একলা আকাশ

একলা আকাশ

এখন সকাল ন-টা সাঁইত্রিশ | দিনটা সোমবার | একে অফিস টাইম , তার ওপর মাসের এক তারিখ , ব্যান্ডেল লোকালে এই সময়টা প্রচন্ড ভিড় | লোক প্রায় ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে | পা রাখারও জায়গা নেই বিশেষ | তবে কি আর করা যাবে ! পেটের টানে ছোটাই তো কাজ | সে যতই ঘুম চোখ হোক , রবিবারের আলিস্যি শরীরে লেগে থাকুক , চাকরি তো সে কথা শুনবে না ! তাই সপ্তাহের প্রথম দিন ভোর ভোর উঠে স্রান সেরে কিছু একটা নাকে মুখে গুঁজে ঢুলতে ঢুলতে ছুটে চলার নামই জীবন ! এর মধ্যে বছর পঞ্চাশের সুবিনয়বাবু , যে ওই গেটের একটু আগে হাতল ঝুলে ঝুলছে ; সেই লোকটার আবার বাড়িতে খুব ঝামেলা | মেয়ের ডিভোর্স কেস চলছে প্রায় এক বছর ধরে | জীবনটা উকিল , কোর্ট এইসবের পিছনে টাকা ঢালতে ঢালতেই শেষ হয়ে গেলো ওনার | কি কুক্ষনে যে মেয়েকে ওই শয়তানটার সাথে সম্বন্ধ ঠিক করে বিয়ে দিয়েছিলো , কে জানে ! বাপরে বাপ্ | বাবাজীবন একেবারে ঘোল খাইয়ে রেখে দিলো ওদের | বিয়ের সময় তো এমন নেকা নেকা শান্ত চেহারা , যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না | ভোলাভালা ইঞ্জিনিয়ার | সে যে বাজার থেকে মাছ দরদাম করে কিনে রান্না করে লোকজনকেও খাইয়ে দিতে পারে , এটা সুবিনয়বাবু প্রথমে বিশেষ টের পায়নি | টের পেলো সেইদিন যেইদিন মেয়ে আর জামাইকে ফোনে পেলো না | মানে জামাই এর না কি লন্ডনে পোস্টিং হয়েছে কোম্পানি থেকে , এই বলে মেয়েকে ওনার কাছে রেখে দু মাস তার আর কোনো পাত্তা নেই | তারপর অফিস থেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায় সেই বাবাজীবন চাকরি ছেড়ে দু মাস আগেই চম্পট | তারপর অনেক খোঁজ খবর থানা পুলিশ করে অবশেষে তার হদিশ মেলে | সে এখন ব্যাঙ্গালোর নিবাসী তার গার্ল ফ্রেন্ডের সঙ্গে | আর এদিকে লন্ডন যাওয়ার নাম করে সুবিনয়বাবু মানে শ্বশুরের কাছ থেকেও প্রায় সাত লাখ টাকা খোসিয়েছিলো এই বলে যে ওনার মেয়ের জন্য না কি লন্ডনে থাকার ব্যবস্থা করে আসবে , মানে দুজনের থাকার মতন ছোট্ট একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া নেবে , অফিসের এপার্টমেন্টে না কি বৌ এলাও না | এইসব গল্প সাজিয়ে সেই কয়েক লাখ টাকাও এখন বাবাজীবনের পকেটে | সেই নিয়েই কেস চলছে দিনের পর দিন , মাসের পর মাস | উকিলের পেছনে টাকার শ্রাদ্ধ থেকে কোর্টে নানা রকম টেরা বেঁকা প্রশ্নের মধ্যে পরে হ্যারাসমেন্ট , এইসবের মাঝে যখন মেয়েটার বিদ্ধস্ত মুখটা দিনের শেষে চোখে দেখতে হয় , তখন মনে হয় একটা সপাটে চড় মারি ওই জামাইয়ের মুখে | কিন্তু মনে মনে হাতটা উঠেও থেমে যায় | কোর্টে প্রত্যেক মাসেই ওই বাঁদরটার , থুড়ি মানে বাবাজীবনের মুখোমুখি হলেও , সে তো ধরা ছোঁয়ার বাইরেই | আর গায়ে হাত তোলাও আবার একটা ক্রিমিনাল অফেন্স | যদি কোনো ধারা টারা লাগিয়ে আবার একটা উল্টো কেস দিয়ে দেয় ! ভেবেই মনে মনে আবার হাতটা নেমে যায় ওনার | আর না চাইতেও ওই শান্ত নিরীহ চেহারার মুখোশটা পরে জীবনটা বয়ে বেড়ান সুবিনয়বাবু |
তারপর ওই ট্রেনের চ্যানেলে কোনোমতে ঢুকে নিজেকে সামলে , নিজের ওই ভারী অফিস ব্যাগটাকে সামলে যেই মোটা মতন ভদ্রলোককে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামছে , উনি হলেন কমল হালদার | বাড়ি মানকুণ্ডু | তবে ওনার জীবনের সমস্যা আবার শ্বশুর | মানে সুবিনয়বাবুর কেসের ঠিক উল্টো | আসলে কম বয়সে নির্বুদ্ধিতায় , আর রিয়্যাল জীবনে হিরো সাজার একটা অদ্ভুত নেশায় কমলার সাথে প্রেমটা করে ফেলেছিলেন উনি | একেবারে যাকে বলে হোঁচট খেয়ে প্রেমে পরে গেছিলেন | কিন্তু তখন জানতেন না , কমলার বাবা হচ্ছে একজন ‘সুপারি কিলার’ | দাগি মাস্তান এলাকার | এলাকা মানে বাঁকুড়ার দিকের | ওই জন্যই কিছু না জেনে প্রেমটা করেছিল কমল | মানে মানকুণ্ডুতে কমলা নিজের মাসির বাড়ি ঘুরতে এসেছিলো পুজোতে | তারপর দুর্গাপুজোর মণ্ডপে চোখাচুখি হতেই কমল কে মন মে লাড্ডু ফুটা | তবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণে বোঝেননি উনি যে এটা আসলে লাড্ডু না , জীবনে এটম্ব বম্ব ফোটার ইনভিটেশন এসেছিলো | না , শ্বশুর প্রেম করে বিয়ে করতে আপত্তি করেনি কোনো | তবে বিয়ের রাতে একটা আলতো সাবধানবাণী দিয়ে রেখেছিলো , ” যদি কমলার চোখে কখনো জল আসে , তাহলে ওর জীবনে বন্যা বয়ে যাবে |” .. ব্যাস , আর বাকিটা বোঝাতে হয়নি | কমল ভালো স্টুডেন্ট | তারপর থেকেই সকালের চা থেকে রাতের ডিনার , মা কমলার অর্ডার মতন কমল রুটিং মেনে টাইমে টাইমে সব কাজ করে দেয় | কাল তো আবার রবিবার ছিল | মটন বিরিয়ানি , চিকেন চাপ , আমের চাটনি , এইসব মেনু না হলে কমলার দিনটা ঠিক জমে না ! তা ও কমল একবার মিনমিন করে বিয়ের প্রথম দিকে বলেছিলো , ” কোনো কাজের লোক রাখলে হয় না ? যে একটু রান্নার দিকটা দেখে নেবে |” …… তখন কমলা আব্দারের সুরে বলেছিলো , ——– ” আমার তো শুধু তোমার হাতের রান্না খেতেই ভালো লাগে , সোনা |” ……. তা ও কমল চেষ্টা করেছিল , আলতো স্বরে বলেছিলো , ” আমি চাকরি সামলে রোজ রোজ রান্না ! বুঝতেই তো পারছো |” …… কমলা তখন একটু আলতো হেসে উত্তর দিয়েছিলো , ……. ” না , বুঝতে পারলাম না | আমি যখন বলেছি আমি রোজ তোমারই হাতের রান্না খাবো, মানে তুমিই করবে | এর বেশি বুঝতে বোঝাতে ইচ্ছে করলে বাবাকে কল করছি , কথা বলে নাও |” ………. না , তারপর আর কোনো কথা বোঝানোর কথা ভাবেওনি কমল | বৌয়ের রাত দিনের কাজের লোকের ডিউটিতে ও আজ অব্দি ভালোই করে আসছে | তার সঙ্গে পার্ট টাইম অফিস | জীবনটা যেন চাপে চাপে চাঁপা সন্দেশ হয়ে গেছে | মাঝে মাঝে মনে হয় , ওই ওর ছোটবেলাকার রোল মডেল অমিতাভ বচ্চনের মতন একদিন কমলার বাবার সামনে গিয়ে আপাদমস্তক ঝেড়ে আসতে | কিন্তু তারপর ওনার মোটা গোঁফ , গোল রসগোল্লার মতন চেহারা , আর কোমরে ঝোলানো বন্দুকটার কথা মনে পড়লেই অমিতাভ বচ্চন হওয়ার ইচ্ছেটা কেমন ঘুঁচে যায় , তার বদলে রান্নার নুন , চিনি ঠিকঠাক হলো কি না , এই টেস্ট করতে করতেই জীবনটা কেটে যাচ্ছে আর কি !
যাই হোক , এই কমলবাবুর উল্টোদিকের সিটে বসে থাকা লোকটার নাম তমাল সেন | না , মানে তমালবাবু এখন ঠিক বসে নেই | তিন জন মোটা মোটা লোকের শেষে নিজের সরু শরীরটা কোনোমতে টিকিয়ে রেখেছেন আর কি ! ওনার জীবনটাও আসলে এরকমই | ওই তিন জনের সিটে কোনো রকমে ঠেলে ধাক্কে বসে থাকা চার নম্বর লোকটার মতনই | তোতলা হওয়াটাই যেন ওনার জীবনের সব থেকে বড়ো অভিশাপ | একে লোকজন আজকাল রাজধানী এক্সপ্রেসের স্পিডে ছুটছে | সেখানে ওনার লোকাল ট্রেনের মতন কথা ! দু মিনিট বাদে বাদেই স্টেশন এসে আটকে যায় | সেসব শোনার ধৈর্য আর কারই বা আছে ! তার ওপরে ঈশ্বরের কৃপায় শরীরটায় একেবারে লেডিজ ফিঙ্গার | গা এ আর গত্তি লাগলো না | কেউ ফুঁ দিলেই উড়িয়ে দিতে পারবে লোকটাকে | তাই তার কথা , তার অস্তিত্ব জগৎ সংসারে আর কত টুকুই বা থাকতে পারে ! অফিসে তো জুনিয়ার স্টাফ থেকে চাপরাশি , সবাই ওনাকে ডোন্ট কেয়ার | আর বাড়িতে ষোলো কলা পূর্ণ করে দেয় ছেলে | হ্যাঁ , বয়সে সে তোমালবাবুর অর্ধেক , কিন্তু পুষ্টি তার শরীরে একটু বেশিই লেগেছে | কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পরে , তবে দেখে মনে হবে কোনো ভদ্রলোক | তার ওপরে গলার আওয়াজটাও সেরকম ভারী | মানে টোটাল তোমালবাবুর অপোজিট | উনি যদি ব্যাংকের ডিপোজিট হন, তাহলে ছেলে হচ্ছে সুদসহ মোটা টাকার লোন | তাই বাবাকে সে পাত্তা দেয় না বললেই চলে | ক্লাস ইলিভেনেই আলমারির চাবি চুরি করে পঁয়তাল্লিশ হাজারের একটা বাইক কিনে নিয়েছে | আর এখন কাজ হলো সেটা ছোড়ে টোটো কোম্পানি হয়ে ঘুরে বেড়ানো | তার সঙ্গে চুলে জেল লাগিয়ে স্পাইক , মুখে গালাগালি , এইসব তো আছেই | আর বাবা যদি ভুল করেও কিছু বলতে আসে তাহলে তো হয়েই গেলো | মানে এই যেমন কালই কি একটা ব্যাপারে তমালবাবু মুখ খুলেছিলো … ” শো শো শোন বাবাই , যে যে যেটা করছিস , তার জ জ জন্য কিন্তু ভু ভু ভুগতে হবে সারা জীবন .. আর .. ” না , আর এগোতে না দিয়েই বাবাই সোনা গলার ভলিউম বাড়িয়ে থামিয়ে দিয়েছিলো বাবাকে | তার বেশ রোয়াব দেখিয়েই বলেছিলো , ———- ” বেশ করেছি পিঙ্কি কে পাড়ার মোড়ে দেখে গান গেয়েছি | ওকে আমার হেব্বি পছন্দ | আর তোমার মতন মালগাড়ি তো নোই , যে গান শেষ হতে হতে বছর ঘুরে যাবে | কিশোর কুমারের মতন গলা আমার | তুমি নিজের চরকায় তেল দাও , আমারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়ো না বুঝলে |”
কথাটা শেষ করেই বাবাই ঋত্বিক রোশনের মতন ঘরের থেকে বাইকের চাবিটা নিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছিলো ধুম থ্রি স্টাইলে | আর তমালবাবু ঘরের এক কোনায় চুপচাপ বসেছিল মীনা কুমারী স্টাইলে | মাঝে মাঝে মনে হয় এই চুপচাপ বসে থাকতে থাকতেই হয়তো কখনো মৃত্যু চলে আসবে চোখের সামনে | তখনও উঠে আটকানোর আগে চুপ করিয়ে দেবে সে | সারা জীবনের মতন | তবে যাই হোক , ওনার পাশে অনেকটা জায়গা দখল করে বসে থাকা হোমরা চোমরা লোকটা কিন্তু তমালবাবুর থেকে সাইজে আর স্বভাবে একেবারেই আলাদা | লোকটা এই চারজনের সিটে যেমন ছড়িয়ে বসেছে , সেইরকম জীবনের সব ব্যাপারেই একটু ছড়িয়ে , একটু এক্সট্রা জায়গা নিয়েই থাকতে পছন্দ করেন | ওনার নাম পরিতোষ মুখার্জি | সরকারি বড়ো আমলা | তবে বসগিরিটা অফিসে বাড়িতে সব জায়গায় খাটাতেই সব সময় পছন্দ করেন | ওনার বৌ , ওনার ছেলে তো ওনার ভয়ে তটস্থ থাকে যেন | মানে সকালের চা খবরের কাগজ থেকে রাতে ডিনার , সবই ওনার হাতের কাছে টাইমে চাই | তাই বৌ নামের কাজের লোকের যদি কখনো টাইমের এদিক ওদিক হয় তাহলেই চুলের মুঠিটা ধরে একটু ঝাঁকিয়ে দেয়া , খাট থেকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেয়া , হাতের কাছে পেপার ওয়েট থেকে কাঁটা চামচ যা পাবে সেটাকে ছুঁড়ে মারা , এসব ওনার নিত্য দিনের অভ্যাস | আর এই দৃশ্য দেখে মেয়েও বাবার থেকে শত হস্ত দূরেই থাকে দিনের পর দিন | আসলে এই সবার চোখে ওনাকে নিয়ে ‘ভয়’, ‘ত্রাস’ এই ব্যাপারটাকে বেশ এনজয় করেন পরিতোষবাবু | সেই জন্যই তো গরিব ঘরের মেয়ে বিয়ে করে এনেছিল | ওনার মতন আমলার ব্যাপারে পুলিশে কমপ্লেন কি , মুখ খুলে ‘হাঁ’ করারও যাতে সাহস না হয় কখনো | আর অফিসেও তাই | দাবড়ে , চেঁচিয়ে , হুঙ্কার দিই জীবনটা দিব্বি কেটে যাচ্ছে আর কি |
তো এই ভিড়ে দাঁড়ানো এরকম অনেক কমলবাবু , বিমলবাবু , নন্দীবাবুদের জীবনে এক একটা জার্নি চলছে এক নাগাড়ে | কারোর গাড়ি অনেক লেট্ এ চলছে , তো কারোর আবার বিফোর টাইমে স্টেশনে এরাইভ করার মতন অবস্থা , তো কারোর আবার গাড়ি এখনো প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়ে , গ্রিন সিগন্যাল আর পাচ্ছে না এগোনোর | তবে এই মুহূর্তে এই ভিড় ব্যান্ডেল লোকাল হাওড়া স্টেশনের কারশেডে পৌঁছনোর সিগন্যাল পেয়ে গেছে | তবে গাড়িটা এখন প্রত্যেকবারের মতন সব এনার্জি শেষ করে ধিকিয়ে ধিকিয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে | এই এক ! কারশেডে দাঁড়ানোর সময়টা যেন কারোরই কিছুতেই পার হতে চায় না | মনে হয় রসগোল্লা কেউ সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে , কিন্তু কিছুতেই খেতে দিচ্ছে না , এরকম একটা পরিস্থিতি | তো যাই হোক , এই মুহূর্তে কেউ শেষ বারের ঘুমটা আর একটু ভালোভাবে ঘুমিয়ে নিচ্ছে , তো কেউ নিজের অফিস ব্যাগটা ট্রেনের বাঙক থেকে নামিয়ে রেসে নামার জন্য রেডি হচ্ছে , যে গাড়িটা থামলেই সবার আগে ট্রেন থেকে লাফ মেরে নেমে এগিয়ে যেতে হবে ফার্স্ট হয়ে | আর ঠিক এই সময়েই ট্রেনের অলস সময়টাকে কাঁপিয়ে হঠাৎ একটা ‘চোর চোর’ চিৎকার উঠলো ব্যান্ডেল লোকালে | যারা ঘুমোচ্ছিলো তাদের ঘুম এই আওয়াজে হাওয়া | যারা দাঁড়িয়েছিল চ্যানেলে তারা আরো গেটের দিকে এগিয়ে এলো , আর যারা বসে ছিল তারা উঠে দাঁড়ালো | সামনে কি দৃশ্য চলছে সেটা দেখার এখন প্রত্যেকেরই একটা কৌতূহল | এই সময়েই একটা বছর পয়ঁতাল্লিশের লোক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললো , ” আমি হাতে না হাতে ধরেছি | এই ছেলেটা অনেক্ষন ধরেই আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল | আর একটু হলেই আমার পার্সটা নিয়ে হাওয়া হয়ে যাচ্ছিলো আর কি | কেমন লাগে বলুন ! দিনে দুপুরে ডাকাতি যাকে বলে | ইশ | কি মহা ধড়িবাজ ছেলে রে বাবা |” ……… কথাটা শুনে আসে পাশের লোকগুলোর এবার হো হো করে চেঁচিয়ে উঠলো | তাদের ভিড়ে ওই চোররূপী ছেলেটা এখন কুঁকড়ে | গায়ের জামা ধরে টানাটানি করে একটা হাত ছিঁড়ে গেছে ওর , বোতামগুলোও অর্ধেক খুলে গেছে এখন | তার মধ্যে দিয়েই অসংখ্য ফুটো হয় স্যান্ডো গেঞ্জিটা বেড়িয়ে আছে শরীরে | ওর হাতটা ধরেই ওকে এই চার পাঁচ মিনিটে কয়েক ঘা মারা হয়ে গেছে | তাই মুখের কাছে কালশিটের রঙের মতন লাল হয়ে রয়েছে , চুলটাও উস্কো খুস্কো | চোখ দুটো যেন অনেকদিন ঘুম না হয় নির্ঘুম আজ | তার মধ্যেই এইবার সরকারি অফিসের বড়ো আমলা পরিতোষবাবুর হঠাৎ ছেলেটাকে দেখে ওই হুঙ্কারটা দেয়ার ইচ্ছে হয়ে উঠলো কেমন | তাই উনি বেশ নড়ে চড়ে নিজের বড়ো শরীরটাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে ছেলেটার কলার ধরে চেঁচিয়ে উঠলো , —— ” এই ট্রেনের গেটে বাঁধুন এটাকে সবাই | প্রত্যেকে নামার আগে এই মালটার গালে একটা করে থাপ্পড় মেরে তবে নামবে | তারপর পুলিশের কাছে হ্যান্ড ওভার | চুরি করা জন্মের মতো ঘুচে যাবে এবার |” ….. কথাটা শুনে বেশ অনেক লোকই এবার আরো উত্তেজিত হয়ে গেলো যেন | ” ঠিক ঠিক ,” ” হোক বাঁধা” , ” মারা হোক এটাকে ” এইসব প্রতিবাদী ইনকালাব জিন্দাবাদের মতন শব্দে ট্রেনের কামরাটা গর্জে উঠলে মনে হয় এখন | আর তার মাঝে ছেলেটার করুন স্বর ” আমাকে মারবেন না | আমি আর করবো না কখনো | আমার কথাটা একটু শুনুন | আমাকে পুলিশের কাছে দেবেন না |” , এইসব কথাগুলো কোথায় একটা ঢেকে গেলো যেন | পরিতোষবাবুই তারপর লিডার সেজে ছেলেটার কলার ধরে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে ওকে ট্রেনের দরজার সামনেটায় নিয়ে এসে রডটার মধ্যে বাঁধলো জোড়ে | তার আগে অবশ্য একজন দায়িত্ব নিয়ে দড়িটা জোগাড় করে এসেছে | এবার এই কারশেডে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটার থেমে থাকা সময়টা সবার কাছেই বেশ ইন্টারেষ্টিং হয়ে উঠলো | চোর ধরার মতন এতো বড়ো কাজ করেছে বলে কথা ! যেটার জন্য কি না গোয়েন্দা , পুলিশ , কত কি লাগে ! আর তার ওপরে এই বাজারে যদি সত্যিই কারোর মানি ব্যাগটা হাওয়া হয়ে যায় , তাহলে তো আর নাজেহাল হওয়ার শেষ থাকবে না | এ.টি.এম কার্ড , ডেবিট কার্ড , আইডেন্টিটি কার্ড কত দরকারি জিনিসই তো থাকে ! না , এরকম কাজ যে করে তার মার্ খাওয়াটাই ঠিক | এই ভেবেই কামরার এক একজন এসে দরজায় বাঁধা ছেলেটার কখনো চুলের মুঠি ধরে টেনে দিলো , তো কখনো পিঠে , কখনো হাতে , কখনো গালে ভালো করে চড় থাপ্পড় বসিয়ে দিলো | এর মধ্যে সুবিনয়বাবুও আচমকা এসে ছেলেটাকে দুটো কষিয়ে চড় মারলো দু গালে | একে গরম, তার ওপরে ভিড় , রাগে এখন ওনার শরীরটাও কেমন গরম হয়ে গেছে | হঠাৎ মনে হচ্ছে ঐভাবে ট্রেনের দরজায় যদি কেউ ওনার জামাইটাকে বেঁধে বসিয়ে রাখতে পারতো তাহলে যে কি ভালো হতো | বার বার ভিড়ে ঠাসা মুখগুলোর মধ্যে সেই বাবাজীবনের মুখটা যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে ওনার , তাই রাগটা বেড়ে বেড়ে দ্বিগুন চারগুণ হয়ে যাচ্ছে | আর সেই সমস্ত রাগ গিয়েই উজাড় করে দিলেন উনি চোরটার গালে | জামাইকে তো আর এই জীবনে হয়তো থাপ্পড় মারার সুবর্ণ সুযোগটা পাওয়া হবে না | তার বদলে এই চোরটাই সই | কারোর ওপর তো রাগটা বার করা গেলো ! একই অবস্থা ওদিকে কোমলবাবুর ও | শ্বশুরের সামনে তো আর এই জীবনে অমিতাভ বচ্চন হওয়া গেলো না ! কিন্তু এই ভিড় ট্রেনেও কি তা বলে ভিজে বেড়াল সেজে বসে থাকবে ! একটা এতো বড়ো চোর সামনে , তাকেই নয় একটু নিজের এখন স্কিল দেখিয়ে আসা যাক | কথাটা মনে হতেই উনি ছেলেটার মাথার চুলের মুঠিটা ধরে বেশ কয়েকবার ঝাঁকিয়ে দিয়ে এলেন | এখন বেশ প্রাউড ফিল হচ্ছে নিজের ওপর | মনে হচ্ছে যদি কেউ একটু ভিডিওটা করে বৌকে দেখাতো , তাহলে হয়তো কথায় কথায় বাবার হুমকি শুনতে হতো না | এমন কি আমাদের গোবেচারা তোমালবাবুও আজ খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে | তোতলা বলে কি মানুষ না ! বাইরের লোক , নিজের ছেলে সবাই সারা জীবন অপমানই করে যাবে ! ও কখনো কাউকে কিছু ফেরত দেবে না ! এটা হয় না কি ! এসব ভেবেই চোরের পিঠে গিয়ে চার পাঁচটা গুম গুম করে ঘুষি মেরে এলো | ইশ , এরকমটা যদি কাল ছেলের পিঠে মারতো পারতো ! কথায় কথায় ওর ঋত্বিক রোশান সাজা বেরিয়ে যেত |
যাই হোক , এইভাবে প্রায় পঞ্চাশ ষাট জনের চড় থাপ্পড় ঘুষি খেয়ে দশ মিনিটের ভেতরে ট্রেন যখন প্ল্যাটফর্মে ঢুকলো তখন ওই আধ মরা ছেলেটাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হলো দায়িত্ব সহকারে | তখন অবশ্য চোর একেবারে নিস্তেজ | দাঁত ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে গালে | গায়ের জামা , ওই শতছিন্ন স্যান্ডো গেঞ্জি এখন পুরোপুরিই ছিন্ন | সারা শরীর জুড়ে লাল লাল কালশিটের দাগ ভর্তি | চুলগুলো এলোমেলো ছন্নছাড়া | একদম ওর জীবনটার মতন | আসলে একটা সময় ভেবেছিলো বি.কম পাশ করে কোনো বড়ো পোস্ট না হোক , গ্রূপ ডি পোস্টে একটা চাকরি ঠিক জুটিয়ে নেবে সত্য | তবে “বেকারের রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’ কথাটা বি.কম পাশ করে বুঝলো | ওর মতন হাজার হাজার গ্রাজুয়েট রোজ চাকরি খোঁজার লাইনে এসে ভিড় করে , সেখানে সেদিন থেকে আরেকটা নাম ও যুক্ত হলো , সত্য বসু | তার মধ্যেও দু চারটে টিউশনি করতো | কিন্তু তাতে আর কত টুকু কি হয় ! বড়ো জোর নিজের হাত খরচ | বাবা এর মধ্যে যেই কারখানায় চাকরি করতো সেটাও হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো | তারপর অভাবটা যেন হাত পা গজিয়ে আরো বেড়ে উঠলো দিন দিন | দু বেলা ঠিক করে ভাত জোটাই কেমন দুস্কর হয়ে গেলো সত্যর বাড়িতে | অনেক সময়ই রাতে ফ্যান খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস শুরু করতে হলো জীবনে | এই অব্দিও তাও কোনোভাবে জোর করে কষ্টে শিষ্টে চালিয়ে নিচ্ছিলো ওরা | কিন্তু তারপর কাল রাতে যখন হঠাৎ বাবা বিছানা থেকে উল্টে ঘরের মেঝেতে পরে গেলো , একদম বিনা নোটিশে যেন আকাশ ভেঙে পড়লো মাথায় | স্ট্রোক এটার্ক | এই রকম হঠাৎ করে এসে সব এলোমেলো করে দেয় রোগটা | সুস্থ বাবা চোখের সামনেই কেমন প্যারালাইসড হয়ে গেলো , হাত পা এর আঙ্গুল গুলো জোর করেও আর নাড়াতে পারছে না | মুখটা একদম বেঁকে গেছে | এই মুহূর্তে কয়েকটা ওষুধ খুব দরকার | হসপিটালে ফ্রি তে এখন শুধু মাটির নিচের প্লাস্টিকটা দেয় | বেডও পাওয়া যায় না | সেখানে ওষুধ তো মহার্ঘ্য | যত টুকু টাকা বাড়িতে জমানো ছিল, তারপর টিউশনের বাড়িগুলো থেকে এডভান্স নিয়ে শুধু অক্সিজেন আর স্যালাইনের খরচটা উঠেছে | কিন্তু ওষুধ ! সেটা যে আর কোনোভাবেই জোগাড় করতে পারছিলো না সত্য | কত আত্মীয়দের কাছে গেলো | পা এ পরে ভিক্ষা অব্দি চাইলো | কিন্তু কেউ স্বান্তনা ছাড়া ওকে কিছু ফেরত দিতে পারলো না | আবার কেউ কেউ তো সেটাও না দিয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো | এইসবের কি করবে , কি না করবে ভাবতে ভাবতে স্টেশনের সামনে এসেছিলো ও আনমনে | আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলো ভিড়ে ঠাসা ব্যান্ডেল লোকাল কে | কিছু না ভেবেই তারপর উঠে পড়েছিল ও | চোখের সামনে তখন শুধু বাবার মুখটা ভেসে উঠছিলো তখন | সব ঠিক ভুলের হিসেবে ছাড়িয়ে শুধু একটা মুখ | বাবার এখন নিশ্চই কষ্ট হচ্ছে খুব শ্বাস নিতে ! ওই হসপিটালের নোংরা মেঝেটায় পরে নিশ্চই চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে আসছে বার বার | মা একা বাবার পাশে বসে কি করছে এখন ! হাতপাখা দিয়ে সমানে হাওয়া দিয়ে যাওয়া ছাড়া তো মা আর কিছু করতে পারবে না | বাবাকে একা ফেলে তো কোথাও টাকার জোগাড়ও করতে যেতে পারবে না ! ওই হসপিটালের পুরোনো পুরোনো ছাদ , চুন ওঠা দেয়াল , ওষুধ ওষুধ গন্ধ , রোগের ভিড়ে কি বাবার চোখ এই মুহূর্তে সত্যকেই খুঁজছে ! নিশ্চই মনে হচ্ছে ছেলে ঠিক আসবে , সব কষ্ট দূর করার ওষুধ নিয়ে | কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেইদিন সত্য জীবনে প্রথম একজনের পকেটে হাত ঢুকিয়েছিল | ওর যে সেই সময় মনি ব্যাগটা খুব দরকার ছিল ! টাকার খুব দরকার ছিল | তবে কাঁচা হাতের কাজ তো | প্রথম চুরিতেই ধরা পরে গেলো | আর তারপর তো ! এই গল্পটা শুরু থেকে যারা যারা পড়ছে তারা এর পরের গল্পটা সবাই জানে | শুধু ওই ট্রেনের প্যাসেঞ্জারগুলোরই যা সত্যকে জানা হলো না | ওর কিছু বলার শোনার আগেই চোখ মুখ ফাটিয়ে চোর ধরার আনন্দে সবাই নিজের নিজের গন্তব্যের দিকে রওনা হয়ে গেলো | আর সত্য , কিছুদিন আগে গ্র্যাজুয়েট হওয়া ছেলেটা ‘চোর’ তকমা মাথায় নিয়ে প্রথম কোনো সরকারি ঘরে অফিসিয়ালি গেলো | লক আপে , বন্দি সেজে |
তবে সেইদিন সত্যর বাবা শেষ মুহূর্ত অব্দি অপেক্ষা করেছিল | যতক্ষণ চোখের সামনে সবটা অন্ধকার হয়ে আসে ততক্ষন | উনি আশা করছিলেন | সত্য ঠিক আসবে | ওষুধ ইনজেকশন সব নিয়ে ,মাত্র আর কিছুক্ষন | একটু সহ্য করে নিক | একটু জোর করে শ্বাস নিক | ঠিক ছেলে আসবে | সব বাঁধা পেরিয়ে | ওই ছোটবেলার মতন | দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে বাবা বাবা বলে | এখনো যেন আওয়াজটা বাজছে কানে ওনার| ওই শেষ মুহূর্তের আওয়াজ | সব অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আগে শোনা আওয়াজ | ছেলের গলা উনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন এই আবছা পৃথিবীতেও |
…………………………………………………………< সমাপ্ত >……………………………………………………….

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত