কণ্যা

কণ্যা

অনামিকার ভিষন খারাপ লাগছে।ভালো লাগছে না কিছু।কোন কিছুতেই ওর মন বসে না।মন বসাতে পারে না ও।রাতে ঠিক মত ঘুম আসে না।ক’দিন থেকেই এমন হচ্ছে।ঠিক রাত দুই কি তিনটা বাজে ঘুম আসে।অদ্ভুত! এর আগেও ঘুম আসে না।আবার পরেও না। খাবার পরে একদম একা হয়ে যায় ও।কেউ থাকে না।সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। একদম নিরব।চারদিকে নিস্তব্ধতা নেমে আসে।ঘন আঁধার নেমে আসে।চারদিক অন্ধকারে কালোর আলোয় ছেয়ে যায়।রাত একটা বাজে।অনামিকার ঘরের লাইটটা বন্ধ।কালো ঘন অন্ধকারের মাঝে বারান্দায় বসে আছে ও।আশেপাশের কারো রুমের আলো জ্বলছে না।সবাই ঘভির ঘুমে আচ্ছন্ন। শান্ত! একেবারে নিরব!অনামিকা বসে আছে।একা একা! কিছু একটা নিয়ে ভাবছে।ভাবতেই ভীষন খারাপ লাগছে।অনামিকা কালো কষ্টে ভুগছে।বেশ ক’দিন ধরেই রোগটা ওর উপর চেপে গেছে।কষ্টে ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে।জ্বালা করছে ভীষন।না পারছে কিছু করতে। না পারছে কিছু বলতে।অনেকটাই রোবটে পরিনত হয়েছে ও।চিন্তাও হচ্ছে খুব।অনামিকা অন্ধকারের মাঝে নিজের হাতটা দেখার চেষ্টা করল।কিন্তু দেখতে পেল না।এত অন্ধকার যে নিজের হাতটাও দেখতে পারছে না ও।তবে পাশে রাখা সাদা চায়ের কাপটা আবছা আবছা দেখছে।ও চায়ের কাপটা হাতে নিল।চা শেষ! এইত বানিয়ে আনল চা।তাহলে এত তাড়াতাড়ি শেষ হল কি ভাবে? নাহ্! আর ভালো লাগছে না ওর।কিছুই ভালো লাগছে না।অনামিকা উঠে দাঁড়াল! রুমে গিয়ে লাইট জ্বালাল।কিছু সময় আয়নার সামনে বসে থাকল

আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল ও।চোখের নিচের দিকটা কিছুটা কালো হয়ে আছে।চোখ গুলো যেন গর্তে পড়ে আছে।অনামিকা নিজের চোখ দেখার চেষ্টা করল।কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে থাকল কেবল।হঠাৎ ই দেখল চোখ গুলো যেন ছলছল করছে।চোখের কোনায় বিন্দু বিন্দু পানি জমা হচ্ছে।লাইটের আলো পড়ে সেটা চিক চিক করছে। অনামিকা আর বসল না।লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল।এপাশ ওপাশ করল কিছুক্ষণ! কিছুতেই চোখের পাতা এক করতে পারছে না অনামিকা।চোখ বুঁজলেই মাহিনের নিষ্পাপ, বোকা বোকা চেহারাটা ভেসে উঠে।ঠোটের কোনে হাসি লেগে থাকা মাহিনের চেহারা ভেসে উঠে। আশ্চর্য! ছেলেটাকে কখনও কান্না করতে দেখে নি অনামিকা। ওর বিষন্ন চেহারাটাও দেখে নি অনামিকা। আচ্ছা! ও কান্না করলে ওর চেহারাটা কেমন হবে? আগের মত সুন্দর, স্মার্ট লাগবে তো।অনামিকা ভাবতে থাকে।ভাবতে ভাবতেও ঘুম চলে আসে না ওর।ঘুমিয়ে পড়ে না হুট করেই।অনামিকা কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না।অনামিকা বিছানা থেকে উঠে গেল।ঘড়িতে সময়টা দেখে নিল।দুইটা ত্রিশ বেজে গেছে।তবুও ঘুম আসছে না ওর।
.
অনামিকা আরেক কাপ চা বানিয়ে আনল।বারান্দায় বসে ভাবতে লাগল।মাহিনের কথা।আচ্ছা অনামিকা মাহিনকে নিয়ে এত ভাবে কেন? কেন মাহিনের জন্যে ওর ঘুম আসে না? অনামিকা প্রশ্ন গুলোর উত্তর খোঁজে! তন্ন তন্ন করে খোঁজে! নিরাশ হয় ও।কোথাও উত্তর খোঁজে পায় না ও।অনামিকার যে এমন ছন্নছাড়া অবস্থা হবে তা ও কখন ভাবতেও পারে নি।হুট করেই যেন সব কিছু পাল্টে গেল।অনামিকার পুরো পৃথিবীটাই পাল্টে গেল।সব উলটপালট হয়ে গেল।শুধু একটা ইচ্ছে পূরন করতে গিয়ে আজ অনামিকার এ অবস্থা।ওর জানা ছিল না যে এমন ইচ্ছে পূরন করতে গিয়ে ওকে এমন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।

অনামিকার ইচ্ছেটা খুব বড় ছিল না।সে মাহিনের গল্পের চরিত্র হতে চেয়েছিল কেবল।গল্পে মাহিনে প্রেয়সী হতে চেয়েছিল।একদিন অনামিকা খুব জোর করে।মাহিনকে জ্বালিয়ে তোলে।অনামিকার মাঝে তখন মাহিনের গল্পের নাইক হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা কাজ করছিল।মাহিন ওকে বোঝাতে চায়।কিন্তু অনামিকা কিছুতেই বুঝতে চায় না।যা বলছে তাই।হার মানে মাহিন।মাহিন মাঝে মাঝে গল্প লিখে ফেবুতে।অনামিকা সেগুলো পড়ত।এক সময় গল্পে অনামিকার নাম আসে।ভীষন খুশি হয় অনামিকা।খুশিতে সে রাতে মাহিনের সাথে দুই ঘন্টা কথা বলে।রাতে ঘুমতে পারে না খুশিতে।সেই যে রাতের ঘুম গেল।আর ঘুম এল না।সেদিনের পর থেকে অনামিকা ঠিক মত ঘুমাতে পারে নি।নিজেকে মাহিনের গল্পে কল্পনা করতে করতে কখন যে মাহিনের গল্পের প্রেমে পড়ে যায় সেটা বুঝে উঠতে পারে না।তারপর! একদিন হুট করেই মাহিন গল্পের নাইকার নামটা পরিবর্তন করে ফেলল।অনামিকার ভীষন রাগ হল।রাগ করেই মাহিনকে ব্লক করে দিল।ব্লক করেই আবার আনব্লক করল।রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়ল ও।ভার্সিটি গিয়ে মাহিনকে খুঁজতে শুরু করল।পেয়েও গেল।কিছুটা চিৎকার দিয়ে বলল,

:এই তোর সমস্যা কি?
মাহিন অনামিকার এমন কথা শুনে কিছুটা ভড়কে গেল।বলল,
:মানে! কিসের সমস্যা! কার সমস্যা!
:তোর সমস্যা। তোর!
:কেন! আমি আবার কি করলাম।
:কি করিস নি সেটা বল।তুই… তুই তোর গল্পে আমার নাম পরিবর্তন করলি কেন? বল করলি কেন?
:আজিব! আমার গল্প।আমি যারতার নাম দিব।তাতে তোর সমস্যা কি?
:আমার সমস্যা কি মানে? আমার অনেক সমস্যা! তোকে যা বলছি তাই করবি।তুই তোর গল্পে আমার নাম দিবি। ব্যস! আমি আর কিছু শুনতে চাই না।আর যদি না দিস তাহলে তোর অবস্থা কি হবে সেটা আমি নিজেও জানি না।

এই বলে অনামিকা হন হন করে ওর সামনে থেকে চলে গেল।মাহিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকল।ভাবল,
:আশ্চর্য ব্যাপার! আমার গল্পে আমি যারতার নাম দিব তাতে এই মেয়ের সমস্যা কি? এই মেয়েটার যে মাঝে মাঝে কি হয়ে যায় সেটা আমি নিজেও জানি না।
মাহিন ভাবতে ভাবতে সামনের দিকে এগুলো ।
অনামিকা উঠে দাঁড়াল।নিজের রুমে গেল।চায়ের কাপটা নিজের টেবিলের উপর রাখল।তারপর শুয়ে পড়ল।ওকে সকালের জন্যে প্রস্তুত হতে হবে।
সকালে মাহিনের সাথে অনেক কথা বলতে হবে।অনেক!
.
অনামিকা ভার্সিটি এসে মাহিনকে খুঁজতে লাগল।কিন্তু কোথাও খোঁজে পেল না।কিছুটা মন খারাপ হল ওর।খারাপ মন নিয়েই বাড়িতে ফিরল।

নাহ্! অনামিকা আর খুঁজে পায় নি মাহিনকে।মাহিনের সব গুলো বন্ধু কে ওর কথা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু কেউই কিছুই বলতে পারল না।অনামিকার ভীষন মন খারাপ হয়। ফেবুতেও পায় না।ফোনেও পায় না।আশ্চর্য! ছেলেটা যে এমন ভাবে গায়েব হয়ে যাবে সেটা কখন ভাবতেও পারে নি ও।দিন শেষে অনামিকা একরাশ অভিমান নিয়ে বাড়ি ফিরে।একঝাক খারাপ লাগাও ওর সঙ্গ দিতে চলে এল ওর সাথে ।কিছু কষ্টও।রাতে ঠিক মত খাবার খায় না অনামিকা।আবার ঘুমও আসে না।ঘুম না আসলে খাবার খাওয়ার ইচ্ছেও হয় না।খাওয়ার ইচ্ছেটাও মরে যায়।অনামিকার বুঝতে পারল কেন ওর এমন হচ্ছে।কেন বার বার মাহিনকে মনে পড়ছে।সব কিছু পরিষ্কার হলে লাগল।কিন্তু অনামিকা যে ভীষন দেরি করে ফেলেছে।
.
অনামিকা ঘরের লাইট বন্ধ করে বসে থাকে।কেন জানি এই আলোটাকেও অসহ্য লাগছে অনামিকার। চুপচাপ! অন্ধকারে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে।ক’ফোটা জল গাল বেয়ে পড়ে।নিজের বালিশটা ভিজে যায়।কিছু কষ্টে ভিজে যায় বালিশটা।
.
অনামিকার অবস্থা অনেকটাই খারাপ হয়ে যায়।কেমন জানি মনমরা হয়ে যায়।চুপসে যায়।কারো সাথে ঠিক মত কথাও বলে না।অন্ধকারে বসে থাকে।বাইরের আলো দেখে না অনেক দিন হয়েছে।ঠিক এমন সময় একটা চিঠি পায়।নামহিন চিঠি।অনামিকা ভেজা চোখ নিয়ে চিঠিটা খোলে।

“অনু,
আমি জানি তুই এখন ভালো নেই।তোর অবস্থা কেমন সেটা আমি আমার দিক থেকেই বিবেচনা করতে পারছি।আমিও যে খুব একটা ভালো নেই।সব যেন পাল্টে যায় আমার। গল্প লেখা হয় না আর।যেদিন থেকে তোর নামটা গল্প থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছি সেদিন থেকেই গল্প আমার থেকে আড়ি নেয়।গল্পও আমাকে ছেড়ে চলে যায়।সব ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।গল্প না লিখতে পেরে অনেকটাই পাগল হয়ে যাই আমি।

তুই তো জানিস গল্প আমার নেশা।কেমন গল্প পাগল আমি সেটা তুই ভালো করেই জানিস।একটু ভেবে দেখ।একজন নেশা খোর যদি একদিন নেশা না করতে পারে তাহলে তার কি করুন অবস্থা হয়। নেশার জ্বালায় পাগল হয়ে যায়।পাগলের মত এদিক সেদিক দৌড়ে বেড়ায়।আমারো একই অবস্থা রে।আমিও অনেকটাই পাগল হয়ে যায়।গল্পের নেশায়। তুই কেন করলি এটা। বল কেন করলি? কেন আমার গল্পের চরিত্র হতে চাইলি।গল্প থেকে একেবারে আমার ভিতরেই ঢুকে গেলি।কেন? কেন তুই আমাকে এমন ভাবে তোর মায়ায় ফাঁসিয়ে দিলি।কেন? আমি ভালো নেইরে।একদম ভালো নেই।তোর অপুর্নতা আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়।আমাকে প্রতিদিন মারে।ভাবছিস কেন আমি তোর সামনে আসছি না!

কেন তোর সামনে এসে কথা বলছি না।আমার যে সেই অবস্থা নেই।আমাকে দেখলে তুই চিনতে পারবি না।আমি আগের মাহিন নেই রে।এক দূর্ঘটনায় আমি আমার চেহারার উজ্জ্বলতা হারাই।আমি আর আগের মত স্মার্ট নই রে।আজ আমার মুখ কালো।ক্ষত বিক্ষত।অনেকটাই পুড়ে গেছে।আগুন লেগে পুড়ে গেছে।বিশ্বাস কর মুখ পুড়ে যাওয়াতে আমি এতটা কষ্ট পাই নি যতটা কষ্ট পেয়েছি এই কথা ভেবে যে তোকে আর দেখতে পাব না।প্রান খুলে কথা বলতে পারব না।আমি কখনই চাই না আমার এই পোড়া মুখ তোকে দেখাতে।এই পোড়া মুখ নিয়ে তোর সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও আমার নেই।আমায় ক্ষমা করে দিস।অনেক গুলো রঙিন স্বপ্ন ছিল তোকে নিয়ে।কপাল আমার।সেগুলো স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।আর বাস্তবাইত হল না।যখন কথা গুলো ভাবি ভীষন কষ্ট হয় আমার।মরে যেতে ইচ্ছে হয়।কি কপাল! মরতেও পারি না।এত গুলো কষ্টের ভার নিয়ে সামনে এগিয়ে চলতে হবে ভাবতেই আমার ভিষন ভয় করে।জানিস আমি এখন চারদেয়ালে আবদ্ধ হয়ে থাকি।বাইরে বের হই না।ভীষন ভয় করে।সবাই কেমন করে যেন তাকায়।অনেকে হাসে।ঠাট্টাতামাসা করে।কেউ আড় চোখে তাকায়।জানিস তখন ভীষন খারাপ লাগে আমার।কান্না পায়।অনেকে কেঁদেছি।কেউ দেখেনি।একটু শব্দও হয় নি।এখন চোখ দিয়ে পানিও বের হয় না।কেবল লাল হয়ে থাকে।সত্যিই আমার জীবনের মোড়টা অনেকটাই পাল্টে যায়।তবুও কোথাও না কোথাও তোর অপূর্নটা অনুভব করি।ভীষন মিস করি তোকে।তুই আমার মনে আমার “অনু ” হয়েই থেকে যাবি।বাস্তবে আমার হবি না।থাক!না হওয়াই ভালো।সব ভালোবাসা তো আর পূর্নতা পায় না

ভাবছিস, আমি কিসের উপর ভিত্তি করে কথা গুলো বলছি! আমি নিজেও জানি না আমি তোকে কেন কথা গুলো বলছি।কিসের ভিত্তিতে করছি।কেবল কেন জানি মনে হচ্ছে তুইও আমাকে মিস করছিস! ভীষন মিস করছিস। অনেকগুলো কথা তোকে বলার ছিল।চিঠি লিখার আগে কথা গুলো গুছিয়েও নিয়েছিলাম। কিন্তু লিখার সময় সব গুলোই অগোছালো হয়ে গেল।ঠিক মত গুছিয়ে বলতে পারলাম না।ও একটা কথা তো বলাই হল না।যা বলার জন্যে আমি অস্থির ছিলাম।জানি না তুই কি ভাববি বা কেমন ভাববি।হয়ত খারাপ ভাববি।সে নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই।কথাটা আমাকে বলতেই হবে।”আমি তোকে ভালোবাসি অনু।”না হয় নি।আমি তোমাকে ভালোবাসি অনু।ভালো থাকিস।পারলে ক্ষমা করে দিস।

মাহিন।”

চিঠিটা পড়ে কান্না ভেঙে পড়ল অনামিকা।চিৎকার দিয়ে কান্না করার চেষ্টা করল।কিন্তু ওর গলা দিয়ে একটা শব্দও হল না।চোখ দিয়ে একটু পানিও বের হল না।নিজের কষ্টটুকুও ঝেড়ে ফেলতে পারছে না।এর থেকে কষ্টের ব্যাপার আর কি আছে।যে নিজের কষ্ট টুকু ঝেড়ে ফেলতে পারে না।অনামিকার ভীষন কষ্ট হচ্ছে।সহ্য করতে পারছে না ও।ভিতরটা যেন জ্বলে যাচ্ছে।তীব্র চিৎকারে আসল অনামিকার ঘর থেকে।ওর বাবা মা দৌড়ে ওর রুমের দিকে গেল।দেখল ওর অনামিকা ফ্লোরের উপর পড়ে আছে।তারা দৌড়ে ওর কাছে গেলেন।
.
অনামিকা আর রুপা একটা বেঞ্চে বসে আছে।দুজনেই চুপচাপ। কেউ কথা বলছে না।মনেহয় এই নিস্তব্ধতা দুজনেই পছন্দ করে।সেদিন অনামিকা অজ্ঞান হয়ে যায়।দূর্বলতার কারনে অজ্ঞান হয়ে যায় ও।ডাক্তার বলেছে ওকে টেনশনে ফ্রি থাকতে।যত টেনশন ফ্রি থাকবে ও ততই ভালো হতে থাকবে।তাই ওর বন্ধু রুপা ওকে এখানে নিয়ে এসেছে।খোলা বাতাসে মনোরম পরিবেশ এখানে নিশ্চই খারাপ লাগবে না ওর।

:একটা কথা বলব?
নিরাবতা ভেঙ্গে রুপা কথাটা বলল।অনামিকা কিছু বলল না।একরোখা হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল।রুপা আবার বলল,
:তুই প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিস।
অনামিকা আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল না।অবাক হয়ে রুপার দিকে তাকাল।
রুপা আবার বলল,
:মাহিনের প্রতি আমি আগ থেকেই দূর্বল ছিলাম। তারপর ওর গল্পে যখন নিজের নাম দেখলাম তখন যেন আমার ভালো লাগা আরো কয়েক গুন বেড়ে গেল।কিন্তু হঠাৎ করেই ওর গল্প থেকে রুপা মুছে যায়।এটা আমি কোন মতেই মেনে নিতে পারি নি।একদিন ওকে অনেক রিকুয়েস্ট করে গল্পে আবার নিজের নামটা বসালাম।সেদিন কত বাহানাই না করতে হল।ও আমার নাম দিতেই চায় নি।জানিস কেন? তোর জন্যে।কেবল তোর জন্যে আমার নাম দিতে চায় নি।পরে জোরাজোরিতে দিল।কিন্তু তুই এটা কিছুতেই মেনে নিস নি।তুই আমার নাম মুছে তোর নাম আবার বসালি।এর মাঝে আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি যে আমার নাম দিয়ে যে গল্প গুলো লেখত সেগুলো তোর নাম দিয়ে লেখা গল্প গুলো হতে ভালো হত না।গল্পে যেন তোর নামটা মানাত।তোর নামের সাথে খাপখেত।কিন্তু এটা আমি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারি নি।খুব হিংসে হত।কিছু করতেও পারতাম না।তোকেও কষ্ট দিতে চাইতাম না।তোর সাথে আমার যে বন্ধন সেটা আমি কোন ভাবেই ভাঙতে চাই নি।কিন্তু তোর উপর আমার হিংসেটা চড়ে বসে।আমি কষ্ট পাব আর তুই সুখে থাকবি সেটা কখনই হতে পারে না।তাই সুযোগ পেয়েই সেদিন একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটিয়ে ফেলি।সেদিন আমি শপিং করতে যাই।যেতেই মাহিনকে দেখলাম সেখানে।কি জানি কিনছে।ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটে। ওখানে আগুন লেগে যায়।আমরা অনেকেই বেরিয়ে যাই।মাহিনও বেরিয়ে গিয়েছিল।কয়েকজন ভিতরে থাকায় তাদের বাঁচাতে ও ভিতরে যায়।তিনজন লোক ছিল।তাদের অক্ষত অবস্থায় নিয়ে আসে ও।তখনও আগুনো পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়ে নি।আমি দৌড়ে ওর কাছে যাই।ভিষন কান্না করি।চোখের কাজল গুলো লেপ্টে যায়।ওর কাছে গিয়ে বলি আমার ছোট ভাই ভিতরে।প্লিজ ওকে বাঁচিয়ে আন।প্লিজ মাহিন।প্লিজ।

ও দৌড়ে যায়।আমার ভাইকে বাঁচাতে।যেখানে আমার কোন ভাইই নেই।বিশ্বাস কর আমি ঠিক তখনই জানি না আমি করছি।কেন কারছি।কিন্তু যখন বুঝতে পারি তখন অনেক দেরি হয়ে যায় আমার।আমার জন্যেই মাহিনের এ অবস্থা।সব দোষ আমার।এই মুখ নিয়ে আমি আর ওর সামনে দাঁড়াতে পারি নি।

এই বলে রুপা কান্না শুরু করে।কান্নায় ভেঙে পড়ে।অনামিকা ওর দিকে এখনও তাকিয়ে আছে চোখ বড় বড় করে।চোখ গুলো লাল হয়ে আছে ভীষন। চোখের কোন দিয়ে পানি ঝরতে লাগল।ভিষন রাগ হতে থাকল ওর।কষিয়ে একটা চড় দিল রুপা কে।রুপা কিছু বলল না।নিচের দিকে তাকিয়ে থাকল কেবল।শুধু কান্না করছে।এরপরই হুট করেই রুপা অনামিকার পাঁ চেপে ধরল।ক্ষমা চাইল।অনামিকা কিছু বলল না।কিছু বলতে পারছে না ও।কান্না করে যাচ্ছে ও।তীব্র জ্বালা করছে ভিতরটা। এতটা নিষ্ঠুর মানুষ হয় কিভাবে। রুপা উঠে দাঁড়াল।বলল,
এই সরু রাস্তা ধরে একটু হেঁটে বাঁয়ে যাবি।সেখানে দেখতে পাবি একটা বেঞ্চ।আর একটা ছেলে।ময়লাটে চাদুর গায়ে দিয়ে বসে আছে।তোর পৃথিবী সেখানে।তাকে বলিস সেও যেন আমায় ক্ষমা করে দেয়।

রুপা দৌড়ে চলে গেল।কান্না করতে করতে চলে যায়।অনামিকা উঠে দাঁড়ায়।হাঁটতে থাকে।কিছুদুর যেতেই খুব পরিচিত একটা গন্ধ পায়।অনামিকা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়।ভেতরটা কেন জানি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে।মন বলছে খুব ভালো কিছু হবে।অনামিকা সেখানে গেল।দেখল একটা ছেলে বসে আছে।গায়ে একটা ময়লাটে চাদুর।মুখের একপাশের অনেক খানি পুড়ে গেছে।তাকিয়ে আছে সামনের পুকুরটার দিকে।চেনা গন্ধটা এখান থেকেই আসছে।মাহিনকে দেখা মাত্রই অনামিকার চোখ ছলছল করে উঠল।অনামিকা আর দাঁড়াল না।দৌড়ে গেল।গিয়েই মাহিনের সামনে দাঁড়াল। অনামিকাকে দেখেই মাহিন কিছুটা আশ্চর্য হল।অনামিকাকে এখানে আশা করেই ও।রুপা কি বলবে বলে এখানে ডেকে ছিল।খুব করে অনুরুধ করেছে।তাই ফেলতে পারে নি।কিন্তু এখানে এসে যে অনামিকাকে দেখবে সেটা ও কোন ভাবেই আশা করে নি।মাহিন উঠে দাঁড়াল। অনামিকা ছলছল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।মাহিন অনামিকার চোখের দিকে তাকাল একটু। মেয়েটা আগের থেকে কালো হয়ে গেছে।

চোখ গুলো যেন গর্তে চলে গেছে।কিন্তু এত বিষন্নতার মাঝেও মেয়েটার মুখে বেশ মায়া খেলা করছে।মাহিন আর সেদিকে তাকাল না।পিছন ফিরে চলে আসতে চাইল।কিন্তু তার আগেই অনামিকা ওর হাত ধরে ফেলেছে।এক টানে একেবারে ওর কাছে নিয়ে এসেছে।অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল মহির দিকে।হাত উঠাল ওকে মারতে কিন্তু মারল না।হাত নামিয়ে মহির মুখের উপর রাখল।ক্ষত জায়গা গুলোর উপর হাত বুলিয়ে দিল।অনামিকার স্পর্শ পেতেই মাহিন চোখ বুঁজে ফেলল।ক’ফোটা জল গাল বেয়ে পড়ল।অনামিকা আলত করে পানি গুলো মুছে ফেলল।তারপর হুট করেই ওকে জড়িয়ে ধরল।জড়িয়ে ধরেই শব্দ করে কান্না শুরু করে দিল।একজন মা যেমন হারিয়ে যাওয়া শিশুকে ফিরে পেয়ে অজোর ধারায় কান্না করে অনামিকা ঠিক তেমনি মাহিনকে জড়িয়ে ধরল।মাহিনও নিজেকে আঁটকে রাখতে পারল না।হু হু করে কেঁদে দিল।কান্না কান্না করতে করতে অনামিকা বলল,
:কেন করলি এমন।কেন? কেন এত কষ্ট দিলি।আমার কাছে একবার আসতি।তোর জন্যে অনিহা নয় এক ঝাক ভালোবাসা রয়েছে।এতটা কষ্ট না দিলেও পারতি।

মাহিন ওকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল।কিন্তু পারল না।বরং অনামিকা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মাহিন বলল,
:অনু তুই ভুল করছিস। প্লিজ তুই চলে যা।তোর একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যত…
অনামিকা ওকে ছেড়ে দিল।বলল,
:চুপ! একদম চুপ! অনেক কষ্ট দিয়েছিস। আর না।এবার এমন ব্যাবস্থা করব যে তুইও কষ্ট পাবি না আর আমিও কষ্ট পাব না।তোকে আটকিয়ে রাখব।চল!

এই বলে মৃদু হাসল অনামিকা। কেউ দেখলে বলতে পারবে না যে এই মেয়ে এতক্ষনে কান্না করেছে।আকাশটা কালো ঘন মেঘে ঢাকা ছিল।অনেকদিন সূর্য উঠে না।তারপর হুট করেই মেঘ কেটে গেল।বাতাসে সব মেঘ উড়িয়ে নিয়ে গেল।অতঃপর সূর্য দেখা গেল।সূর্যের হাসি দেখা গেল।খেটে খাওয়া মানুষ গুলো ভিষন খুশি হল।অনামিকার মুখের অবস্থা ঠিক এমনই হল।বিষন্ন কালো ছায়ায় ঢেকে থাকা মুখটা হুট করে উজ্জ্বল হয়ে গেল।আলোর রেখ দেখা দিল।খুশির রেখাও।মাহিন অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।বলে কি মেয়েটা।না এটা কোন ভাবেই সম্ভব না।মাহিন কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই অনামিকা বলে উঠল,

:চল! জলদি চল।
মাহিন আরেকটু অবাক হল।বলল,
:কোথায়!
:তোর না অনেক গুলো স্বপ্ন ছিল।চল সেগুলো বাস্তবায়ন করবি।দুজনে মিলে স্বপ্ন গুলো চালাব।চল! চল!
:আরে কোথা যাব বল?
:কোথায় আবার।কাজি অফিসে।
:তুই ঠিক…

মাহিন আর কিছু বলল না।না তা নয়।ঠিক বলতে পারল না।অনামিকা ওকে বলতে দিল না।একটা ভালোবাসার পরশ বসাল মাহিনের ঠোটে।মাহিন কিছুটা কেঁপে উঠল।শরিরটা শিহরিত হল।এমন ঠান্ডা অনুভুতি আগে কখনও হয় নি ওর।চুমুর ধাক্কাটা ঠিক সামলে উঠতে পারল না ও।
অনামিকা ওকে ছেড়ে বলল,

:এবার যাবি চল।যদি এবারেও না করিস তাহলে তোকে খুন করব।
মাহিন কিছুটা ভয় পেল।মেয়েটা ভয়ংকর রাগি।কোন সময় আবার কি করে বসে।তাই আর দাঁড়াল না।দুজনে একসাথে হাঁটতে থাকল।নতুন স্বপ্ন দেখতে।স্বপ্ন গুলো সাজাতে।

মানুষকে খুন করলেই কেবল মানুষ মারা যায় না।একটা ভুলের অনুশোচনা একজন মানুষকে দৈনিক মারে।তাকে কুড়ে কুড়ে খায়।যখনই ভাবে কাজটা একদম ঠিক হয়। এই কাজটা করা একদম ঠিক হয় নি।এটা ভেবেই সে কাঁদে। দৈনিক কাঁদে। কষ্ট হয় ভীষন। অনুশোচনার কষ্ট। রুপাও সেই অনুশোচনার আগুনো জ্বলছে।বারবার মনে হচ্ছে কাজটা করা একদমই ঠিক হয় নি।রুপা কাঁদে।সবার আড়াল হয়ে।নিরবে মুখ গুঁজে কাঁদে।কেউ দেখে না।কেউ রুপার কষ্টে ভাগ বসায় না।রুপা সেটা চায়ও না।এটা ওর প্রাপ্য।এই কষ্ট ওকে সারা জিবন বয়ে নিতে হবে।ও বিয়ে করতে চায় নি।বিয়ে করার ইচ্ছেও নেই।ফেমিলির জোরাজোরিতে বিয়ে করে।তবুও একটা ভুল, একটা অনুশোচনা ওকে বার বার মারে।কষ্টে জিবন পার করে ও।মাহিন ও অনামিকা ও যেন ভালো থাকে সেই দোয়াই করে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত