স্বপ্নঘোর

স্বপ্নঘোর

আমার পাশে শুয়ে ভাইজান গুটিসুটি মেরে প্রেম করে যায়। আমি কান পেতে বুঝে উঠতে পারি না। ওপাশের মানুষটা ঠিক ঠিক বুঝে যায়, স্বপ্ন আঁকে, স্বপ্ন দেখে ঘর সাজায়, কি অদ্ভুত না। এক বিছানা দু ভাইকে যতটা না কাছে এনে দিয়েছে ঠিক ততটাই বোধহয় দূরে সরিয়ে ফেলেছে। নদীর একুল ওকুল তফাত। এদিকের জোয়ার ভাটা ওদিকে খুব একটা স্পর্শ করে। এদিকের পানি ওদিকে গড়ায় না। রাত বাড়লেই দেয়ালে আঁকিবুঁকি কাটি, পিঠ ঠেকিয়ে ঠান্ডা শিরশিরে অনুভূতি জন্মাই। আমার খুব করে ইচ্ছে করে তোমার বুকে মুখ ঠেকিয়ে হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক আওয়াজ শুনি, প্রতি বিটে নিজের নাম গুনি।

সকালবেলার রোদটা ঠিক মুখে এসে পড়ে, ফোনের কৃত্রিম আওয়াজের খুব একটা দরকার বোধ করি না। ফোনে টুকটাক বার্তা জমা হয়ে থাকে। কেউ খুব করে চাইছে আমাদের দেখা হোক। আজকের সকালটাও বোধহয় তাই চাইছিলো। আমি টুক করে বেড়িয়ে পড়লাম।

এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়, আড়াল, আধার, আকাশ সবটার কি সুন্দর মিশেল। নদীর জলে লাল টুকটুকে আলতা রাঙানো পা ছুঁইছুঁই। আমার কেমন স্বপ্ন লাগে। হাত বাড়িয়ে ছুই, মন বাড়িয়ে ছুই। জুই খিলখিল করে হেসে ফেলে। এত অদ্ভুত কেন তুমি বলত?
জুইয়ের এসব প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি না।

কিভাবে বোঝাই আমি অদ্ভুত নই, অদ্ভুত তুমি। তোমার চোখ, চুল, টিপ। তোমার আকাশ সমান আঁচল, যেখানে নির্দিদ্ধায় স্বপ্ন বোনা যায়।

যাবে?
চল।

জুই হাত বাড়িয়ে ডাকে। হাটতে হাটতে থেমে যায়, পাঞ্জাবীর কোনা টেনে ধরে, কাশফুল তুলে দিতে বলে। ইচ্ছে করে রিকশায় আঁচল বাধিয়ে বসে। আমি সামলে দি, নিজেকে সামলে নি।

সর্বনাশের শেষ মুহুর্তগুলো চোখে বাধিয়ে রাখি, আঁচল উড়িয়ে আমার আকাশ হারিয়ে যায়।

বারান্দায় বেশ এক চিলতে জায়গা হয়ে গেছে আমার। এক কাপ চা হাতে বেশ স্মৃতিতে ডুব দেয়া যায়। কলেজে আমাকে কেউ খুব একটা চিনত না, পাশে বসে থাকা ছেলেটা যেন অদৃশ্য মানব হয়ে গেছিল সবার কাছে। খুব একটা কথা বলতে পারতাম না, বেজায় চুপচাপ, যার সবথেকে প্রিয় কাজ জানলার বাইরের কাক কালো পুকুরটেয় অদ্ভুত সব খেয়াল আঁকা।
সেবার খুব অবাক করেই স্টেজে উঠে কবিতা কইলাম

“ছোঁয়া যায়নি,
মেঘে মেঘে বহুদুর, বহুদিন হেটেছিলাম
পাইনি,
পাইনি যেখানে থাকবার কথা ছিল
যে খাচায় বাধা ছিল
যে মরন আসবার ছিল
আসেনি
আসেনি কোন অচেনা চিঠি
একশো ফানুশ জ্বলেছে মিছেমিছি
বাসেনি
বাসেনি ভালো চোখদুটো
অতল জল, আকড়ে ধরা খড়কুটো
সত্য তুমি, মিথ্যে তুমি
আমার মাঝের সবটুকু।”

কিছু চোখ অবাক ছিল, কিছু মুগ্ধ। একটা কবিতা আমাকে জুই এনে দিল। দুটো মুগ্ধ চোখ, তিরতিরে কেপে যাওয়া ঠোট এক জীবনে এর থেকে বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না। সবসময় চুপিচুপি কেউ বলে যাচ্ছে আমি আছি আমি আছি আমি আছি।

সে অর্থে আমি জুই এর হাত ধরিনি কখনো, আচল ছুয়েছি, বায়না করে চুল ছুঁয়েছি। জুই ধরেছে হাত, বেশ শক্ত করে ধরেছে, চুলে হাত বুলিয়ে দিয়েছে। ও যতবার হাত বুলিয়েছে, বুকের ভেতর জল চুয়েছে, ফুটো হয়েছে। এত সুখ কিভাবে পায় কেউ, এত সুখ সত্যিই কি কেউ পায়?

ভিজছে শার্ট , চুইছে জল
বুকের মাঝে আঁকড়ে ধর।

রতনকে দেখতাম পাতার পর পাতা চিঠি লিখত, সারারাত ধরে খাটের পাশে মুঠোমুঠো কাগজ জমা হত। মাঝরাত্তিরে রতনকে দেখতে ঠিক দিকভ্রান্ত নাবিকের মতন দেখাত, ঠিক কিভাবে সে মানুষটিকে বোঝানো যাবে, কিভাবে শোনালে জানানো যাবে কতটা ভালোবাসা যায়, ভালবেসে দূর থেকেও ছোঁয়া যায়। জুইকে কখনো চিঠি লেখা হয় নি, ভুল শোনালো চিঠি দেয়া হয় নি। প্রতি রাত্তিরে চিঠি লেখা হয়, কাগজ কলমের বালাই নেই, বুকের ভেতরের জমানো সাদা পাতা লিখে ফেলা হয়। সেসব চিঠির কথা কখনো বলা হয়ে ওঠেনি।

একদিন সকালে উঠে শুনলাম রতন নেই। নিজের প্রতি কত অভিমান জমা করে রেখেছিল ছেলেটা, কাউকে জানতে দেয় নি। কিছুদিন পরে সবাই রতনকে ভুলে গেল, আমি ভুলতে পারলাম না। মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে দিকভ্রান্ত নাবিকটাকে আর দেখব না ভাবলেই বুকটা হু হু করে ওঠে। আমার নামে সেবারই প্রথম চিঠি এল। রতনের চিঠি, খুব রাত্তিরে সে চিঠি পড়ে জল ছুঁইছুঁই।

“তুমি আমাকে ভুল বুঝোনা কেমন। আমার কেন যেন মনে হতে লাগল তোমাকে কিছু জানানো দরকার। বন্ধুত্বের চার বছরেও আমি তোমাকে তুমি বলে এসেছি। তুমি আমার কাছে এসে থেকেছ সত্যি বলতে আমি খুব করে চেয়েছি তুমি আসো। তুমি কিছু না বলেই আমাকে বুঝতে পারো। দীপা পারেনা, কেন পারেনা বলতে পারো? আমি কখনোই দিপাকে ছুঁতে পারিনি, আমার শব্দগুলো ছুঁতে পারেনি। কেন? আমি খুব ভেবেছি, খুব ভেবেছি। ভেবেছি আমি বোধহয় বোঝাতে পারছিনা, নিজের প্রতি বডড অভিমান হত, আমি এমন কেন। তারপর দিপা চলে গেল, আমি দিপাকে দোষ দি না। আমার মাঝেই হয়ত কমতি ছিল, ভালোবাসার কমতি, ভালো বাসা পাবার কমতি। দিপার প্রতি আমার কোন অভিমান নেই, নিজের প্রতি অভিমান করে চলে যাচ্ছি, উপরঅলাকে ই নাহয় জিঙেস করব কি ছিলনা আমার মাঝে। তুমি ভালো থেকে, আমকে মনে রেখোনা। দিপার মতন ভুলে যেও। আমি বোধহয় ভুলে যেতেই এখানে এসেছিলাম। অদৃশ্য ইরেজার তোমার হাতে। ”

ভালোবাসা বড্ড স্বার্থপর হয়। কাছে পেতে হবে, ছুঁয়ে দিতে হবে, শুনে যেতে হবে, বলে যেতে হবে কত্ত কি। একদিন হয়ত জুই আমাকে ছেড়ে যাবে, সে চলে গেলেই কি আমাকে চলে যেতে হবে। আমি তো ভালবাসতে পারি, চোখ বুজে ছুঁয়ে দিতে পারি। রক্তমাংসের জুইকে নাহয় নাইবা পেলাম, কল্পানার জুইকে ভালবাসতে তো আর কোন বাধা নেই।

জুইকে বলতেই হেসে লুটিয়ে পড়ল। তুমি এমন কেন বলত। আমারা বিয়ে করছি বুঝেছ? শার্টের কলার চেপে বলে উঠল। দু দূটো বাবু হবে আমাদের একটা তোমার ঘাড়েচাপা আরেকটা কোলে। আমাদের তিনজন কে তুমি কিভাবে ছেড়ে যাও তাই দেখছি।

বুকের কাছটা ভিজে যাচ্ছে, চোরাবালিতে ডুবে যাবার ভয়ে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের স্বপ্নগূলো বড় অসহায়। সবসময় ভিজে যেতে হয়। এসব ভেজা ভেজা স্বপ্ন বুকে আমি শহর হাটি। কেউ একজন খুব করে অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করে তুলতুলে দুটো ছানাপোনার, অপেক্ষা করে দিনশেষে আচল দিয়ে কারো ঘাম মোছার। আমি হেটে যাই, আমরা হেটে বেড়াই শহরজূড়ে। স্বপ্নগুলো তালুবন্দি করবার আরেকখানা স্বপ্ন নিয়ে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত