রক্ত ভেজা ডায়েরি

রক্ত ভেজা ডায়েরি

অনন্ত কালের জন্য ঘুমাতে চাই! সকল দুঃখ কষ্ট ভুলে, সকল মায়া ভালোবাসার বাঁধন ছেড়ে শুধু ঘুমাতে চাই! শান্তিতে ঘুমাতে চাই। কিন্তু পারি না।শান্তিতে ঘুমাতে পারি না। স্বপ্নরা আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দেয় না। কানে কানে কি যেন বলে আমাকে। আমি শুনতে পাই না। স্বপ্নরা আমাকে নিয়ে হাসে খেলে। আবার চোখে চোখে ইশারায় কি যেন বুঝায় আমাকে। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না। আমি পারি না, কোন কিছুই পারি না। বুকের কলিজাটা ছিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। লম্বা দীর্ঘশ্বাস।

মরতে চাই! মরতেও পারি না। দু’চোখে বাবা মা বোনের হাসি মাখা মুখটা ভেসে ওঠে। পুরনো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আমাকে।আমি পারি না, আমি মরতেও পারি না। কতবার ঘুমের টেবলেট খেতে চেয়েছি। কতবার ব্লেড দিয়ে রগ কাটতে চেয়েছি। কতবার রাস্তার মাঝপথে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু মরতে পারিনি।কেন পারিনি? জানি না আমি। শেষ বিকাল এর শেষ সূর্য। আধো আলো আধো ছায়ায় পৃথিবীটা ঢাঁকা।

“তুই মরতে পারিস না? তোর জন্য মানুষের সামনে মুখ দেখাতে পারি না। তুই মরলে আমরা একটু বাঁচি।” বাবা মায়ের এই কথাটা মনে হতেই চোখ দু’টো ভিজে যায়। মানুষ বলে কাঁদতে কাঁদতে এক সময় চোখের পানি শুকিয়ে যায়। কিন্তু কই আমার তো কিছুই হলো না। এতো পানি কোথা থেকে আসে আমার? আমি বুঝতে পারি না।

জীবনের এই রঙ্গ মঞ্চটাকে চিনতে পারলাম না আমি। ভালো মানুষকে ভালোবাসে, খারাপ মানুষকে ঘৃণা করে।সত্যিই কি মানুষটাকে ভালোবাসে নাকি তার গুণটাকে ভালোবাসে ঘৃণা করে? আমি বুঝি না একদম বুঝি না। জগত সংসারের এই নিয়মটা বুঝতে পারলাম না। এই জগত বড় ভিন্ন। যুগের পর যুগ যাবে কিন্তু এই জগত অচেনাই থেকে যাবে। চিনার সাধ্য বড় দুষ্কর। ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না। আবার বোঝাও যাবে না।

যখন বাবা মা বলত, ‘তুই মরতে পারিস না!’ তখন খুব কাঁদতাম। কেন বলত জানেন? কারণ আমি লেখা পড়াটা শেষ করিনি। আবার চাকরি বাকরি ব্যবসা বানিজ্য কিছুই করি না। এখন আপনারাই বলেন আমার মতো ছেলেকে ভালোবাাবে! আদর করবে! নাকি ঘৃণা করবে?

যখন ইয়ার চেন্জ পরিক্ষার রেজাল্ট হতো তখন পারা প্রতিবেশি আত্মীয় স্বজনরা আমি কি গ্রেট পেয়েছি বাবা মাকে বলত। তখন বাবা মার মুখটা কালো হয়ে যেত। সন্তানের জন্য গর্ব করে একটা কথাও বলতে পারত না। কি করে বলবে! আমার তো একটা দুইটাতে ফেইল থাকতই। বাবা মা খুব কাঁদত।কিন্তু আমি কখনও তাদের কান্না দূর করতে পারিনি। স্বপ্ন দেখি বাবা মা বলছে, “খোকা বুকে আয়।”ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুনি বাবা মা বলছে, “বাবা তোর জন্য আমাদের গর্ব হয়।” কিন্তু ঘুমটা ভাঙ্গার পর সব মিথ্যা হয়ে যেত। তখন দু’চোখ বেয়ে পানি ঝরতে শুরু করত। বুকের ভিতরটা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। বুকের এই কষ্টটা কাউকে বলতে পারতাম না। কাউকে বোঝাতে পারতাম না।

সন্তান বড় হলে বাবা মার কষ্ট কমে। সন্তানের জন্য তাদের সুনাম বাড়ে। কিন্তু আমার বেলায়? ঠিক উল্টোটা। আমি পারলাম না, বাবা মার মুখটা উজ্জল করতে। আমি পারলাম না, সুনাম অর্জন করতে। বাবা মার মুখ থেকে কত কথা শুনতে ইচ্ছা করত। কিন্তু কোনদিন শোনার ভাগ্য হয়নি। আর কখনও হবেও না। এবং কোনদিন না। যেমন সব সপ্ন বাস্তব হয় না। তেমন আমার ইচ্ছাটাও পূর্ণতা পাবে না। অপূর্ণ থেকে যাবে কষ্টে নীল হবে চোখে শূণ্য পানি আসবে।

রক্ত ভেজা ডায়েরি। ডায়েরির প্রতিটা পাতা পড়ছে। শরীরের প্রতিটা তন্ত্রে শিহরণ বইছে। তিয়ানা আর পড়তে পারছে না। পরের পাতাটা উল্টাতে সাহস পাচ্ছে না। তার শরীরটা শিতল হয়ে যায়। প্রথমে ভেবেছিল কোন রোমান্টিক গল্প হবে। কিন্তু ধীরে ধীরে ভাবনাটা পাল্টাতে থাকে। একবার তাওহীদের দিকে চোখ ফিরে তাকায়। মনে মনে বলছে, ছেলেটা কত কষ্ট নিয়ে ঘুমিয়ে আছে।আবার পড়ায় মন দেয়।

কত স্বপ্ন ছিল, কত ইচ্ছা ছিল, কত আশা ছিল। আমি অনেক বড় হব। বাবা মার মুখ উজ্জল করব। পরিবারের মান সম্মান বাড়াব। দেশের জন্য কিছু করব। কিন্তু কিছুই হলো না। সময় পাল্টাল। আমি পরিবর্তন হলাম। পরির্বতন হলো আমার স্বপ্ন, আমার ইচ্ছা, আমার ভাবনা। আর পরিবর্তন হলো আমার জন। যে মানুষ গুলো আমাকে ভালোবাসত।সে মানুষ গুলো আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করল? কি অদ্ভুদ তাই না? ঐ সময় বুঝতে পারলাম মানুষের কোনো দাম নেই।দাম তার গুণের। হোক সেটা ভালো বা মন্দ।

আমার বোনটা আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝত না। যখন ছোট ছিল। তখন মরে যাওয়ার কথা বা মরে যাওয়ার ভাব ধরলে কেঁদে দু’চোখ ভিজিয়ে ফেলত। খুশিতে আমার চোখ দু’টো ভিজে উঠত।কিন্তু আজ! সে বোন আমাকে বলে, ‘তুই মরতে পারিস না? তোর জন্য মানুষকে মুখ দেখাতে পারি না। তোর জন্য লোকের মুখ থেকে নানা কথা শুনতে হয় আমাকে।’ কিন্তু আজ নীল বেদনায় দু’চোখ ভিজে ওঠে আমার। আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি কল্পনাও করতে পারেনি বোন আমাকে এভাবে বলতে পারবে।তাকে আমি কড়া করে একটা কথাও বলিনি।সে তো ঠিক কথাই বলেছে। আমার জন্যই তাদের কথা শুনতে হয়। নিষ্ঠুর পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষ। শান্তিতে থাকতে দেয় না।এক সময় আমার কাছে এসব অসহ্য হয়ে দাঁড়ায়। আপন মানুষদের এই কষ্ট এই যন্ত্রনা আর নিতে পারছিলাম না আমি। একদিন নতুন ভোরের আলোতে, নতুন স্বপ্ন সত্যি করতে ঘর ছাড়ি। অজানা পথে অজানা ঠিকানাতে।

তিয়ানা পাতা উল্টাচ্ছে। কিন্তু লেখা পাচ্ছে না। পাগলের মতো একটার পর একটা পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছে। শেষ পরণতি কি হলো? সেটা জানার জন্য তার মনটা ছটপট করছে।মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে, শেষ পরিণতি কি হয়েছে? ভালো না খারাপ। আমি কি পরের অংশটা পড়তে পারব না? তাওহীদের জীবনে পরে কি ঘটেছে জানতে পারব না? আবার লেখা পেয়ে তিয়ানার মনটা খুশিতে ভরে ওঠে।

চার বছর পর। আজ আমি সফল। হ্যাঁ আমি চিৎকার করে বলছি আজ আমি সফল। কেন যেন আমার চোখ জুড়া ভিজে ওঠে। এই চারটা বছর কিভাবে কেটেছে। শুধু আমিই জানি। ঐদিন সকল বাঁধন ছেড়ে কাকডাকা ভোরে বের হয়েছিলাম। মনে মনে অয়াদা করেছিলাম।যদি এই জীবনে কিছু করতে পারি তবেই বাড়ি ফিরব। আর যদি না পারি তাহলে সারা জীবনের জন্য হারাব। তারপর সিনেমার কাহীনির মতো আমার জীবনটা রাতারাতি পাল্টে গেল।মৃত পথ যাত্রী এক শিল্পপতি চাচাকে বাঁচিয়েছিলাম। শিল্প পতি চাচাই আমার জীবনটা পাল্টে দেয়। বাড়ির কথা মনে হলে নোনাজলে চোখ ভিজে উঠত।বুকের ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসত। তাদের কণ্ঠগুলো শুনার জন্য মনটা কাঁদত।বাড়িতে ফোন দিতাম হ্যালো হ্যালো হ্যালো শুনতেই ফোনটা কেটে দিতাম। তারপর একা একা চোখের পানি ফেলতাম। কতরাত কেটেছে রেকর্ড করা কথা শুনতে শুনতে তার কোন হিসাব নেই।

আজ বাড়ি ফিরছি। সব স্বপ্ন ইচ্ছা আশা বাস্তব করে বাড়ি ফিরছি। আপন জনদের মুখ গুলো বার বার দুই নয়নে ভেসে উঠছে। স্বপ্নে দেখা বাবা মার কথা গুলো বার বার কানে বেজে উঠছে। আমার পাগলী বোনটার জন্য কয়েক ডজন কাঁচের চুড়ি কিনেছি। অনেক গুলো শাড়ি কিনেছি। সে কাঁচের চুড়ি ও শাড়ি পড়তে খুব ভালোবাসে। ঈদের দিন কাঁচের চুড়ি খুলতে গিয়ে হাতও কেটেছিল। তাদের কতদিন দেখি আমি।আমি আসছি। আমি আসছি খুব তাড়াতাড়ি। তোমাদেরকে সুখের কান্না কাঁদাব। আর কখনও দুঃখের কান্না কাঁদতে দিব না আম।(আমি)

একটা অসম্পূর্ণ শব্দ। তারপর কোনো লেখা নেই। একটার পর একটা পাতা উল্টাচ্ছে। কিন্তু আর কোন পাতায় লেখা পাচ্ছে না।কী করে থাকবে? তাওহীদ যে কার এক্সিডেন্ট করে ফেলেছে।তিয়ানা কাঁদছে।একজন ডাক্তার হয়েও কোন ভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছে না। তিয়ানা তাওহীদের দিকে তাকিয়ে আছে। কি মায়া ভরা মুখ। তাকে দেখলে কে বলবে? তার মনের ভিতর কত কষ্ট লুকিয়ে আছে। তার স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল সত্যি আর হলো না। হঠাৎ বেগের কথা মনে হয়।

বেগের চেইন খুলতেই তিয়ানা স্তব্ধ হয়ে যায়। লাল টুকটুকে চুড়ি লাল টুকটুকে শাড়ি। তিয়ানার চোখ দু’টো ভিজে ওঠে।আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। তার স্যারেরা বলেছে তাওহীদ বাঁচতেও পারে আবার মরতেও পারে।চব্বিশ ঘন্টা পর বোঝা যাবে। তাওহীদ মরবে নাকি বাঁচবে। রক্ত ভেজা ডায়েরির উপর চোখ পরতেই হৃদয়টা কেঁদে ওঠে।তাওহীদের রক্তে ডায়েরিটা ভিজে আছে। কথাটা ভাবতেই তার শরীরটা কাঁটা দিয়ে ওঠে।

নতুন ভোর নতুন আলো। তাওহীদ না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছে।অনেক চেষ্টার পরও তাওহীদকে বাঁচাতে পারেনি তারা। প্রত্যেকে তাওহীদের ডায়েরি আর বোনের জন্য কিনে নিয়ে আসা চুড়ি শাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। এক স্বপ্ন জয় করার ছেলেকে দেখছে। কিন্তু নিয়তি ছেলেটাকে বাঁচতে দিল না। তার বাবা মার বুকে ফিরে যেতে দিল না। তার জমে থাকা কথা গুলো একটা বার বলতে দিল না।

বাবা মার বিশ্বাস একদিন ছেলে বাড়ি ফিরবে। কারণ ছেলে এক টুকরো কাগজে কিছু লিখে গিয়েছিল। এই বিশ্বাসেই তাদের দিন রাত কাটছে। কিন্তু নিষ্ঠুর দুনিয়া! ছেলে যে মরেছে তাদেরকে বলবে না। তাদেরকে সারাটা জীবন অপেক্ষায় করিয়েই রাখবে। নিষ্ঠুর পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত