মুসিবত

মুসিবত

অন লাইনে রেজাল্ট টা দেখার পর থেকে মাথায় ঝিম ধরেছে। আজকে বাসায় গেলে আমার উপর হয়ত ধুমকেতু চলবে। এই ৬ষ্ট সেমিষ্টারে ২ বিষয়ে ফেল আসছে। কিন্তু পরীক্ষা তো মোটামোটি খারাপ হয় নি। তাহলে ফেল করলাম কেন? যাক গে, হয়ত আমার হাতের লেখার শিল্পকলা স্যারেরা বুঝে নি।
কলেজের বকুল তলায় বসে বসে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড গুলোর রেজাল্টও দেখছি। বাহ, আমি একা নই বরং সব গুলোই ২টা বা ৩টায় গেছে। এক এক করে আমার পাশে এসে আমার বন্ধুরা বসতে লাগলো। আপাতত আমরা ৪ বন্ধু এক সাথে হয়েছি। হঠাৎ রিজু বলে উঠলো….
— যাক ড্রপ আউট তো আর হই নি তাই মুখ গুলো বাংলার পাচেঁর মত না করে চল সিঙ্গারা খেয়ে আসি।
রিজুর কথা শুনে আমরা সবাই ওর দিকে তাকালাম। কারন সব গুলোর মনই মোটামোটি খারাপ। তখন রিজু আমাদের রাগি চেহারা গুলো দেখে ভয় পেয়ে বলল….
— না মানে সিঙ্গারার ট্রিট টা আমি না হয় দিলাম। মনে কর, সবাই ফেল করার খুশিতে।
প্রথমে অফারটা খারাপ লাগলেও পড়ে মেনে নিলাম। কারন বাসায় গেলে বাবার বকা আর এক বেলার খাবার বন্ধ নিশ্চিত। তার চেয়ে ভাল এখান থেকেই পেট পূজা করে যাই।

বাসায় এসে দেখি বাবা সোফায় বসে আছে। কিন্তু দুপুরে তো বাবার বাসায় থাকার কথা না। আমি চুপচাপ আমার রুমে যেতে যাবো তখনই বাবার ডাক। ব্যাগটা কাধেঁ নিয়েই সামনে গেলাম।
— কিরে মুখ এমন হয়ে আছে কেন? টাকা লাগবে নাকি?
— না বাবা কিন্তু তুমি এইসময় বাসায়।
— আরে আমার এক কলিগের বাসায় আজ দাওয়াতে যাবো বলে বাসায় চলে আসলাম। ওনার ছেলে এবার মেডিকেলে চান্স পাইছে।
— ও আচ্ছা
— কি হলো কয় বিষয়ে ফেল করেছিস?
আমি একটা শকড খেয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছি। কারন,ওনি জানলো কি করে?ওনি আমায় বলল…
— কিরে বলবি নাকি চুপ করেই থাকবি?
— দুইটায়।
কিছুক্ষণ নিরবতা চলল আমাদের মাঝে। তারপর বাবা জোরে মাকে বলল…
— রাজের মা আজকে দুইবেলা তোমার গুনধর পোলার খাওয়া বন্ধ। মনে থাকে যেন। আর যদি দেখি তুমি ওরে খেতে দিছো তাহলো তোমার খাওয়াও বন্ধ। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করবো আর প্রতিবার ফেল আর ফেল শোনার জন্য।

আরো কথা শোনাতে শোনাতে বাবা রুমে চলে গেলেন আর মা আমার শিশু সুলভ নিরীহ বকা খাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমিও চুপ করে রুমে চলে গেলাম।

রাত প্রায় ২টা বাজতে চললো।বাসার সবাই ঘুমিয়ে আছে আর আমার পেটের ভিতর খুদায় ডং মারছে। ও মা গো খুদার কষ্ট এত কেন? আমার মত বাচ্চারে কেউ এত কষ্ট দেয় নাকি। ঘুম তো আসছেই না বরং কান্না আসতাছে। হঠাৎ রুমে কেউ আসার আওয়াজ পাচ্ছি। ভূত নয়ত, আমি আবার ভূত বিশ্বাস করি না তবে সেটা শুধু দিনের বেলা। আর রাতে তো মাঝে মাঝে বাথরুমেও যাই না। ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি বাবা খাবার হাতে দাড়িয়ে আছে। আমি লাইট টা জ্বালিয়ে দিলাম। বাবা তো তাই অন্ধকারেই বুঝেছি এটা বাবা।আমি কিছুটা অবাক হলেও চুপ করে থাকলাম। বাবা আমার পাশে বসে আমায় খাইয়ে দিতে লাগলো আর আমি চুপচাপ খেতে লাগলাম। এই না হলে আমার বাবা। আমার মনে হচ্ছে, খুদায় আমি যতটা কষ্ট পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে বাবা। আমাকে নিজের হাতে খাওয়াই দিয়ে চলে গেল। আমি নির্বাক ছিলাম কিছুক্ষণের জন্য।

সকালে ঘুমটা ভাঙ্গলো রিজুর ফোনে। প্রথম বার ফোন কেটে দিলেও বার বার ফোন দিতে লাগলো তাই বাধ্য হয়ে ফোন ধরলাম।

— হুমম রিজু বল।
— তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস আর এদিকে তন্নি তো তোরে সারা কলেজ খুজেঁ বেড়াচ্ছে।
— কেন?
— সেটা কি আমরা জানি না। তুমি তো তলে তলে টেম্পু চালাও আর আমরা বললেই হরতাল তাই না।
— কি বাজে বকছিস?
— সত্যি বলি তো তাই গায়ে লাগে।
— ওকে তুই থাক আমি ৩০ মিনিটের মাঝে আসতাছি।
–আচ্ছা

তন্নি হলো ফুড ডিপার্টমেন্টের ব্রিলিয়েন্টের নাতি পুতি সব। আসলে কিছু কিছু মানুষ আছে না অতিরিক্ত ট্যালেন্টের হয়, তার একটা উদাহরন হলো তন্নি। কিন্তু তন্নি আমাকে খুজচ্ছে কেন?

প্রায় ৪৫ মিনিট পর কলেজে গেলাম। অবশ্য ক্লাস আছে তবে বই আনি নি। প্রথমেই ফুড ডিপার্টমেন্টে গেলাম। ল্যাব থেকে হেব্বি বিরিয়ানির গন্ধ আসছে। আহারে ফুড ডিপার্টমেন্টেরর লোক দের কত ভাগ্য। ওরা প্র্যাকটিক্যালের নামে কত কিছুই না খেতে পারে। তন্নিদের ক্লাসের বাইরে কিছুক্ষণ থাকার পর দেখি তন্নি ক্লাস রেখে বের হলো। হয়ত আমাকে দেখতে পেয়েছে। আমার সামনে এসেই বলল..
— ক্যান্টিনে চলো।
আমি কোন কথা না বলে চুপচাপ ওর সাথে যেতে লাগলাম। ক্যান্টিনে নিয়ে এসেই প্রথমে একটা খোচাঁ মারা প্রশ্ন করলো…
— শোনলাম তুমি নাকি এবার ৪.০০ আউট অব ৪.০০ পাইছো।
— সত্য তো জানোই। ডেকে এনে অপমান করছো।
— কথা গুলো যদি এতই শরীরে লাগে তাহলে ভাল রেজাল্ট করো না কেন?
— (আমি চুপ করে রয়েছি)
— আমাদের দুই পরিবারই আমাদের রিলেশন মেনে নিয়েছে কিন্তু তুমি যদি বার বার এমন রেজাল্ট করো তাহলে জীবনেও চাকরী জুটবে না। আর আমাদেরও এক হওয়া হবে না।
— ফেল কি আমি ইচ্ছা করে করছি।
— হুমম ইচ্ছা করেই। কারন পাশ করা অনেক সহজ কিন্তু ফেল করাটা কঠিন।
— ( কি বলবো জানি না তাই চুপ রইলাম)
— দেখো রাজ এভাবে চললে হয়ত আমাদের রিলেশন লং টাইম চলবে না। প্লিজ একটু মনযোগ দাও তোমার কেরিয়ারের দিকে।
— তন্নি তোমার কথা শেষ হয়েছে। যদি শেষ হয় তাহলে আমি উঠতে চাই।
— হুমম।

আমি আর বসে থাকি নি। উঠে চলে এসেছি ওর সামনের থেকে। ফেল মনে হয় মানুষ করে না। ফেল করলে অাস্তে আস্তে মানুষ সব হারাতে থাকে। যেমনটা আমি হারাচ্ছি। আর হা তন্নির সাথে আমার রিলেশন আজ দুই বছরের তবে আমরা প্রথমেই পরিবারকে জানিয়ে দেই। কিন্তু হঠাৎ এমন সমস্যা তৈরি হবে আমি জানতাম না।

রাতে পড়ার টেবিলে বসে বসে ভাবছি কোথায় থেকে পড়া শুরু করবো কারন আমার ৭ম সেমিস্টার একদম নিকটে। আমাদের রেজাল্ট দেওয়াই হয় অন্য সেমিস্টারের অর্ধেকের বেশি শেষ হলে । মাথা ঘুরছে,কিছুই বুঝতে পারছি না।

ঘুম ভাঙ্গলো সকাল সাতটায়। নিজেকে পড়ার টেবিলে আবিষ্কার করলাম। কখন যে ঘুমিয়েছি খেয়াল ছিল না। মোবাইল টা হাতে নিয়ে দেখি তন্নির অনেক গুলো ফোন আর ম্যাসেজ। আমাকে কথা শুনিয়ে মনে হয় নিজেই কষ্ট পাইছে। ও তো আমার ভালই চায়। রাতে ফোনটা সাইলেন্ট ছিল তাই ধরা হয় নি। ফোনটা ব্যাক করতেই ফোনটা রিসিভ হলো তবে তন্নি মনে হয় মাত্র ঘুম থেকে উঠছে।
— এতক্ষণে তোমার ফোন ব্যাক করার সময় হলো।
— ফোন সাইলেন্ট ছিল তো।
— আচ্ছা যাই হোক,সরি গতকাল ক্যান্টিনের ব্যবহারের জন্য। আসলে মাথাটা গরম ছিল।
— ঠিক আছে।এখন তুমি ঘুমাও, এরপর কথা হবে।

আপন মানুষ গুলো আজব হয়। ওরা বকাঝকা করে আবার ওরা নিজেরাই কষ্ট পায়। এভাবে দেখতে দেখতে ৩টা মাস চলে গেল আর সাথে সপ্তম সেমিস্টারও। এবার পরীক্ষাটা গতবারের চেয়ে বেশি খারাপ হয় নি তাই ভাল একটা রেজাল্ট আশা করা যায়। এদিকে আমি ইন্টার্নির জন্য গাজীপুর চলে এসেছি। তবে সাথে ৪ বন্ধুও আছে। ভালই দিন দিন কাজ শিখতেছি। এখন মাঝে মাঝে তন্নির সাথে কথা হয় আর বাবা মায়ের সাথেও কথা হয়। তবে মাঝে মাঝে বাসায় যাই।
দুই মাস পর ইন্টার্নি শেষে আবার বাসায় আসলাম তবে আপাতত কলেজে যাই না। এখন শুধু ৭ম সেমিস্টারের রেজাল্ট দিবে আর ৮ম সেমিস্টারের পরীক্ষা বাকি।

হঠাৎ একদিন রিজুর ফোন আসলো। অনেক দিন পর রিজুর ফোন। কারন, ইন্টার্নির পর কলেজেও যাই না আর একসাথে তো থাকিও না।

— হ্যা রিজু বল।
— দোস্ত আমাদের তো রেজাল্ট দিছে জানোস কিছু।(রাগি গলায়)
— না তো।
— তাহলে কলেজে আয়। আমরা সবাই আসতাছি।
— ওকে।

অনেক দিন পর সবার সাথে দেখা হবে তাই অানন্দের সহিত কলেজে গেলাম। কলেজে যাওয়ার ওর সবার মাঝে আমাকে বসালো। আর সবার রেজাল্ট রিজু বলতে লাগলে। কিন্তু আমার রেজাল্ট টা এমন ছিল যে সবাই এখন আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
কারন,সবাই এক বিষয়ে ফেল কিন্তু ওদের মাঝে আমি ৩.৩০ পেয়ে পাশ করেছি। আমি খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু সবার রাগ দেখে আবার চুপ হয়ে গেলাম।
— কি হলো সবাই আমার দিকে এমন করে তাকানোর কি আছে?
আর একটাও কথা শোনা হয় নি। যা হয়েছে তা শুধু মাইরের আওয়াজ। ও মা গো স্বাদের শরীরে বিস্বাদ লাগাই দিছে।
— শালা একা একা পাশ করছোস আমাদের রাইখা। আজকে তোর একদিন কি আমাদের যতদিন লাগে।

আর একটু পর পর রেস্ট নিয়ে নিয়ে মারছে। এ কোন মুসিবতে পরলাম রে। ফেল করলে বাপে বকে আর জি এফ টা টা দেখায় আর পাশ করছি বলে বন্ধুদের হাতে রাম ধুলাই। এ রকম মুসিবত আমার একারই হয় নাকি আর কারো হয়েছে?

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত