অপেক্ষার অবসান

অপেক্ষার অবসান

বিয়ের ৭ মাসের মাথায় ফাতেমাকে স্বামীর কাছ থেকে শুনতে হলো।যে তোমার সাথে আমার যাই না।তোমাকে আমি ডির্ভোস দিবো।স্বামীর এই কথার পর খুব একটা দেড়ি হয়নি,বা তার ফাতেমার স্বামী দেড়ি করেনি। কয়েকদিনের ভিতরে ফাতেমার কাছে ডির্ভোস পেপারটা ধরিয়ে দেই।ফাতেমা হাঁসবে নাকি কাঁদবে ভেবে পায় না।কথায় আছে “মান যায় যার জাত যায় তার “!ফাতেমার ক্ষেত্রেও ঠিক তার উল্টোটা হবেনা মনে হয়।ফাতেমা এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে।আসলে মধ্যবিত্ত বললেও ভুল হবে,গরীব বলাটাই শ্রেয়।তা’না হলে ধারের টাকার কারণে বাবা কেনো ,এমন একজন মানুষের সাথে ফাতেমাকে বিয়ে দেবে!

ফাতেমা সেই ছোট কাল থেকেই নামাজ পড়ে,রোজা রাখে,বড়দেরকে যতেষ্ট সম্মান করে আর ছোটদের অকাজে শাসন আর ভাল কাজে উৎসাহ উদ্দীপনা দিতো।মন থেকে ছোটদের স্নেহ করতো।দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ আশেপাশের কয়েক গ্রাম খুঁজেও ফাতেমার মতো গুণবতী একজনকে পাওয়া যাবেনা।ছোট বেলাই যখন দাদি,নানিদের কাছে স্বামীর বাড়ির গল্প শুনতো।তখন থেকেই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতো “আল্লাহ আমার ভাগ্যে যেন একজন দ্বীনের মানুষ জোটে “!আল্লাহ কাছে ফরিয়াদ গ্রহণ হয়েছে কি’না তা ফাতেমা জানেনা আজ।তা’না হলে জসীমের মতো একজন মানুষের সাথে কেনোই বা তার বিয়ে হলো।

আসলে ফাতেমার বাবা জসীমের বাবার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলো।অভাব অনটনের সংসারে না পারছিলো ধার সুদ করতে না পারছিলো সংসার চালাতে! এর মধ্যে জসীমের বাবা ধারের টাকার বদলে, ফাতেমাকে জসীমের বউ করার প্রস্তাব দেয়।প্রথমে রাজি না হলেও,পরবর্তিতে রাজি হয় ফাতেমার বাবা। যদিও জানতো জসীম ছেলেটা ভালো না।সবসময় খারাপ কাজে লিপ্ত থাকে।মদ।গাজা জোয়া এসবি তার কাছে সব।জেনে শুনেও ফাতেমাকে জমীমের কাছে বিয়ে দেয়।তাছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা।ফাতেমাও তার বাবার সিদ্বান্তের উপর কোন কথা বলেনি।কথা বলেও কোন লাভ নেই! আর তার বাবারেই বা কি করার ছিল? তাই তার সব স্বপ্ন বুকের ভেতর পাথর চাপা দিয়ে মন থেকেই জসীমকে মেনে নিয়েছিলো।আশা ছিলো জসীমকে ভালোর পথে নিয়ে আসার।আর জসীমের বাবাও এই একই আশাতে ফাতেমাকে জসীমের বউ করেছে!

কিন্তু কাজের কাজ একটাও হলোনা! ফাতেমা এই সাত মাসে জসীমকে অনেক বুঝিয়েছে,কিন্তু তার বিনিময়ে পেয়েছে শুধুই তাচ্ছিল্য আর অবহেলা।স্বামীর কাছে স্ত্রী হিসেবে কোন অধিকার পাইনি।জসীম যখন নেশা করে বাসায় ফিরতো,যত রাত হউক না কেনো।ততক্ষণ ফাতেমা সজাগ থাকতো। জুতা গুলো খুঁলে বিছানাতে শুয়িয়ে দিতো।কতরাত না খেয়ে কাঁটিয়েছে তার কোন হিসেব নেই ফাতেমার।কিন্তু কোনদিন জিজ্ঞেস করেনি জসীম “যে ফাতেমা খেয়েছো”?মনের মধ্যে পাথর চাপা দিয়ে দিন গুণছিলো কবে তার স্বামী একটু ভালভাবে কথা বলবে। একটু বলবে যাও ফাতেমা একটু সেজে আসো “আমি আমার বউকে দেখবো”!কিন্তু না তার কিছুই হয় না।ফাতেমা যখন ডির্ভোস পেপারটা হাতে নিলো,তখন অজান্তেই তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।

না নিজের জন্য না,তার অনাগত সন্তানের জন্য।যদিও জসীম আর ফাতেমা আলাদা থাকে! কিন্তু জসীমের সন্তান ফাতেমার গর্ভে।কোন এক বৃষ্টির রাতে,মাতাল হয়ে ঘরে ফিরে জসীম।আবেশে উম্মাদ্বনাতে কাছে টেনে নেই ফাতেমাকে।সেই রাতের ভালবাসার ফসল আজ ফাতেমার গর্ভে! কিন্তু তা জসীম জানেনা।ফাতেমা ভাবে মানুষটার মনে কি আল্লাহ তা’য়ালা একটু বুঝ দেন নাই মায়া দেন নাই।জসীমের বাবাও বলেছিলো “বাবা বউ মাকে তালাক দিস না “!কিন্তু কে শুনে কার কথা। জসীম ঠিকেই তালাক দিয়ে দিলো।শত খারাপ হলেও এই মানুষটার জন্যেই ফাতেমার আজ অনেক খারাপ লাগছে

সময় বয়ে চলে সময়ের মত করে।সময়ের কোন তাড়া নেই।নেই কোন পিছু টান।কারো জন্যে অপেক্ষাও করতে হয় না।কিন্তু সময়ের সাথে বদলে যায় আশেপাশের অনেক কিছুই।তেমনি জসীম আর ফাতেমার জীবন দুভাগ হওয়ার পর কেটে গেল ৫ বছর!পাঁচ বছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে।পৃথিবীতে অনেক কিছু আবিষ্কার হয়েছে।অনেক কিছু ঘটেগেছে।তেমনি জসীমের লাইফটাও পরিবর্তন হয়েছে সেই বেশ আগে।আগের জসীম আর এখনকার জসীমের মাঝে আকাশ পাতাল ব্যবধান।যদি পাঁচ বছর আগে কেউ জসীমকে দেখে থাকে।আর এই পাঁচ বছরে তাদের দেখা না হয়।তবে যদি হঠাৎ দেখা হয়,তবে জসীমকে চিনতে হিমশীম খেয়ে যাবে যে কেউ।মুখ ভর্তি দাঁড়ি,আর সবসময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন।এলাকার উন্নয়নমূলক কাজ করে দেন।বাবার ব্যবসার দায়ত্ব নিয়েছেন।কোন এক ঘটনা জসীমের জীবনটা পরিবর্তন করে দেই।জসীম বুঝতে শুরু করে জীবনটা তুচ্ছ নয়,যে যা খুশি তাই করবে।আল্লাহ তাকে পৃথিবীতে রঙ তামাশা করতে পাঠাইনি,অবশ্যই সত্য পথে থেকে ভালো ভাবে জীবন যাপন করতে পাঠিয়েছেন।সে এসব কথা ভেবে আর মনে ধারণ করে নিজেকে পাল্টে নিয়েছে।এখন তার সব কিছুই আছে,কিন্তু সেই মানুষটি নেই।হ্যাঁ ফাতেমা তার লাইফে নেই! ফাতেমার কেয়ারিংগুলো খুব মিস করে জসীম।রোজ রাতে খাবার নিয়ে বসে থাকা,মাতাল হয়ে আসার পর জুতা খুলে দিয়ে খাটে শুয়ে দেওয়া।যত্ন করা এসব মিস করে ।সব কিছু থাকার পরেও মনের শূণ্যতা পূরণ হয় না।নিজের জীবনের সাথে আর কোন রমণীকেও জড়িয়ে নেইনি।কারণ মাতাল অবস্থায় ফাতেমার ভালবাসাটাই মিস করে প্রতিনিয়ত। তাই কোন রমণীকে জীবনে টানেনি।

এই পাঁচ বছরে ফাতেমার জীবনও বদলে গিয়েছে।না সে দ্বিতীয় কোন বিয়ে করেনি।মেয়েদের বিয়ে তো একবারেই।তারপরে এক ধার্মিক ফ্যামিলির মেয়ে,নিজের ফ্যামিলির কথা ভেবে আর বিয়ে বসেনি।তার সন্তানকে নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে পাঁচ বছর।তার একটা পিচ্চি মেয়ে হয়েছে,জসীমের মাতাল হওয়া এক রাতের ভালবাসার ফসল এই মেয়ে। মেয়েটির নাম রাবেয়া।ছোট মেয়ে চার বছর বয়স।যে কেউ দেখলে তার প্রাণটা জুড়িয়ে যাবে।ফাতেমার বাবা যদি জিঙ্গেস করে “রাবেয়া তোমার আব্বুর নাম কি? ” তখন রাবেয়া বলে জসীম “।কারণ ফাতেমা তার মেয়েকে জানিয়েছে তার বাবার নাম জসীম।কারণ ফাতেমা এখনও জসীমকেই স্বামী হিসেবে মানে! আর এই পিচ্চি মেয়ে রাবেয়ার কথা ভেবেই ফাতেমা আর বিয়ে বসেনি। একে নিয়েই জীবন পাড়ি দেবার স্বপ্ন আর ইচ্ছা দুটোই।বাকিটা আল্লাহ জানেন ভাগ্যে কি লিখে রেখেছে।

নিজের শূণ্যতা গুছাতে জসীম আজ ফাতেমার দুয়ারে! না ফাতেমাদের বাড়িতে যাইনি।দূর থেকেই দেখেছে।তবে মনের আকাশের মেঘগুলো আজ হঠাৎ করেই যেন ঝড়ে পড়ছে জসীমের চোখ বেয়ে।তার কারণ দূর থেকে দেখেছে “ফাতেমা ছোট একটা মেয়ের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। আর চুলে বেনি করে দিচ্ছে।এত বছর পর ফাতেমার কাছে এসেছে।তবে কোন সাহসেই পাচ্ছিলো না ফাতেমার কাছে যেতে।মনে একটা আশা নিয়ে এসেছে।কারণ জসীম জেনেছে যে ফাতেমা আর কোন বিয়ে করেনি।তবে দূর থেকে পিচ্চি মেয়েটাকে দেখে এক লোকের কাছে জিজ্ঞাস করে ছিলো।যে পিচ্চি মেয়েটা কে? তখন লোকটা বলেছিলো “পিচ্চি মেয়েটা ফাতেমারই মেয়ে “! লোকটার কথা শুনে অজানা কারণে মনটা ভেঙে গেলো।যে আশা নিয়ে এসেছিল,তা ভেসতে গেল।মনে করে ছিলো,ফাতেমাকে আবার তার জীবন সঙ্গী করবে।তা যে-কোন ভাবেই।কিন্তু না তা হলো না।মনে বিষণ্ণতা নিয়েই ফিরে চলতে লাগলো জসীম।

-হঠাৎ পিচ্চি একটা মেয়ের কন্ঠে “আব্বু” ডাক শুনে ধমকে দাঁড়ালো জসীম! পিছনে ফিরে দেখে সেই মেয়েটা

“যাকে কিছুক্ষণ আগেই ফাতেমা মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছিলো।জসীম নিচু হয়ে পিচ্চি রাবেয়াকে ধরে বলে “কে

তোমার আব্বু মা”? পিচ্চি রাবেয়া বলে “তুমিই আমার আব্বু “!পিচ্চি মেয়েটার কথা শুনে রীতিমতো অবাক হয় ফিরোজ।কি করে সম্ভব? তবে মেয়েটার মুখে আব্বু ডাক শুনতে খারাপ লাগছেনা জসীমের! বেশ ভালোই লাগছে আব্বু ডাক শুনতে। জসীম আবার জিঙ্গেস করলো “মা কে বলেছে আমি তোমারই আব্বু “?জসীমের এরকম কথাতে পিচ্চি রাবেয়া বললো আমার আম্মুই বলেছে “তুমি আমার আব্বু “?আম্মু আমাকে তোমার ছবি দেখিয়েছে।এতো দিন কই ছিলে তুমি আব্বু? এবার আর নিজেকে সামাল দিতে পারলো না ফিরোজ।খুব স্নেহের পরশে বুকে টেনে নিলো পিচ্চি রাবেয়াকে। চোখ দিয়ে জসীমের পানি ঝড়ছে।তার কোন দিকে খেয়াল নেই।কেমন করে ফাতেমার গর্ভে তার সন্তান আসবে তাও ভাবছেনা।

আম্মু তোমার মা কোথায় এখন? জসীম তার মেয়ে রাবেয়াকে জিজ্ঞেস করলো।জসীমের প্রশ্নে রাবেয়া হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলো ঐ যে তার আম্মু।জসীমও মেয়ের দেখানোর দিকে দেখলো যে ফাতেমা দাঁড়িয়ে।দূর থেকেই বুঝা যাচ্ছে ফাতেমার চোখেও জল।

শেষ
পাঁচ বছর পর ফাতেমার অপেক্ষার অবসান হলো।ফাতেমা মনের মধ্যে আল্লাহর উপর বিশ্বাস ধারণ করেছিল।সে যদি একজন সৎ আল্লাহর বান্দী হয় তবে তার সংসার এভাবে ভেঙে যেতে পারেনা।তাই হলো আজ।না তাদের নতুন করে বিয়ে করতে হয়নি।ইসলামে রেওয়াজ আছে যে তালাক দিলে।সেই স্ত্রীকে আবার বিয়ে করতে হলে অন্য পুরুষের সাথে আগে বিয়ে দিতে হবে।কিন্তু ফাতেমা আর জসীমের ক্ষেত্রে তা হয়নি।কারণ তাদের ডিভোর্স হয়নি।ঐদিন জসীমের দেওয়া ডিভের্স পেপারে ভুলে জসীম সাইন করে দেইনি।কারণ তখন সে মাতাল ছিলো। তারপরে ফাতেমাও যখন দেখলো সাইন করা নেই ,সেও কিছু বললো না।আর এভাবে ফাতেমা জীবন অতিবাহিত করে,আর ফাতেমাকে উৎসাহ সাহায্য সব করেছে ফাতেমার শ্বশুড় মানে জসীমের বাবা।কারণ জসীমের বাবা সবসময় চাইতেন জসীম স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক।তাই ফাতেমাকে সাহায্য করেছে,আর জসীমকে সবসময় বুঝিয়েছে।তাই তাদের ডিভোর্সটা হয়নি।তাই তাদের এখন এক হতে কোন বাঁধাই হয়নি!

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত