আংটি

আংটি

“ফুলশয্যার রাতে সায়ন আংটিটা পরিয়ে দিয়েছিল মিতুলকে। পাশাপাশি সাতটা ছোট্ট ছোট্ট হীরে বসানো আংটিটায়। প্রতিটা পাথর তাদের প্রতি জন্মের দ্বৈতজীবনের প্রতীক…এভাবেই মনে মনে ব্যাখ্যা করেছিল মিতুল। গা ভরা ভারী ভারী গয়নার থেকে ঐ আংটিটাই সবচেয়ে ভালো লেগেছিল তার। আংটিটা সায়নের মতো…সহজ, কিন্তু সুন্দর। চাঁপাফুলের সুবাস মৌতাত ছড়িয়েছে প্রদীপের আলো-আঁধারিমাখা ঘরে। জানালায় নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে যুবতী চাঁদ। বৈশাখী পূর্ণিমা আজ। মিতুল হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে আংটিটা। সায়নের কেমন নেশা লেগে যায় অপার্থিব এই পরিবেশে। মিতুলের চোখে চোখ রেখে অষ্পষ্ট হাসে সে…

সংসারের কাজের ফাঁকে, ভীড় বাসে ঝুলে ঝুলে অফিস যাবার সময়, স্নানের ঘরে, খুন্তি নাড়তে নাড়তেও আংটিটা দেখে মিতুল। আংটিটার প্রতি মুগ্ধতা কাটেনি তার। মাঝে মাঝে সায়নের কাছে ধরাও পড়ে যায় সে। সায়ন মজা পায় মিতুলের এই গোপন ছেলেমানুষী খেলায়।…”

… এই অবধি লিখে কলমটা নামালো দিঠি। নাঃ, হচ্ছে না। লেখাটা হচ্ছেই না। অস্থির অস্থির লাগে তার। এই গল্পটা লিখতেই হবে তাকে। চশমা খুলে চোখ কচলায়… হাই তোলে… আড়মোড়া ভাঙে। কাগজের দিকে তাকিয়ে আঙুল মটকাতে শুরু করে। ডানহাতের তর্জনী বামহাতের অনামিকায় এসে থমকে দাঁড়ায়। ছোট ছোট সাতটা হীরে পাশাপাশি বসে আছে সোনার পাতের উপর। বিয়ের রাতে অর্চি পরিয়ে দিয়েছিল।…

হাসি পায় দিঠির। তার আর অর্চির প্রেমপর্বটা যত সুন্দর ছিল, বিয়েটা অত সুন্দর হলো না। কেমন যেন অহেতুক পাশাপাশি বাস করা। বর হিসেবে অর্চির যতটা দায়িত্ববান হওয়া উচিত ছিল, তার সিকিভাগও সে নয়। সেজন্যই বোধহয় বৌ হিসেবে যতটা তার নির্ভরশীল হওয়া উচিত অর্চির উপর, তাও দিঠি হতে পারলো না। একটা সূক্ষ্ম শীতল তিক্ততা জমে আছে তাদের সম্পর্কে… মাছের বাজারের চিরন্তন আঁশটে গন্ধের মতো।”…

— পৃষ্ঠার কোণটা মুড়ে বইটা বালিশের পাশে রাখলো পাপড়ি। কৃশানু বড় আলোটা নিভিয়ে মশারীর ভেতর এসেছে। পাপড়ির আঙুলে আঙুল জড়াতে জড়াতে চাপা গলায় বললো, “বিয়ের আংটিটা অনেকদিন দেখি না। পরো না বুঝি?”

পাপড়ি অন্ধকারে হেসে ফেলে নিঃশব্দে। কৃশানুর এখন উত্তর চাই না। কোনওদিনই পাপড়ির কোনও উত্তর তার দরকার নেই…যেমন দরকার নেই পাপড়ির ভালমন্দ-সুবিধা-অসুবিধা জানবার। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বোজে পাপড়ি। যেদিন সে কৃশানুর উদাসীনতা প্রথমবার টের পেয়েছে, বিয়ের আংটিটা সেদিনই খুলে রেখেছে… ঠিক যেমনি কৃশানু এখন তার পোষাকটা খুলছে নির্মমভাবে।

…ঘুমের জন্যে অপেক্ষা করে পাপড়ি। ঘুমোতে পারলেই সেই ছেলেটা স্বপ্নে আসবে…। লম্বা লম্বা আঙুল ছেলেটার… একমাথা কোঁকড়া চুল। কেমন আলতো করে পাপড়ির হাতটা ধরে পরম মমতায় তাকায় তার দিকে… যেন পাপড়ির সমস্ত দায়িত্বভার তার। সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে পাপড়ির বাম অনামিকায় রোজ বিয়ের আংটিটা ধীরে ধীরে পরিয়ে দেয় সে। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে গাঢ়স্বরে ফিসফিস করে কি যেন বলে। সমুদ্রের গর্জনে কোনওদিন কথাটা শুনতে পায় না পাপড়ি।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত