না ফেরার দেশে

না ফেরার দেশে

অদ্ভুত স্নিগ্ধতা জড়ানো সকালের মায়াবী দৃশ্য উপভোগ করার মাঝে আনন্দের চেয়ে স্মৃতির পাতায় ডুবে যাওয়ার
মূহুর্তই বেশি। আনমনে জানালার ধারে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ ফোন বেজে উঠল।নাম্বারটা খুব চেনা আর
এই সময় কল আসাটা কাঙ্খিত ।যাই হোক…ফোন রিসিভ করতেই সুনামি বয়ে গেল।কথার সুনামি।
অভ্যাসটা আজও একই আছে।সকাল সকাল এত ঝারি হজম করা একটু কঠিন হলেও এতে অভ্যস্ত হওয়ায় সমস্যা হয়না।
নীলাশা আর আনমনা….. এমন ভাবেই তাদের দিন শুরু হয়। দুজন দুজনের অন্তপ্রাণ। সকালটা এমন হলেও সারাটা দিন কিন্তু ভালোই কাটে।চলুন এবার তাদের সারাটা দিন থেকে একটু ঘুরে আসি…..

সকাল ৯:৫৫….
আনমনা::মহারাণী আসছেন!!!ভালো…চলেন ক্লাসে যাই…
নীলাশা::চল….আর আজকে কিন্তু শয়তানি করবি না…প্রতিদিন তোর জন্য স্যারের বকা খাইতে খাইতে শুকাই যাইতেছি…
আনমনা::ওকে…বাবা…আজ একটা কথাও বলব না।এইযে ফুলস্টপ হয়ে গেলাম…
নীলাশা::হুমমম
সকাল ১১:০০
নীলাশা::ওই হারামি…তোর লগে আর জীবনে ক্লাস
করমু না…আজও ঝারি খাওয়াইলি!!যা এইখান থেইকা…
আনমনা::চুপ কর নদীনালা…তোর সাথে আমিও থাকব না…টাটা…
দুপুর ১:১০
আনমনা::ওই নদীনালা…টিফিন আনছি…খাওয়াই দে..
নীলাশা::তুই খা…
আনমনা::পিলিজ….আর তোর সাথে ঝগড়া করব না…:)তুই না আমার জিগারের দোস্ত..সোনা…ম..
নীলাশা::থাক…আর পাম্পিং করা লাগবে না…খাওয়াই দিচ্ছি..হা কর…
বিকাল ৪:০০
আনমনা::আজ প্রাইভেটে যাব না…..তুই যা..
নীলাশা::আচ্ছা…
((একটু পর পিছনে তাকিয়ে..)))
নীলাশা::ওই..তুই নাকি যাবি না ??আসছিস ক্যান আবার??
আনমনা::তুই একা গেলে কি পড়াল বুঝবি না..তাই আমিও আসতেছি…
নীলাশা::কুত্তী
আনমনা::তোর মতোই…:):):)

রাত৯:০০
নীলাশা::ফয়িন্নি..রিকুয়েস্ট কল ছাড়া কি আর কিছুই দিতে পারিস না?angry
আনমনা::শখ কত!তোরে রিকুয়েস্ট কল দিব না দেখা কাকে দিব!!
নীলাশা::তোর বর রে দে
আনমনা::কস কি!!বরকে তো ডিরেক্ট কল দিব…
(((অনেকক্ষণ দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়ায় কাটে রাতে)))

এভাবেই চলছে..কখনও হাসি কখনও কান্না..কখনও রাগ..কখনও অভিমান…
ছেড়ে না যাওয়ার দীর্ঘ প্রতিশ্রুতি…কিন্তু…মানুষ তো ভাগ্যের কাছে হেরে যায়…..:(
অনেক আনন্দ আর হাসির মাঝেই কেটে গেল কিছু বছর….বিদায় নেবার পালা চলে এসেছে..স্কুল জীবন শেষ যে!!!:(
ছলছল চোখে আনমনাকে বিদায় দিল নীলাশা:(
তবে যদি জানত এটাই শেষ দেখা তবে হয়তো কখনও ছাড়তো না আনমনাকে।স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানে খুবই অস্বস্তি লাগছিল আনমনার হাত ছাড়তে হয়তো এজন্যই।যে মেয়ের দুষ্টুমি ছাড়া একটা দিনও নীলাশার কাটেনি…তাকে ছাড়াই কাটাতে হচ্ছে কতগুলো দিন!!বিদায় অনুষ্ঠানই যে শেষ পথচলা ছিল…তা ভাবলে আজও থেমে যায় মনটা নীলাশার:(

বিদায় অনুষ্ঠানের ১০বছর পর…………

আজ সোমবার…নয় তারিখ।নয়টা লাল গোলাপ নিয়ে কবরস্থানে যাচ্ছে নীলাশা ।ওই যে সামনেই দেখা যাচ্ছে কবরটা….হ্যাঁ..ওই সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরেই শান্তিতে শুয়ে আছে পাগলিটা।কত বড় বেইমান!!সবাইকে থাকতে বলে নিজেই চলে গেল!!
🙁 🙁 🙁
আজকের এই দিনেই পাঁচটা বছর আগে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে একাই…নীলাশা হারিয়ে গেল আনমনার বলা শেষ কথাগুলোর ভিড়ে..
দশ বছর আগে বিদায় অনুষ্ঠানে আনমনা যা বলেছিল…সত্যিই তা মিলে গেছে…যা বলছিল সেদিন..তা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল নীলাশা…ভেবেছিল ফাজলামি:(
আনমনার সেই দিনের কথাগুলো আজও কানে বাজে..যা বলেছিল..
******দোস্ত…আমি তো তোর বেস্টু..তবে কিছু কথা বলি..

আমি যখন থাকব না তখন একদম কান্না করবি না।তোর হাসির মাঝেই আমি থাকব।আমার কথা মন থেকে মুছে দিয়ে নতুন জীবন শুরু করবি ….কখনও মন খারাপ করবি না ডাইনী…আর আমি যখন থাকব না..তখন প্লিজ তোর ডি.জে কে এটা বলিস যে তার মুখে হাসি পারফেক্ট।সে যেন নতুন ভাবে লাইফটা সাজায়।একটুও যেন কষ্ট না পায়…।তোরা ভালো থাকবি সবসময়।তার চোখের জাদুতেই থাকবে আমার বসবাস…..খুব তাড়াতাড়ি আমাকে যেতে হবে না ফেরার দেশে মন বলছে।আর আমার ডাইরীগুলো যত্ন করে রেখে দিস…আমার ফেভারিট জিনিসগুলো কিন্তু কাউকে দিবি না।তোর ডি.জে কে বলিস সে যেন সবসময় ভালো থাকে ।আর ডাইনী..তোকে নীল কালারে অনেক সুন্দর লাগে।আমার কথা ভাবিস না কখনও ।আমি তোদের খুব ভালোবাসি…আমাকে ছেড়ে যাস না কখনও..।******

আজ ওর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ওর এই কথাগুলো ভীষণ মনে পড়ছে..তবুও কান্না করা যাবে না…পাগলিটা কারো কান্না পছন্দ করত না..।
ও বলছিল…ওকে ছেড়ে না যেতে..কিন্তু ওই তো চলে গেল..!!বিদায় অনুষ্ঠানের পর আর একবারও দেখা করে নাই …ওর অদ্ভুত কিছু ইচ্ছা ছিল..দেখা না করা ওর ইচ্ছাগুলোর একটা… ও বলত friendship এ দুরত্ব থাকাটা সবচেয়ে ভালো।ওর শখ পূরণের জন্যই দেখা করিনি।তবে সারাজীবনেও যে দেখা হবেনা…এটা বুঝিনি:(
ওর একজন প্রিয় মানুষের জন্যও যদি বেঁচে থাকত!!!পাগলিটার ইচ্ছেগুলো পূরণ করে দেওয়ার সময়টা ও ওর প্রিয় মানুষটাকেও দেয়নি…তার আগেই চলে গেছে….:(
আজও ওর কথা কেউ মনে করে চুপটি করে বসে থাকে…কিন্তু ও আর নেই…!!!ওকে দেওয়া কথাটা রাখতে পারিনি……..:(
যদি চলেই যাবে এসেছিল কেন!!!
হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নামল আকাশ ছেড়ে মাটির টানে।
সত্যিই সুন্দর….তবে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য যে ব্যাকুল ছিল…সেই আজ এই কবরস্থানে সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে ঘুমিয়ে আছে…!!!ওওও..ফুলগুলোও একদম ভিজে গেছে..আজও ফুলগুলো দেওয়া হলো না শুকনো…!!
আনমনা… নামটাও স্বার্থক!সত্যিই বড় আনমনা ছিল মেয়েটা….জীবন নিয়েও উদাসীন…!!!তবে সেও কাউকে ভালোবেসেছিলো!!!কল্পনা..ইচ্ছে..স্বপ্ন সব সাজানো ছিল শুধু তাকে ঘিরেই…কিন্তু…ভাগ্যের কাছে হেরে গেছে আনমনা….।কি নিষ্ঠুর এই দুনিয়া!!

আজও আনমনার প্রিয় জিনিসগুলো আছে…ওর শাকচুন্নী মানে আমি(নীলাশা) আছি..ওর প্রিয় মানুষটা আছে…ওর ইচ্ছে আছে…..
শুধু………পাঁচ বছর আগে রোড অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে …..আনমনা নেই……..
সে এখন না ফেরার দেশে….

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত