ভবিষ্যদ্বাণী

ভবিষ্যদ্বাণী

নায়নাকে আমি প্রথম দেখি ভার্চুয়ালে। অনলাইন জগতে ভিডিও কলের মাধ্যমে তার সাথে কনভার্সেশন শুরু হয়। পরিচয়ের সূত্রটা ফেসবুক থেকে। যেদিন ওকে সামনাসামনি দেখি সেদিন সে আমাকে চিনতে না পারলেও আমি ঠিকই চিনে ফেলি। আমি একটি অনলাইন পত্রিকার সিনিয়র সাব এডিটর। দিলকুশায় আমার অফিস। সেদিন অফিসের কাছাকাছি আসতেই নায়নাকে দেখে ফেলি। অতঃপর এগিয়ে যাওয়া, তারপর আলাপন।
.
“কেমন আছো নায়না?”
নায়না তাকালো আমার দিকে। সানগ্লাসে তার চোখ ঢাকা থাকায় বুঝতে পারিনি তার অভিব্যক্তিটা কেমন ছিল।
“কে আপনি?”
“তোমার মনের খুব কাছাকাছি একজন।”
“ও বুঝেছি… মাহতাব। হেয়ালী করে কথা বলার স্টাইলটা এখনও আছে দেখছি।”
“তা তুমি এখানে?”
“বয়ফ্রেন্ডের জন্য অপেক্ষা করছি।”
.
একটু নিভে যেতে হল। আমি জানতাম না তার বয়ফ্রেন্ড আছে, যদিও আমাদের মধ্যে যাবতীয় সব ব্যক্তিগত ব্যাপার শেয়ার হয়ে থাকে। আমি স্মিত হেসে বলি, “ও আচ্ছা।”
.
কথা প্রসঙ্গে নিজেদের ফোন নাম্বারসহ বাড়ির ঠিকানা বিনিময় করি আমরা। তারপর বিদায় নিয়ে চলে যাই আমি। ভেবেছিলাম, নায়নার সাথে দেখা হওয়া প্রথম মুহূর্তটা কত না রঙিন হবে। সময় চুরি করে দুজনে ঘুরব ফিরব আর দিনটাকে দশ মিনিটের টাইম ডাইলেশনে কনভার্ট করে ফেলব। কিন্তু সময়টায় এই মুহূর্তে বেবাগী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেলিগেটদের সঙ্গে লাঞ্চ, ডিনার করেও সময় কাটানো গেল না। রাত করে বাড়ি ফেরার পথে রিসিপশনের যারিন নোশিনের শরণাপন্ন হলাম। স্লাইডিং ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সে তাকালো। আমি বললাম, “রাইয়ান এসেছিল আজ?”
“না স্যার।”
একটু দ্বিধান্বিত হলাম। ক’দিন ধরেই অফিসে রাইয়ান খুব উৎপাত করছিল। একটা চাকরী ওর ভীষণ প্রয়োজন। বলছিল প্রুফরিডার, কম্পোজিটরের কাজ হলেও নাকি চলবে ওর। আমি আশ্বাস দিয়েছিলাম মোটামুটি কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু তার অনুপস্থিতি সে সুযোগ আর দিলো না।
.
ফেরার পথে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রাইয়ানের বাড়িমুখো রওনা হলাম। ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সামান্য মিস্ট্রি আছে ওর মধ্যে। সামান্য নয়, অনেকখানিই আছে। অ্যাস্ট্রোলজিতে বেশ দখল আছে, এ বিষয়ে ব্যাপক পড়াশুনা করেছে সে। একবার আমি বলেছিলাম, “মিঃ পামিস্ট, আমার হাতটা দেখে দে তো।”
.
সে যেমন সহজভাবে হাত দেখতে শুরু করেছিল হাতের রেখায় দেখা ভবিষ্যৎ চিহ্নিত করে ততটা সহজ রইতে পারলো না। বিদ্যুৎস্পৃহের গতিতে আমার হাত ছাড়িয়ে নিলো। কারণ জিজ্ঞেস করলে কিছু বলতে চাইছিল না। অনেক জোর জবরদস্তির পর বলল, “আমি তোর ওপর দ্রুত ধেয়ে আসা অবধারিত মৃত্যুকে দেখেছি। তুই যাকে ভালবাসিস তার হাতেই তোর মৃত্যু হবে।”
.
সেদিন আমি কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলাম। আজও হাসি পেল।
.
রাইয়ানকে তার বাড়িতে পাওয়া গেল না। অতঃপর বাসায় ফিরে যখন ঘুমাতে গেলাম তখন আবিষ্কার করলাম ঘুম নেই দু’চোখে। বিড়ম্বনাকে হারাম করতে সিগারেট ধরিয়ে নিকোটিনের বিলাসীতায় ডুবলাম। এভাবে কিছুক্ষণ পার হল। অবচেতনভাবেই তখন নায়না আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আমাদের সম্পর্কে তো তেমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। তাই কালবিলম্ব না করেই রাতের বেলাতেই তাকে ফোন দিলাম।
.
“হ্যালো।”
“হুম মাহতাব, ঘুমাওনি কেন এখনও?”
“আমি ঘুমাই না।”
“ভেরী ব্যাড। না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে।”
“হু কেয়ারস?”
“ইউ মাইট বী সেন্টিমেন্টাল, ওকে?”
“নায়না আমি…।”
“কী হল? বলে ফেলো।”
“আমি তোমার সঙ্গে আগামীকাল দেখা করতে চাই।”
“এটা বলতে এত সংকোচ কেন?”
“দ্বিধা সংকোচের ব্যাপার নয়, অন্যকিছু।”
“ও আচ্ছা। এতকিছু বোঝার সময় তো নেই। ঘুম পেয়েছে, ঘুমাবো। সো রাখি? বাই।”
“বাই।”
.
পরদিন আমাদের দেখা হল না।
.
যখন রমনা পার্কে রওনা দিই তখন আকস্মিকভাবে আমার গাড়ির সামনে একজন মানুষ এসে পড়ে। সজোরে আঘাত পেয়ে সে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে। গাড়ি থেকে নামলাম আমি। মুখ থুবড়ে পড়া মানুষটিকে দেখে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না। দেখি, রাস্তার বুকে পড়ে আছে রাইয়ানের নিশ্চল দেহ। তার শরীর থেকে বয়ে যাচ্ছে রক্তের স্রোতধারা।
.
পনেরো দিন পর…
.
ভার্চুয়ালে ভিডিও কলের মাধ্যমে নায়নাকে নক করলাম। পনেরোদিন গত হয়েছে, এরমধ্যে আমাদের মাঝে কোনো যোগাযোগ ছিল না। নায়নাকে আজ ভীষণ শোকাহত দেখাচ্ছে। মুখের একহারা গড়নের ওপর নেমে এসেছে যেন শোকের ছায়া। সে-ই কথা শুরু করলো।
.
“কেমন আছো?”
“ভাল না। আমার একজন বন্ধু কিছুদিন আগে মারা গেছে।”
“জানো, আমার বয়ফ্রেন্ডও কিছুদিন আগে মারা গেছে।”
“খুবই দুঃখজনক।”
“মৃত্যুর আগে ওর মনোবাঞ্ছাটাও পূরণ হল না।”
“কী সেটা?”
“কিছু না।”
.
নায়না এটা বলেই কনভার্সেশন বন্ধ করলো। তার বর্তমান মানসিক অবস্থার প্রেক্ষিতে এমন আচরণ স্বাভাবিক ধরে নিয়ে কিছু মনে করলাম না। এভাবে কিছুদিন যাবার পর নায়না একদিন ফোন করে বলল, “আজ কি দেখা করতে পারবে?”
আমি ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও বলি, “সিওর।”
“এটাই হয়তো তোমার সাথে আমার শেষ দেখা।”
.
এই বলে সে ফোন রাখলো। আমি তার কথা শুনে রহস্যের গন্ধ পেলাম। কিছু একটা ঘটতে চলেছে। কী সেটা?
.
নায়না যেখানে আসতে বলেছে সে জায়গাটা ভীষণ নিরিবিলি। দিনের আলো তখন নিভে যেতে শুরু করেছে। গোধূলির আবির্ভাবে পৃথিবী তার অপরূপ সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ঠিক এমন সময় নায়না জিজ্ঞেস করলো, “রাইয়ান কে ছিল?”
“তুমি ওকে চিনতে নাকি?”
সে আবারও বলল, “কে ছিল রাইয়ান?”
“আমার বন্ধু।”
“শুধু তোমার বন্ধু নয়, ও ছিল আমার বয়ফ্রেন্ড।”
.
খুব চড়াগলায় কথাটি বলল নায়না। তারপর আচমকা রিভলভার বার করে বলল, “রাইয়ানকে তুমি খুন করেছো। আজ তার জন্য তোমাকে মরতে হবে।”
.
নায়নার মুখের কথায় হৃদয়ের গভীর থেকে একটা ক্ষত সাড়া দিয়ে উঠলো। ক্ষতের আঘাত নিয়ে বলতে মন চাইছিল, “ভালবাসি।” কিন্তু বিপরীত পরিস্থিতিতে এরচেয়ে হাস্যকর কথা আর কী হতে পারে? নায়নার হাতের আঙুল এখন রিভলভারের ট্রিগারের ওপর। যে সামান্য ট্রিগারের ওপর নির্ভর করছে আমার জীবন-মরণ। মৃত্যুর অপেক্ষা নিয়ে নায়নার চোখে চোখ রেখে ক্ষণিকের সময়টাকে অনন্তকালের স্বর্গরূপে দেখতে পেলাম।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত