ছোটলোক

ছোটলোক

কড়া নাড়ানোর সাথে সাথেই দরজা খুলে দিলেন বাবা৷ মুখে প্রতিদিনের মত হাসি৷
আমার চোখ জোড়া চট করে ডাইনিং এর চেয়ারে বসা সুদর্শন চামড়ায় ভাজ পরা সাদাচুলো মানুষটার চোখে গিয়ে পরে৷

মানুষটা হেসে উঠে৷
দ্রুতপায়ে এসে আলিঙ্গন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ কপালে স্নেহের চুমু দেয়৷
মানুষটাকে আমি চিনতে পেরেছি ঠিকই৷
তারপরও বাবার দিকে তাকালাম একবার৷
বাবা সহাস্যে পরিচয় দেয় “তোর রহমত চাচা! ঐযে পাশের বাড়িতে থাকতো৷ যার ঘরে রঙ্গিন টিভি ছিল৷”
বাবা আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলেন৷
আমি থামিয়ে দিই৷

রহমত চাচা মেয়ে নিয়ে এসেছেন৷ গোলগাল চেহারার সরু নাকের মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে ফেলে মেয়েটি৷
মুখে লজ্জা মাখানো হাসি৷
লজ্জা মিশ্রিত হাসিতে সুদর্শিনীদের দেখতে বড্ড ভালো লাগে৷ সুযোগটা হাত ছাড়া করলাম না৷

রহমত চাচা দাঁত দুপাটি বের করে হাসি দিয়ে বলে,
-আমার মেয়ে৷
আমি হালকা মাথা নাড়ি৷ রুমের ঢোকার আগে রহমত চাচার দিকে আরেকবার তাকালাম৷
বাবার সাথে জমিয়ে আড্ডা দিয়ে চলেছেন৷

বাবা আমার বিয়ের ব্যাপারে কিছুদিন ধরে হা হুতাশ করছিলেন৷ ফলস্বরূপ আজকে রহমত চাচাকে বাসায় হাজির করালেন৷
রহমত চাচাকে আমি সবশেষ দেখেছি আমার মায়ের মৃত্যুর দিন৷
মুখটা থমথমে করে রেখেছিল৷
যেন আমার মায়ের মৃত্যুতে তিনি বড্ড শোকাহত৷
-মিলিকে তোর কেমন লাগে?
খাবার টেবিলে সুযোগ বুঝে বলে বসলো বাবা৷

বাবার পাশে বসা রহমত চাচার দিকে তাকালাম একবার৷ আরেকবার মিলির দিকে৷ রহমত চাচা অধীর আগ্রহে আমার জবাবের আশায় বসে রইলেন৷ অপর পাশে মিলি মেয়েটা লজ্জায় লাল হচ্ছে৷

টেবিলে বসা তিনটে মানুষই আমার উত্তরের অপেক্ষায়! নিজেকে হুট করে গুরুত্তপূর্ণ ব্যক্তি মনে হল৷
আমি জবাব না দিয়ে ভাত মাখিয়ে পরের লোকমাটা মুখে দিলাম৷ চিবোতে চিবোতে আরেকবার তাকালাম রহমত চাচার দিকে৷ কটমট মুখে বিরক্তির চাপ আড়াল করতে তিনি মৃদ্যুভাবে হাসলেন৷
উনার হাসি দেখে আমারও হাসি এসে হাজির মুখে৷
চেপে রাখলাম৷
মিলি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো৷
মেয়েটা বোধহয় লজ্জা পেয়েছে৷

-কিরে কিছু বলছিস না?
বাবা বললেন৷
-হ্যা ভালোই লাগলো৷ রুপবতী সাথে লজ্জাবতী৷
আমার উত্তর শুনে বাবা তার হাই পাওয়ারের চশমাটা নাকের ডগায় এনে তার উপরে চোখ দিয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করলো একবার৷
আমি দাঁত দু’পাটি বের করে হাসি দিই৷
রহমত চাচার মুখে প্রশান্তির হাসি৷
গপাগপ প্লেটের ভাত শেষ করায় মনযোগ দিলেন রহমত চাচা৷
আমার উত্তরের অপেক্ষায় বেচারীর খাদ্যনালি এতক্ষণ আটকে ছিল বোধহয়৷

খাওয়া শেষে বাবার সাথে আড্ডায় মশগুল হয়ে পড়ে রহমত চাচা৷
চাচার অষ্টাদশী গোলগাল চেহারার মেয়ে মিলি আমার রুমে উকিঝুকি মারার চেষ্টা করছে৷
ভাবলাম ভেতরে ডাকি৷ আড্ডায় মশগুল হয়ে পড়ি৷
পরক্ষণেই ভাবলাম, না থাক৷ কিছুক্ষণ চোর-পুলিশ খেলা হোক৷ চোখাচোখি হলে ডাক দিবো৷ মেয়েটা ধরা পড়ে লজ্জায় লাল হবে৷
চোখ দু’টো নিচু করে গুটি পায়ে আমার পায়ের পাশে এসে বসবে৷
আমি তখন মনভরে দেখে নিবো৷
একদম শেষ দেখা৷

মনমতো ভুড়িভোজ করে শুয়েছিলাম৷ চোখটা লেগে এসেছিল৷
বাবার কর্কশ ডাকে ঘুম পগারপাড় হলো একদম৷
চোখ কচলে বাবা আর রহমত চাচার সামনের সোফাটাতে বসি৷
রহমত চাচা পান চিবোতে চিবোতে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-ভাই সাহেব৷ শুভ কাজে দেরী করতে নেই৷ আপনাদের মতামতটা জানিয়ে দিন৷
-আমার আর কি মতামত ভাই৷ কিরে কিছু বল তুই?
বাবা বলল৷
রহমত চাচা থমথমে মুখ নিয়ে চেয়ে রইলেন৷ যেমনটা দুপুরে খাবার টেবিলে তাকিয়ে ছিলেন৷
পান চিবানো আপাতত বন্ধ রেখেছেন৷
“বিয়েতে রাজি নয় আমি”
আমার মতামত শুনে রহমত চাচা ভয়ার্ত চোখে বাবার দিকে তাকান৷ এই বুঝি হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাবে৷
-বাবা অপছন্দের কারণ জানতে পারি? আমার মেয়েতো দেখতে খারাপ না৷
ধরা গলায় বললেন রহমত চাচা৷
-না চাচা৷ আপনার মেয়ে যথেষ্ট রূপবতী আর মায়াবতী৷
-তাহলে সমস্যা কোথায় তোর?
বাবা বলে উঠলেন৷

‘বাবা তুমি যখন রহমত চাচার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে তখন বলেছিলে ‘তোর রহমত চাচা৷ ঐ যাদের বাসায় রঙিন টিভি ছিল৷”

আমি তোমাকে অতটুকুতেই থামিয়েছি৷
এবার পরেরটা আমি বলি৷ তোমরা শুনো৷

“রহমত চাচা৷ আমাদের সামনের বাসায় থাকতেন৷ যার ঘরে রঙিন টিভি ছিল৷

মায়ের হাত ধরে যখন রহমত চাচার রঙিন টিভিতে আলিফ লায়লা দেখতে যেতাম৷ তখন আমার মাকে খোটা শুনতে হতো৷

আমার মুখের দিকে চেয়ে মা সবকিছু সহ্য করে নিতেন৷
রহমত চাচার ফ্রিজটাতে যখন বোতল ভরা পানি নিয়ে যেতাম৷
সেই বোতলের জায়গা হতো না সেই ফ্রিজে৷
রহমত চাচার দু’তালা বিশিষ্ট দালানের ছাদে যখন মরিচ শুকোতে দিতো আমার মা৷
শুনতে হতো হাজার রকমের কথা৷
রহমত চাচার মেয়ের সাথে খেলতে গেলে আমাকে শুনতে হতো “ছোটলোকের বাচ্চা” নামক গালি৷
চাচা আমরা কি ছোটলোক ছিলাম?
টিভি, ফ্রিজ আর দু’তলা দালানের ছাদ না থাকলে মানুষ বুঝি ছোটলোক থাকে?
ছোটলোকের বাচ্চাটার হাতে নিজের আদরের মেয়ের জীবনটা তুলে দিচ্ছেন!
আপনার আত্মসম্মানবোধ নষ্ট হবে না৷
শুনলাম, আপনাদের বাসায় নাকি বর্তমানে একটামাত্র ফ্রিজ আছে৷
কিন্তু আমাদেরতো দু’দুটো ফ্রিজ আছে!
সেহেতু আমরা আপনার চেয়ে বড়লোক৷
আপনি ছোটলোক৷
আমাদের এই দালানটা ৫তলার৷
বড় করে একটা ছাদ আছে৷
আপনারটা দু’তলা দালান এখনো৷
সেদিক দিয়েও আমরা বড়লোক৷
আপনি ছোটলোক৷
শুনলাম, আপনার বাড়িতে নাকি সেকেলে রঙিন টিভি৷
কিন্তু খেয়াল করেছেন?
আমাদের দু’টো টিভি৷
দু’টো ওয়াল টিভি কিন্তু চওড়া দামের৷
সেদিক দিয়েও আপনি ছোটলোক৷
এবার চাচা আপনিই বলুন, “ছোটলোকের বাচ্চা” বলে গালি দেওয়া একটা ছোটলোকের মেয়েকে বিয়ে কিভাবে করি?
আপনার মেয়ের কোনো দোষ নেই৷
দোষ তার দু’মুখো ছোটলোক বাবার৷
চাচা শুনেন, ফ্রিজে রসমালাই রাখা আছে৷
দারুণ মজা৷
পেটভরে খাবেন৷

তারপর সামনে রাখা পান গালে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বাড়ির পথ ধরবেন৷ পারলে আমার মায়ের কবরস্থানের সামনে গিয়ে বলবেন, আমি আসলেই ছোটলোক৷

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত