খাইয়ে দেই বউকে। ও বিছানায় থাকলে হুইলচেয়ারে উঠানামা একটু কষ্টের হয়ে যেত। খাট থাকলে অবশ্য এতো সমস্যা হতো না। কিন্তু তখন তো আমার খাট কেনার সাধ্য ছিল না। আজ আমাদের সংসারে অভাবটুকু নেই। কিন্তু যেই অভাবটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে তা যে আর কোনকিছু দিয়েই পূরণ হওয়ার মতো না। আমার এই বউটা ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার তো এখন আর কেউ নেই।
ডাক্তার বলে দিয়েছে আর কোন আশা নেই। বউকে আমি পারলাম না একজীবনের সবটুকু সুখ দিতে। গতকাল ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলাম ওর কাঁধে চিবুক রেখে। বললাম, ‘তোমায় তো আমি সুখী করতে পারলাম না! তোমার আমার উপরে রাগ হয় না?’

বউ আমার হাতের উপর হাত রেখে বলল, ‘তুমি আমায় সুখী করার কোন চেষ্টাই করোনি কখনো। যা করেছো সব আমায় ভালবেসে করেছো। আর তাতেই যে আমি সুখী হয়েছি একবারো কি বুঝনি বুদ্ধু?’

‘কি করে সুখী করলাম?’
‘এই যে আমায় এতো গভীর করে জড়িয়ে আছো এটা কি আমায় সুখী করার জন্য করেছো?’
‘নাতো!’
‘তাহলে কেন এভাবে ধরেছো?’

‘এভাবে ধরলে তোমার চুলের গন্ধ পাওয়া যায়। তোমার গায়ের গন্ধ পাওয়া যায়। এই গন্ধগুলো আমার ভীষণ প্রিয়!’
‘আর তুমি এটা বুঝলে না বুদ্ধু, তোমার এই জড়িয়ে ধরাটা আমায় কত সুখী করে! তুমি যখন অফিসে যাওয়ার সময় বারবার পিছন ফিরে তাকাতে, সেটা আমার সুখ। তুমি যখন ঘুম থেকে উঠে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে, সেটা আমার সুখ। তুমি খাওয়ার পরে আমার ওড়নায় হাত মুছতে। হুইল চেয়ার থেকে কোলে করে আমায় বিছানায় বসাতে। তুমি যখন মুখে তুলে খাইয়ে দাও সেটা আমার সুখ। তুমি যখন… তুমি যখন আমার জন্য বেলী ফুল নিয়ে আসো; বকুল ফুলের মালা নিয়ে আসো; আমার চুলে তেল লাগিয়ে দাও; আঙুলের নখ কেটে দাও; ঘুমাবার আগে কপালে চুমু দিয়ে দাও। এই গুলাই তো আমার সুখ। এই সুখ আমি কোথায় পেতাম বলো তুমি ছাড়া?’

আমি আর কিছুই বলতে পারিনি। বুকটা কেবল ধুকপুক করে যাচ্ছিলো আর একটা কথাই মনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো- এতো এতো সুখ ছেড়ে আমার বউটা কি করে থাকবে? ও আমায় ছাড়া একা একা কি করে থাকবে? কি করে ও আমায় একা করে চলে যাবে?

শাওয়ার নিয়ে বিছানায় শুয়ে সিগারেট ধরালাম। বউকে প্রতিদিন রাতে ঘুম পারিয়ে বাসায় আসি। নার্সরা খুব অবাক হয়ে আমাকে বলে, এই রোগীর পেশেন্টদের অনেক কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়েও ঘুম পাড়ানো যায় না। অথচ ও কত লক্ষী হয়ে এক ঘুমে রাত পার করে। ওকে দেখলে বুঝাই যায় না এতো অসুস্থ ও। আমি আলতো করে হাসি। কিছু বলতে পারি না।

সেলফোন বাজছে। রাত প্রায় দেড়টা। এতো রাতে ফোন আসার কথা না। হাসপাতাল থেকে ফোন। বুকটা ধ্বক করে উঠলো।

‘হ্যালো!’
‘শাকিল সাহেব বলছেন?’
‘জ্বি!’
‘আপনি এক্ষুনি হসপিটালে আসুন প্লিজ।’
‘কেন কি হয়েছে? প্লিজ বলুন কি হয়েছে?’
‘আপনার স্ত্রী। শী ইজ… প্লিজ আসুন আপনি। কাউকে খবর দেওয়ার থাকলে দিয়ে দেন।’

হাতটা নাকের কাছে নিয়ে দেখি। এইতো এখনো ওর চুলের গন্ধ আমার হাতে লেগে আছে। এখনো ওর শরীরের উত্তাপ আমার বুকে লেগে আছে। অথচ ও। ওর বাবা মাকে কল দিলাম। কেউ ফোন ধরলো না। ম্যাসেজ দিয়ে জানালাম।

বাসা থেকে বের হতেই হিমেল হাওয়ায় সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। বাসর রাতে ওর কথা গুলো কানে বাজছে, ‘শোনো তুমি কিন্তু কখনোই আমার আগে মরতে পারবে না বুদ্ধু। তাহলে কিন্তু আমি ভীষণ রাগ করবো। আমি পারবো না তোমায় ছাড়া এই পৃথিবীতে একা একা বাঁচতে। আগে আমি মরবো। তারপর তুমি। ঠিক আছে তো। আর শোনো আমি যেদিন মরে যাবো সেদিন তুমি আমার জন্য বেলী ফুলের মালা নিয়ে আমার হাতে পরিয়ে দেবে তো। শোনো না, তুমি কিন্তু একদম কাঁদবে না। আমার কান্নাকাটি একদম পছন্দ না। তুমি আমার কানের কাছে ফিসফিস করে রবি ঠাকুরের শেষের কবিতা শোনাবে কেমন…।’

আজ রাতে আমি কোথায় পাবো বেলী ফুলের মালা। বাসর রাতে ওর কোন কথাই আমি ফেলিনি। ও যা যা বলেছে সব মেনে নিয়েছিলাম। আমার বুকে সব কথাই আজ পেন্ডুলামের মত দুলছে। ওর খুব ইচ্ছে ছিল মাঝরাতে রিক্সায় চড়ে চট্টগ্রাম শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে। অনেক রাত পর্যন্ত সিআরবি’তে বসে থাকবে। আমরা একটা ফুচকাওয়ালা ভাড়া করবো। ও যখন খেতে চাইবে ফুচকাওয়ালা ফুচকা বানিয়ে দিবে। আমার কোলে চড়ে রাস্তা থেকে নেমে গগন শিরিশ গাছের নিচে গিয়ে বসবে।

একটা রিক্সা পেয়ে উঠে বসলাম। মনে হচ্ছে এই রাস্তাটা যেন কোন গন্তব্যে গিয়ে না মিলুক। বউয়ের যেই ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখটা আমি দেখে এসেছি সেই মুখটাই বুকের বাম পাশে তোলা থাকুক। এই রিক্সাটা বরং আজ কোথাও না ফিরুক। সব স্বপ্ন উড়ে যাক হিমেল হাওয়ায়। সব কথা ঝড়ে পড়ুক শিশির ফোঁটার মতো। কেবল বাতাস আজ ফিসফিস করে কানে কানে বলে যাক-

‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।
তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,
চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন
ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল
তুলে নিল দ্রুতরথে
দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে
তোমা হতে বহুদূরে।
মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়,
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়…’
হে বন্ধু, বিদায় ||

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত