রক্ত

রক্ত

গাল ধরে ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে দাড়িয়ে আছেন মিনার তালুকদার। এমন সময় রুমে সাদিয়া উপস্থিত হলো। সাদিয়াকে দেখে তিনি যেনো তার মুখ লুকাতে চাচ্ছেন। সাদিয়া ভ্রুকুঞ্চন করে মিনার তালুকদারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লুকিয়ে রাখা মুখটিতে উদ্দেশ্য করছে। সাদিয়া তালুকদার সাহেবের সামনে গিয়ে দাড়ালো। তারপর বললো,
— বাবা কি হয়েছে?
— কিছু না রে মা।
— তাহলে তুমি গাল চেপে ধরে আছো কেনো?
— আসলে–ইয়ে–মানে…
সাদিয়া সাইড টেবিলে একবার তাকিয়ে বললো,
— শেভ করতে গিয়ে আবার কেটে ফেলেছো।
— হুউউ্
— একি বাবা, রক্ত!
বলেই সাদিয়া জ্ঞান হারিয়ে লটিয়ে পরলো। তালুকদার সাহেব গাল ছেড়ে মেয়েকে ধরলেন। তাড়াতাড়ি স্ত্রী-কে ডাক দিলেন– আফসানা! আফসানা!
আফসানা বেগম দৌড়ে এসে মেয়ের এমতাবস্থা দেখে হৈচৈ বাধিয়ো দিলো। তালুকদার সাহেবের মেজাজও এবার চড়ে বসেছে। “তুমি কি মা! নাকি পিশাচি। মেয়েকে ধরে আগে বিছানায় শোয়াবে তা না করে আন্দোলন করা শুরু করেছো। এদিকে আমার গাল বেয়ে যেভাবে রক্ত ঝরছে– মনে হয় প্রায় ২০০ গ্রাম রক্ত বের হয়ে পরেছে।”—- বললেন মিনার তালুকদার।
আফসানা বেগম বললো, “তা ধরবো কেনো? তুমি জানোনা এই মেয়ে রক্ত দেখতে পারেনা। তাহলে কেনো তোমার রক্ত দর্শন করালে আমার মেয়েটাকে।”
মিনার তালুকদার বললো, ঝগড়া পরে করে যাবে। দুজনে মিলে সময় বের করে ঝগড়া করবো। এখন ধরো।”
তারপর সাদিয়াকে ধরাধরি করে রোগা শরীরটাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। মিনার রহমান বললো, “চোখে পানি ছিটাও।”
আফসানা বেগম বললো, “ছিটাবো। আগে শেভ শেষ করে এসে তোমার গালের রক্তচাপা দাও। নয়তো মেয়ে আবার অজ্ঞান হবে। এতো বেশি অজ্ঞান হলে ওঁর ব্রেইনে সমস্যা হয়ে যাবে। কালই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। সমস্যাটার সমাধান এখনো হচ্ছে না। কি হলো, তুমি যাও।”

তারপর মিনার তালুকদার শেভ শেষ করে, সেভলন সহ ক্রিম লাগিয়ে গালটাকে চকচকে করে এসে মেয়েকে দেখলেন সজ্ঞান অবস্থায়।
মিনার তালুকদার মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললো, “এ কি রোগ নিয়ে জন্মালিরে মা। সবে তুই ষোড়ষী। এমন হলে তোকে বিয়েও দিতে পারবো না।”
সাদিয়া বললো, “বাবা! আমি বিয়ে করবো না। আমি বড় ডাক্তার হবো। সাইন্সে পড়ছি কি এমনি এমনি।”
তালুকদার সাহেব নিরস মুখে বললেন, “ডাক্তার হবে সে কি করে মা? তুইতো রক্ত দেখলেই জ্ঞান হারাস”
সাদিয়া সহর্ষে বললো, “বাবা! ওঁ কিছু না। রক্ত দেখলে আমি ভয় পাই। ডাক্তার হলে আর ভয় থাকবেনা। তখন আর জ্ঞান হারাবো না।”
তালুকদার সাহেব মেয়ের মাথায়, গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “না মা, তোর এটার চিকিৎসা লাগবে রে। যাইহোক, তুই আর তোর আম্মু বিকেলে তৈরি থাকিস আমার আজ বের হবো।”

মিনার তালুকদারের মন সারাক্ষণ আজ মেয়েটিকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করলো। মেয়েটির এ কেমন ব্যাধি ধরলো। মেয়েটির সব কিছু স্বাভাবিক শুধু এই বিষয়টির জন্য মেয়েটিকে মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক মনে হয়। সেই ছোট বেলায় তিন-চার বছর থাকা অবস্থায় একদিন আফসানার আঙ্গুল সবজি কাটতে গিয়ে সামান্য কেটে যায়, রক্তক্ষরণ হয়। তারপর সাদিয়া এই অবস্থা দেখে বমি করতে করতে অজ্ঞান হওয়া অবস্থা। তারপর থেকে যতবারই সে রক্ত দেখেছে এমনি অবস্থা করছে। মাঝে মাঝে তার জ্ঞান ফিরতে সময় লাগতো। মেয়েকে জিজ্ঞাস করলেই বলতো, “রক্ত আমি ভীষণ ভয় পাই।” তাকে অনেক বোঝানো হয়েছে রক্ত দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তারপরও তার আশঙ্কা পাল্টেনি। একবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নার্স এসে যখন তার হাতে স্যালাইনের সুই ঢুকাতে গেলো তখন সে এক চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। লক্ষণগুলো মোটেই ভালো নয়।

মিনার তালুকদার অ্যানালগ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন বেরোবার সময় ঘনিয়েছে। তিনি তার স্ত্রী এবং মেয়েকে ডাক দিয়ে বললেন, “কোথায়? আমদের বের হওয়ার সময় হয়েছে। তোমার রেডি হয়েছো?”
সাদিয়া বললো, “বাবা তুমি আম্মুকে নিয়ে ঘুরে আসো। আমি যাবো না। আমার শরীর ভালো না- মাথা ব্যথা করছে।”
তালুকদার সাহেব বললো, “থাক, তাহলে আর বেরিয়ে কাজ নেই।”
সাদিয়া বললো,” বাবা প্লিজ আম্মুকে নিয়ে যাও নয়তো আমি কিন্তু…”
সাদিয়ার কথা থামিয়ে তালুকদার সাহেব বললো, “আচ্ছা যাবো কিন্তু তুমি একা বাসায় থাকবে কি করে? ভয় পাবে না?”
সাদিয়া বললো, “কাজের মেয়েতো আছেই। তাছাড়া রহিমা বুয়াতো আছেই।”
তারপর মিনার তালুকদার আর আফসানা বেগম কাজের মেয়ে দুটোকে সাদিয়াকে দেখতে বলে বেরিয়ে গেলেন।

মিনার তালুকদারের নতুন গাড়ী। ছয়মাস হলো কিনেছে। প্রতি শুক্রবারই বউ-বাচ্চ’কে নিয়ে তিনি ঘুরতে বের হয় অথচ আজ সাদিয়া নেই। তারা গাড়ীতে বসে দুজনই বিষণ্ন হয়ে অন্যমনস্ক বসে রইলেন। আফসানা বেগম বললেন, “আচ্ছা তোমার কি মনে হয় না মেয়েকে বাহিরে নিয়ে চিকিৎসা করা উচিৎ। ”
মিনার তালুকদার বললো, ” ঠিক বলেছো। কিন্তু দেশে আরো কয়দিন দেখা যাক। এটাতো তেমন কোন রোগও না। এর থেকে জটিল রোগের সমাধান দেশের ডাক্তাররা আরো কতো করেছে।”
আফসানা বেগম বললেন, “তাহলে কাল কি মেয়েকে আবার নিয়ে যাবো?”
মিনার রহমান বললো, হুঁ অবশ্যই। আমাদের মেয়েকে সুস্থ হতে হবে। তাকে আমরা স্বাভাবিক দেখতে চাই। এই সমান্য কারণে তাকে মাঝে মাঝে অস্বাভাবিকই মনে হয়। ”
তারা আজ গাড়ী করে ঘুরে বেরিয়ে মোটেই আনন্দিত হতে পারলো না। দুজনের মনেই একটা চিন্তা এসে ভর করছিলো। চিন্তাটা তাদের সাদিয়াকে ঘিরে। বাসায় এসে দরজায় কলিংবেল চেপে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে হলো। হয়তো কাজের বুয়াগুলো কোন কাজেই ব্যস্ত আছে। অবশেষে দেড় মিনিট পরে রহিমা দরজা খুললো। আফসানা বললো, এতো দেরি হলো কেনো?
রহিমা বললো, খালা কাম করতাসিলাম।

তারপর দুজনে তাদের রুমে ঢুকার সময় সাদিয়ার রুমে নজর দিয়ে দেখে নিলো সে কি করছে। তাকে নিয়েই আজ তাদের দুশ্চিন্তার কারণ, সেক্ষেত্রে সে কখন কি করছে দেখা দরকার। মিনার তালুকদার দরজার পর্দা সামান্য সরিয়ে যা দেখলেন সেটা তিনি কখন কল্পনায় পর্যন্ত ভাবতে পারলো না। তার চোখ যেন স্বপ্ন দেখছে। না স্বপ্ন নয় স্বপ্ন সাদাকালো এখানে তিনি টকটকে লাল দেখতে পারছেন। আফসানা বেগমকে নিরবে হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকলেন দেখার জন্য। আফসানা বেগমেরও চোখ যেনো কপালে উঠার আশঙ্কা হয়ে গেলো। একি! তাদের সাদিয়া যে রক্ত ভয় পায়। যে রক্ত দেখলে অজ্ঞান হয়ে যায়, সে রক্ত। হাত কেটে সে রক্ত দুই হাতের তালুতে নিয়ে ঘষাঘষি করছে। এটা কি অলীক কল্পনা! না, এটা বাস্তব। তারা দুজনই হতচকিত হয়ে সে দৃশ্য দরজার পর্দার আড়াল থেকে নিরব দর্শকের মতো দেখছে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত