জল

জল

জলরং ভালোই করত নিকট । শুনেছিলাম লালগোলায় পদ্মার পাড়ে ছিল ওর বাড়ী ।মুর্শিদাবাদ জেলার অপরিসীম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ওকে বোধহয় কৃপণ হতে শেখায় নি, তখন আমরা শ্যামবাজারের মোড়ে একটা দোকান থেকে কেক রং কিনে আনতাম, সে রং এখন আর পাওয়া যায় না । সস্তা কাগজে মোড়া কেক রং, কিন্তু অসাধারণ । কাগজ কিনতাম বৈঠকখানা বাজারে, কেজি দরে কার্টিস পেপার

— পোকায় কাটা আছে কিনা ভাল করে দেখে নিতে হত । নিকট কেকগুলোতে জল দিয়ে আগে প্যালেটে বসাত, তারপর ড্রয়িং করতো সামান্যই, একদম না করার মতই । এদিক ওদিক সারা কাগজ ভিজিয়ে তার ওপর ভিজে ক্যাত ক্যাতে রং চাপাত যেন হোলি খেলছে , প্রথম ওয়াশেই ছবি প্রায় শেষ,পরে সামান্য গ্লেজিং- অনবদ্য কবিতা হয়ে যেত।

অব্যর্থ ছিল ওর ছাড়া, জল যেন ওর সাথে কথা বলত। কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে বেরোনোর পর বহুদিন তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। না তার ছবি দেখেছি কোন পত্রিকায় না, করেছে কোন প্রদর্শনী । শ্যামলা, পলকা গড়নের গ্রামের ছেলেটিকে আমরা জীবনের আঁকে বাঁকে হারিয়ে ফেলেছিলাম অনেক দিন । এখন আর ছবি আঁকতে পারি না, বরং লোকের ফরমায়েস খাটি বললে ঠিক হয় । কমার্স আর আর্টের সম্পর্ক সাপে নেউলে বলে মাস্টামশাইরা শিখিয়ে ছিলেন, কিন্তু বলে দেননি কোনটা সাপ কোনটা নেউল, সাপের পাল্লায় পড়লে ছোবল তো খেতেই হবে । যাকগে, কমার্সিয়াল কাজে কিছু সাফল্য এসেছে, পার্টনারশিপে একটা সংস্থা চালাই, সরকারী একটা কাজের ব্যাপারে একবার বহরমপুর যেতে হয়েছিল, আবার নিকটকে দেখলাম তখনই ।

প্রথমটা আমি ওকে চিনতে পারিনি, ও ই আমার দিকে অনেক্ষণ চেয়েছিল । আমারও চেনা চেনা লাগতে শুরু করেছে, তখনই আমার নাম ধরে বলল, শুভঙ্কর, ঠিক বলেছি ?

কী ভয়ঙ্কর চেহারা হয়েছে নিকটের, চোখ কোটরে ঢোকা,কন্ঠার হাড় বেরিয়ে এসেছে, নোংরা জামা, হাতে আবার একটা চটের থলে । অনেকক্ষণ স্টেশনে বসে বসে আড্ডা দিলাম । একটু একটু করে ও সব খুলে বলল-ওর পদ্মাপাড়ের জীবনের কথা, পরিবারের কথা, সংগ্রামের কথা -সব কিছু । লালগোলা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে, পদ্মার পাড়ে ওর পৈতৃক বাড়ীতে এখন থাকে । বিয়ে থাওয়া করে নি, কিছু জমি আছে, তাতে ধান পাট হয়, একটা গরু আছে– ওই চলে যায় । মাঝখানে কিছুদিন একটা সাইনবোর্ড লেখার দোকান খুলেছিল লালগোলা বাজারে, ভাল কাজ পাচ্ছিল– বিডিও অপিসে কে একটা ভাই না কে যেন কাজ করে, সেইই জোগাড় করে আনত, তা শরীরের জন্য আর পারছে না, সে দোকান বন্ধ হয়ে গেছে । আজ ডাক্তার দেখাতে এখানে এসেছে । এত ভাল কাজ শেখা একটা ছেলে, এমন দুর্দশায় আছে, চোখ ফেটে জল এল, ছবি আঁকিস না আর তোর ওই দুর্ধর্ষ জলরং ?

একটা হতাশ হাঁফ ছেড়ে দুচোখ বোঁজে নিকট, তুই বিশ্বাস করবি না ভাই, সব কিছু ওই কারণে হচ্ছে রে, ওই হল আসল কারণ। একটু থামে নিকট, আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাই, কি হয়েছে কি ?

নিকট কিছুক্ষণ স্হির দৃষ্টিতে দেখে আমাকে, আমার বাড়ি চল একবার, না হলে বুঝতে পারবি না, আমিও হয়তো কথাগুলো কাউকে আর বলতে পারবো না। কি ছিল সেই ডাকে আমি জানিনা, হয়তো পুরোন বন্ধুর টান, বিশুদ্ধ শিল্পের ওপর আকর্ষণ কিম্বা সেই যার বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা হয় না তেমন কোন কিছু — না বলতে পারলাম না ।ওর ট্রেনের সময় হয়ে আসছে, উঠেই পড়লাম পাঁচটা সতেরোর ডাউন লালগোলায় । সেখান থেকে প্রায় সাতটা বেজে গেল লালগোলা পৌঁছতে । শরৎকালের বেলা, এখনও খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয় না, একটা অটোতে এলাম ময়া, সেখান থেকে টাঙ্গায় যখন নিকটের গ্রামে এলাম তখন রাত নটা তো বাজেই । এই যে এতটা পথ একসাথে এলাম, নিকট কিন্তু তার ছবি আঁকা ছাড়া সব ব্যাপারে কথা বলে গেল –আমার কথা শুনল, বন্ধু বান্ধবদের খবর নিল –সতীশ খুব নাম করেছে– প্যারিসে আছে, সমরেশ ভিশানএড- এর কেউকেটা, শেফালী আর্ট কলেজের লেকচারার হয়ে গেছে, এমন কি বিখ্যাত নবনীত নামের হিন্দি সিনেমাটির আর্ট ডিরেক্টর যে আমাদেরই এলেবেলে কেষ্ট সেটাও এমন ভাবে শুনল যেন এখনও ও কলেজে পড়ে । অন্ধকারে খুব ভাল দেখতে পেলাম না, ঠাণ্ডা ভিজে হাওয়া বইছে, খুব কাছেই নদি আছে, বোধহল ভীষণ কাছে। কিরে নিকট, এ তো নদির ঘাটে নিয়ে এলি, আমি অবাক হয়ে বলি । চটের থলে তুলে নিয়ে নিকট বলল , কি করব ভাই আমাদের বাড়ীটা এমনই বেখাপ্পা জায়গায়। দুই বন্ধু হাঁটা পথ ধরলাম । কিছুটা ঝোপঝাড় কিছুটা আল পেরিয়ে চলেছি, নিকটের চটের থলে থেকে একটা তিন সেলের টর্চ বেরিয়েছে । নিকট মাঝে মাঝে আমায় সাবধান করছে, দেখে আয় ভাই, আমার হাতটা ধর । কোথাও প্যাচ প্যাচে মাটি, কোথাও এক গোড়ালী জল, জুতো খুলে হাতে এসেছে, প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটুতে । দুই বন্ধু চলেছি, রীতিমত শীত করছে, অবশেষে একটা আম জাম গাছের জঙ্গল বাঁপাশে রেখে ডাইনে ঘুরতেই, নদী দর্শন হল । আকাশে আর্ধেক খাওয়া চাঁদ, কিন্তু তার

আলোতেই দেখলাম, নদী বটে–কেউ না বলে দিলে সমুদ্র ভাবা বিচিত্র নয় । আর একি সৌন্দর্য –পদ্মা সুন্দর আমি শুনেছিলাম তবে এই রূপ না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত । পদ্মার ধারে রাস্তা গেছে এঁকে বেঁকে অনেকটা । এরপর গ্রামের দিকে ফিরে নিকটের বাসা । একফালি জমির ওপর টিনের চাল দেওয়া মাটি আর ইঁটের দেওয়ালকে বাসা না বলে কুঁড়ে বলাই ভাল ।

মাসি, মাসি, নদীর গর্জন ছাপিয়ে ডাকতে থাকে নিকট, একটু বাদে লন্ঠন হাতে এক বৃদ্ধা দরজা খুলে দেয় । অন্ধকারে যা দেখলাম –দুটো ঘর, ছোট একটি দালান, এক দিকে একটা গোয়াল ঘর, এই হয়ে গেল । একটি ঘরের দরজা খুলে আমরা বসলাম । মাসি বোধহয় দালানে শুয়েছিল, একটা বিছানা পাতা, মশারি টাঙ্গানো মনে হল । একটা লন্ঠন দিয়ে গেল মাসি, বাবা খাবার বেড়ে দি, খেয়ে নাও দেকি। নিকট ঘাড় নাড়ল, চল টিউবওয়েলে মুখ হাত ধুয়ে নি । একটু ফ্রেস হয়ে তারপর সব শুনিস, মাসিকে ছেড়ে দিতে হবে, কোন সকাল থেকে আছে ।

খাওয়ার পর ঘরের সামনের দালানে দুজনে মুখোমুখি বসলাম । চাঁদটা আকাশে অনেকটা উপরে উঠে গেছে, আমাদের সুবিধা করে দিতে আলোটাও উসকে দিয়েছে একটু । পদ্মার আওয়াজ পাচ্ছি, হা হা করে বইছে, কি অদ্ভূত একটা শিহরণ খেলে গেল গায়ে । নিকট বলে চলে, এই মাথা ব্যথাটা একা আসে না রে, সাত বছর ধরে যখনই হচ্ছে তখন তুলি ধরতে হয় । বিশ্বাস কর তখন কিচ্ছু ভাল লাগে না, দপ্ দপ্ করে রগ দুটো, প্রাণপণে আঁকতে থাকি । আমি প্রশ্ন করি কি আঁকিস ?

— আরে সেটাই তো অদ্ভুত, আমি ইচ্ছা করে কিচ্ছু আঁকি না, তোকে ছুঁয়ে বলছি আমি ওসব আঁকতে চাইনা রে, হাড় জিরজিরে হাতটা দিয়ে আমার হাত টা চেপে ধরে নিকট । কি বলছিস ভাল করে বল, বুঝিয়ে বল একটু , আমি খালি হাত ওর হাতের ওপর রাখি সস্নেহে । ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে নিকট, গলা ধরে আসে, আমি কি জানি কবে কে মারা যাবে তার, ভয়ঙ্কর ছবি আঁকা হতে থাকে । গলাটা একটু পরিস্কার করে বলে চলে নিকট, ছবিগুলোর ঘটনা গুলো সত্যি হয়ে যায় রে ভাই, প্রথম ভাল মতো বুঝেছিলাম সুনামীর সময়, গলাটা কেমন আর্তনাদের মতো শোনায়, জানিস তার তিন মাস আগে চার চারটে ছবি এঁকেছিলাম মাথায় ব্যথা হচ্ছিল বলে, জ্ঞান হতে দেখি হাজার হাজার লোক মরছে, চটি ভাসছে জলে, উপুড় হয়ে বাচ্চার লাশ সমুদ্রের পাড়ে পচছে, শকুনে ছিঁড়ে খাচ্ছে, এই সব এঁকেছি, নিস্তব্ধ হয়ে যায় নিকট । কিন্তু তুই তার কি করবি, তোর জন্য কি সুনামী হয়েছে যে এসব ভাবছিস, মিলতে তো পারেই, আমি অসহায়ের মত বলি । ইচ্ছে না থাকলেও কোন শিল্পীকে দিয়ে কিছু আঁকানো হলে তার মনের ওপর কতটা চাপ পড়ে সেটা আমার অন্তত অজানা নয় । এবারে নিকটের চিৎকারটা পাগলের মত শোনায়, সব জল, জলের কারসাজি

— হড়কা বানের আগে, বন্যার আগে কত বলি তোকে, আমি মুক্তি চাই এই মৃত্যু মিছিল আমি আর আগে থেকে দেখতে পারছি না সব গেছে আমারআমাকেও নিয়ে যাবে দেখিস, ঠিক একদিন নিয়ে যাবে আবার নিঃশব্দে কাদঁতে থাকে নিকট ।

ছবিগুলো একবার দেখা আমাকে ভাই, গভীর সমবেদনায় বলি, আমারও গলা ধরে আসে, কলেজ লাইফ থেকেই বড্ড ভালবাসতাম এই পাগোল বন্ধুটিকে, কিন্তু একে এখানে একা রেখে গেলে তো বিপদ হতে পারে । যা মানসিক অবস্হা বুঝলাম কোলকাতায় নিয়ে গিয়ে এক্ষুণি সাইকিয়াট্রিস্ট না দেখালে সুইসাইড করে বসবে । তাহলে আমার বাড়ীতেই না হয় একটা রাখার ব্যবস্থা করি, শুয়ে শুয়ে এসব ভাবছিলাম । পদ্মার গর্জন কানে আসছে, আর একটা কিরকম ফট্ ফট্ আওয়াজ, ঘাস ছিঁড়লে যেমন হয় সেরকম একটা আওয়াজ পাচ্ছিলাম, ইঁদুর টিঁদুর হবে বোধহয়, কালকে একবার নিকটকে জিজ্ঞেস করবো, সারা দিনের পথশ্রমে ঘুমিয়ে পড়লাম ।

পরদিন ছবি দেখতে গিয়ে আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতা হল । বিন্দুমাত্র ভুল বলেনি নিকট। জল যেন সত্যি এক মৃত্যুদূত – তার নৃশংসতা যে কি ভীষণ হতে পারে সেটা ধরা পড়েছে ছবিগুলির ছত্রে ছত্রে । এ দৃশ্য অসহ্য । বন্যার একটি দৃশ্যে চোখ বন্ধ করতে হল, একটি মহিলার মৃতদেহের ওপর শিশু সন্তান দুধ খাবার চেষ্টা করছে, কি ভয়ঙ্কর প্রকৃতির আঘাত, এটি বোধহয় কেরালা বা এরকম কোথাও ঘটেছিল, ছবিটি নিউজ পেপারে দেখে শিউরে উঠেছিলাম । এখানে নিকট একদম অন্য এঙ্গেলে এটাকে ধরেছে, মুস্কিল টা হল জলরং এ ফিগারেটিভ ছবিতেও অনেক বিমূর্ততা থাকে, ঠিক কোথাকার ঘটনা এটা সবসময় বোঝা যায় না । ডেট দেখলাম ঘটনাটা ঘটার আগেই হবে, সুনামীর ছবিগুলিতে পরিস্কার সন তারিখ ঘটনার তিন চার মাস আগের — যদি অবশ্য এসব নিকট সত্যি বলে থাকে । সবকটি ছবিই অনন্য। এক্ষুণি একটা প্রদর্শনী করলে এই কুঁড়ে ঘর প্রাসাদ হয়ে যেতে যে একটুও দেরি হবে না সেটা আমাদের মত এ লাইনের সবাই বুঝতে পারবে । তোর এক্সিবিশানের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, চল ভাই আমার সাথে কলকাতায় চল, বোঝানোর চেষ্টা করলাম নিকটকে । গুম মেরে আছে ছেলেটা, কিছু বলল না ।

তখনও জানতাম না এর চেয়ে অনেক বড় বিষ্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছে । মাসি এসে চা করে দিল, একবাটি মুড়ি, শসা আর কাঁচা লঙ্কা এই হল জল খাবার। তখন বেলা একটু গড়িয়েছে, নিকট খেতে খেতে হঠাৎ বলল, ভাই মাথাটা ধরেছে। ভাল করে দেখলাম জ্বর আসলে যেমন চোখ লাল হয় তেমনই ওর দুচোখ লাল হয়ে যাচ্ছে । আমার ব্যাগে সবসময় প্যারাসিটামল ট্যাবলেট থাকে, একটা দিয়ে বললাম যা খেয়ে নে ।

দুপুরে সামান্য মেনু, ডাল মোটা চালের ভাত, একটা তরকারী । আমরা খেয়ে নিতে মাসি চলে গেল । রাতের লালগোলা আপটা ধরে চলে যাব বলে দিলাম নিকটকে, ভেবে রেখেছিলাম সাথে ওর কিছু ছবি নেব ওই সুনামী আর কেরলিয়ান মাদারের ছবিটা, আগে প্যাক করে রাখতে হবে, তাই নিকটের ঘরে ঢুকলাম । দেখি খাটে বসে আছে সে, চোখ রক্তের মত লাল, রগ দুটো চেপে ধরে আছে ।

কি হল ভাই, শরীর খারাপ লাগছে? মাথায় হাত দিয়ে দেখি, নাঃ জ্বরতো নেই। গলাটা কেমন পালটে গেছে, চমকে উঠলাম, নিকট এরকম ভাবে তো কথা বলে না । যেন বহু দূরের থেকে কথা বলছে এরকম একটা গলায় আমাকে যেন নির্দেশ দিল, আমি ছবি আঁকবো, চল ভাই, আমাকে ছবি আঁকতে হবে । দ্রুত পায়ে ইজেল, বোর্ড পেপার তুলি রং জলের মগ, সব অভ্যস্ত হাতে তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল,আমায় ছুঁতে অবধি দিল না । আমার বুক ঢিবঢিব করছে, কি জানি এ অবস্থায় নিকট কি করে বসে ! নিঃশব্দে ওকে অনুসরণ করলাম । বাড়িটার পেছনে ইজেল খাঁড়া করে, নদির পাড় দিয়ে তরতর করে নেমে মগে জল ভরে আনল নিকট , তারপর অবিশ্বাস্য দ্রুততায় চার আঙ্গুল মোটা টা ব্রাশ দিয়ে তিরিশ বাই বাইশ ইঞ্চী বিশাল সাদা কাগজটার দুটো পিঠ ভিজিয়ে বোর্ডে সেঁটে দিল সেটা । ঝরঝর করে প্যালেটে কিছুটা জল ঢেলে দিল অবজ্ঞায় । চোখে দেখছে তো, আমি ওর চোখটা দেখার চেষ্টা কোরলাম, বোধহয় বুঝতে পেরেই একবার আমার দিকে তাকিয়েই চোখ ঘোরাল নিকট, যা দেখলাম আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল — সে চোখে কোন দৃষ্টি নেই, অপার্থিব হাসি লেগেছিল ওর ঠোটের ফাঁকে । এখন তুলি তুলে নিয়েছে নিকট, মোটা চাইনিস ব্রাশ, সবাই জানে এ নিয়ন্ত্রণ করা কত কঠিন, এবার অদ্ভূত এক দৃশ্য দেখলাম, তুলি ভেজানোর সাথে সাথে জল যেন ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্যালেট থেকে কাগজে, হাজার বিন্দুতে বিভক্ত হয়ে নিজেরাই সাজছে বিভিন্ন রঙে,ধাক্কা দিচ্ছে একে অন্যকে, নিজেরাই গড়ছে ভাঙছে, আবার গঠন করছে অবয়ব । এও কি সম্ভব, কি হিংস্র, কি নির্মম কেউ কাউকে জায়গা ছাড়বে না, কিন্তু কি আঁকছে জল ? গভীর ভাবে দেখতে থাকি, খুঁজতে চেষ্টা করি কি বলতে চাইছে রঙিন তরল ।

বেশীক্ষণ নয় মাত্র দশ কি পনের মিনিট, আমার সামনে আস্তে আস্তে ফুটে ওঠে তুমুল জলরাশির ছবি, একটা বাড়ি ভেঙ্গে পড়ছে, আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে একটা চিৎকার, এটা নিকটের বাড়ী, কালকে আমি এখানে এসেছি, সবকিছু পদ্মা গ্রাস করছে, চারদিকে জল,একজন মানুষ ডুবে যাচ্ছে, একটা ইজেল, হঠাৎ বুঝতে পারলাম পায়ে পায়ে পেছনে পিছোতে পিছোতে আমি নিকটের থেকে বেশ কিছুটা পেছনে চলে এসেছি, আর ঠিক এই সময়েই, প্রচণ্ড শব্দকরে নিকটকে, তার বাড়ী ঘর সব নিয়েই পদ্মা গ্রাস করল ঠিক ছবিটার মত । একটু আগেও যে একটা বাড়ী ওখানে ছিল, একটা মানুষ ওখানে ছিল সেটা আর বোঝা গেল না । আমার চার হাত সামনে থেকে সবটাতে তুমুল জলরাশি পাক খেতে খেতে ঘুরতে লাগল, মাটি জলে গুলে সুন্দরী পদ্মার স্বচ্ছ শরীর যে কত প্রবঞ্চক সেটা প্রমাণ করতেই যেন জল রক্তের মত লাল হয়ে উঠল । অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম । গ্রামের লোকজনই আমায় সুস্হ করে, টিকিট কেটে দিয়ে বাড়ী পৌঁছনোর ব্যাবস্থা করে দেয়। সঙ্গেও আসতে চেয়ে ছিল আমিই আসতে দিইনি ।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত