এক ফোঁটা জল

আজ সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ। উত্তর-পূর্ব দিকটা কালো করে আছে অনেক্ষণ। যেন মনে হচ্ছে দীর্ঘদিনের জমে থাকা অভিমান পুষছে কেউ । অথচ রোদের ঝলকানি তখনও কমেনি । ভাই বলতো, এরকম সময়ে নাকি শেয়াল-কুকুরের বিয়ে হয়। পাগল একটা ! ওর কথা মনে পড়তে, অজান্তেই ঠোঁটের কোনায় হাসি এলো আমার। বাবা-মাও ঘরে নেই ।তারা গেছেন বোলপুর ,টুসিদির বিয়েতে। দিদির বিয়েটা তিনবছর ধরে ঝুলে ছিল- আজ তার গায়ে হলুদ। খবরটা শুনেই খুব খুশি হয়েছিলাম । ইশশ , ভাইটা থাকলে যেতে পারতাম । ওকে ছাড়া সচরাচর বেড়োই না । ছয় মাস হয়ে গেলো, এখনও সে সময় পায়নি ঘরে ফেরার !এখনকার এই ইউনিভার্সিটি গুলোতে পড়াশোনাতো হয় লবডঙ্কা ,অথচ নিয়মের বাহার ষোলো আনা । এইসব ছাইপাশ ভাবতে ভাবতে , হঠাৎ পায়ে কিছু একটা এসে লাগলো । তুলে দেখি আমার আর ভাইয়ের ছেলেবেলার একটা ছবি । হাওয়ায় বইয়ের ভিতর থেকে উড়ে এসে পড়েছে । এখনও মনে আছে , সেদিনের কথা। ভাইয়ের খুব জ্বর ছিল , তবু কোল থেকে নামাই নি , সারাদিন রাত জাপ্টে ধরে ছিলাম । বাবা অফিস থেকে ফিরে আমাদের অজান্তেই , ছবিটা তুলেছিল। সত্যি !! বাইশ বছর আগের কথা ,এখনও সেদিনের স্মৃতি মনের পাতায় আজও জ্যান্ত ।ছবিটাকে বুকে নিয়ে ,সেই পুরোনো খেয়ালে কতক্ষণ যে আবিষ্ট ছিলাম, জানিনা । হঠাৎ ব্যালকোনির দরজাটা দুম করে পড়ল , বুকটা কেঁপে উঠেছে সঙ্গে সঙ্গে ! মনে হয় , বাইরে ঝড় শুরু হয়েছে । তার উপর লোডসেডিং । মনে মনে বললাম , যাকে বলে গোদের উপর বিষফোঁড়া ! দৌড়ে গেলাম দরজা দিতে – বাইরের পরিবেশটা কেমন যেন লাগলো , এত মন খারাপ করা আবহাওয়া আগে কখনও দেখিনি। দূরের নারকেল গাছটার পাশ দিয়ে উজ্জ্বল আলোর ছটা বেড়িয়েছে । অবশ্য সবকটা গাছের উপর দিয়েই মেঘলা দিনের নতুন আবরণ পড়েছে। ঝড়ের সাথে সাথে ঠান্ডা হাওয়াও বইছে – মনে হয় কোথাও বৃষ্টি পড়ছে ! কিংবা হতে পারে ,কোনো চেনা মুখ অজানা জায়গায় নিঃশব্দে কাঁদছে। অনেকক্ষণ বিষণ্ণভাবে আনমনে তাকিয়ে আছি এই কালিমালিপ্ত আকাশটার দিকে । মনে হচ্ছে এই বিশালতায় আমি শূণ্য , আমি তুচ্ছ- দেখতে দেখতেই রোদের যেটুকু অংশ তার শেষ নিঃশ্বাস গুনছিল , এক টুকরো কালো মেঘ সবটা গ্রাস করে নিলো । এইমাত্র তো আলো ছিল , চোখের নিমেষে সমস্ত আকাশটা তমসাবৃত হয়ে গেলো ।কিন্তু কোথাও একটা জানি মনে হলো , মনের অনেক গভীরে এই বিরাট আকাশটা তার পূর্ণ তমশা নিয়ে আমার বুকেই জায়গা করে নিয়েছে। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে , জানলার পাশে এসে বসলাম । ঝড়ের এরূপ তৎপরতা দেখতে দেখতে নিজের মনটাই উথাল পাতাল হয়ে উঠছিল ।এবার শুরু হলো প্রচন্ড বৃষ্টি , বজ্র বিদ্যুৎ তো বৃষ্টিনুগামীই। এত সুন্দর আবহাওয়ায় ভাবলাম , কবিতা লিখলে কেমন হয় ! অবশ্য যারা লিখতে ভালোবাসে , তারা বৃষ্টির দিনে একটু হলেও কাব্য করবে না বা কবিতা লিখবে না , সেটা সোনার পাথর বাটির মতোই অলীক । সাজ সরঞ্জাম নিয়ে বসলাম , রোমান্টিক কবিতা লিখবো বলে; কিন্তু না! কিছুতেই আজ আর লেখা আসছে না । জানিনা কেন প্রিয়তোষের কথা খুব মনে পড়ছে । এই প্রিয়তোষই আমার একমাত্র আদরের ভাই – প্যারাসাইকোলজি নিয়ে কোলকাতায় পড়াশোনা করছে ।খানিক্ষণের জন্য চোখের পাতাটা বন্ধ হতেই , আবার পুরোনো স্মৃতিগুলো , হারিয়ে যাওয়া নাছোর যত ছবি ভেসে উঠল চোখের মাঝে। হাতটা জানলার শিকের মধ্যে দিয়ে বাইরে রেখে , মাথাটা হাতের উপর এলিয়ে দিয়েছিলাম। এক ফোঁটা বৃষ্টির জল , আইভি লতার পাতা বেয়ে হাতের উপর টপ করে এসে পড়লো – একদৃষ্টে আনমনেই তাকালাম । বুঝতে পারছি না , এমন কিছু একটা যেটা আমি অনুভব করতে পারছি , অথচ আমার কাছে সেটা অধরা । চোখের সামনে গাছ থেকে টপটপ করে জলের ফোঁটা অনবরত পড়েই চলেছে । এই আবহাওয়া , জলের চুইয়ে পড়া সবকটা ঘটনা দেখে আমার কিসের যে এত অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছিল তার কারণ ছিল , তখনও অজানা । ভাবতে ভাবতে ভাবনার অতল গভীরে ডুব দিয়েছি, – দরজা খোলার আওয়াজে চমক ভাঙলো, পিছন ফিরে তাকাতেই দ্বিতীয় চমক । যেন ভূত দেখছি ।

“তুই,এখানে!! কখন এলি ? নিচের দরজা তো বন্ধ ছিল।” রক্তাক্ত বিধস্ত অবস্থায় প্রিয়তোষ আমার দিকে করুণ চোখে চেয়ে আছে ”একিই অবস্থা হয়েছে তোর? এত রক্ত। বাইরে এত বৃষ্টি হচ্ছে তবু তুই ভিজিস নি ! এলি কিসে ? একবার ফোন করে তো জানাতে পারতি !” একটার পর একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম ওর দিকে। তবু সে নিরুত্তর ।চারিদিক নিস্তব্ধ -নিরব । বৃষ্টির শব্দও কানে আসছে না । হঠাৎ আমার ভাইয়ের মিষ্টি গলার দিদি ডাক , যা শুনে একদিন আমি থাকতে পারতাম না , ছুটে আসতাম ওর কাছে , সেই ডাক শুনলাম । ধীর , শান্ত অথচ বেদনাহত একটা আওয়াজ নিয়ে প্রিয়তোষ বলে উঠলো – ”দিদি তোর মুখখানা কি সুন্দর দেখাচ্ছে । কতদিন দেখিনি অমন মিষ্টি মুখ ।” মাথায় প্রচন্ড রাগ উঠে গেল , একে এত রক্ত দেখে আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা , তার উপর এরকম নিরুত্তাপ প্রতিক্রিয়াহীন কথা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না । ” ন্যাকামো ছাড় । আগে বল, এই অবস্থা কিভাবে হল ? রাস্তায় কি কিছু ঘটেছে?’ আমার মনে তখন হাজার প্রশ্নের জট ।

-চুপ কর দিদিভাই । চুপ কর। আর প্রশ্ন করিস না । শুধু তোকে একবার দেখার ইচ্ছা ছিল , চলে এলাম । দেখে নিতে দে ,মন ভরে , জানি না আর কোনোদিনও দেখতে পাবো কিনা । হাতে বেশি সময়ও নেই । অনেকদূর যেতে হবে যে। শুধু তোকে না দেখে যে ছেড়ে যেতে পারছিলাম না ।
– এই অবস্থায় তোকে কোথাও যেতে দেবোনা আমি ।
জোরে হেসে উঠলো প্রিয়তোষ ।রীতিমতো অট্টহাস্য । শুধু বলল- ‘ আমাকে যে আর কেউ বেঁধে রাখতে পারবে না কখনও ।’
– আমি পারব।
– পারা না পারার অঙ্কগুলো অত সহজ যে নয় রে দিদিভাই ।
ঐ অবস্থায় দাঁড়িয়ে ওরম দার্শনিকতা আমার মাথায় ঢুকছিলোনা । আমি দৌড়ে নিচে যাবো ওষুধ আনতে , এমন সময়ে ও আমার হাতটা টেনে ধরলো । কিন্তু সেই স্পর্শ , বরফের চেয়েও ঠান্ডা , শিথিল। পিছনে ফিরে ওর চোখটা লক্ষ্য করলাম , মনে হল , কত না-বলা কথা, কত না-ব্যক্ত করা যন্ত্রণা আবদ্ধ হয়ে রয়েছে ঐ চোখে । যে চোখে একদিন ছিল , কিছু করে দেখানোর উদ্যম, আনন্দ- উৎফুল্লতা। তা আজ ম্লান হয়ে গেছে । আস্তে আস্তে আমাকে বললো -‘ ভালো থাকিস দিদিভাই। মাকে ভালো রাখিস । আমি যদি আর না ফিরি চিন্তা করিসনা । আমার দায়িত্বটা আজ বাবা নিল , মায়েরটা না হয় তুইই নিস । কথার এরকম অসামঞ্জস্যতা দেখে আমার বলার কোনো ভাষা ছিল না । নিচের ঘরের টেলিফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো – ক্রিং ক্রিং … ক্রিং ক্রিং… আমি ওর হাতের বাঁধন ছেড়ে দৌড়ে নিচে গেলাম। ফোন তুলতেই এক অজানা গম্ভীর কন্ঠস্বর আমাকে প্রশ্ন করল – ” এটাকি প্রিয়তোষ সাহার বাড়ি ? ”
– হ্যাঁ, বলুন ।
-আপনাদের জন্য একটা খারাপ খবর আছে । কিছুক্ষণ আগেই একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রিয়তোষ সাহার মৃত্যু হয়েছে । যে গাড়ির সাথে সংঘর্ষ হয়েছে ,সেই গাড়ি চালককে এখনও অবধি শনাক্ত করতে পারা যায়নি। তিনিও স্পট ডেড।যতদূর জানা গেছে , ব্রেকফেল হওয়ায়,দুর্ঘটনাটি ঘটে। মৃতদেহ এখানকার স্থানীয় সরকারী হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে । আপনারা যথাসম্ভম তাড়াতাড়ি এসে দেহটি নিয়ে।

ফোন রেখেই দৌঁড়ালাম ছাদের ঘরে । এসে দেখি – শূন্য ঘর , শূন্য বারান্দা । আমার কবিতা লেখা কাগজগুলো ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে । বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে । একটা ছোট্ট চিরকুট হাতের মুঠোয় কতক্ষণ যে রাখা ছিল জানা নেই । কেই বা দিলো তাও অজানা । খুলো দেখলাম একটা ছোট্ট কবিতা –
”নীল আকাশে আজ ধূসর মেঘ
খামখেয়ালি এ বৃষ্টি
আমাদের কথা পড়লে মনে
জানলায় রেখো দৃষ্টি ।
-ইতি প্রিয়তোষ।”

অবস, ক্লান্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গে জড় বস্তু হয়ে বসে থাকাকালীন পরবর্তী দুই মিনিটে ঠিক দুটো ফোন এলো । প্রথম ফোন মায়ের , বাবা প্রিয়তোষকে আনতে গেছে কোলকাতাতে। শুনে ফোনটাকে কেটে দিলাম। দ্বিতীয় ফোন , সেই অজানা কন্ঠস্বরের – দুর্ঘটনায় মৃত অপর ব্যক্তির গাড়ির নং – WB 4013 777 ।দুই অপ্রাসঙ্গিক ঘটনার মিলন কি সত্যিই এতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে? হঠাৎ কানে এলো একফোঁটা জলের আওয়াজ , যা আমার চোখ থেকে হাতের উপর পড়ে , সমস্ত ভাবনা গুলোকে আবার চুড়মার করে দিল । বাবার সাধের গাড়ির নং টা একই ছিল….

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত