শুক্কুর আলীর হালচাল

শুক্কুর আলীর হালচাল

বিয়ের সুবাদে ব্যবসায় জড়িয়ে শেষ পর্যন্ত শহরেই থেকে গেলো শুক্কুর আলী। এখন সে শহরের নামকরা দর্জি । তার দোকানের নাম শতাব্দী টেইলার্স। রুচিসম্পন্ন এবং আধুনিক টেইলার্স বটে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় পসার জমেছে ভালোই। আর উপার্জন ভালো বলে তার ঘরের জৌলুষ বেড়েছে অনেক গুনে। সেই সুযোগে তার অশিক্ষিতা বউ আধুনিক কালচারের সাথে নিজকে খাপ খাওয়াতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে। শুক্কুর আলী মনে প্রাণে চায় তার স্ত্রী আধুনিকা হোক এবং দামী সেন্টের সুবাসে দেহ থেকে অশিক্ষিতের গন্ধটা দুর করে ফেলুক। লাই পেয়ে স্ত্রী পার্লারে যেয়ে মুখে রঙ মেখে বন্ধু বান্ধবের সাথে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ায়। এসব দেখে মোটা চামড়ার শুক্কুর আলী নাখোশ হলেও খুব একটা রেগে যায়না। বড়লোকের আড্ডাবাজ পোলাপানের সাথে গুলতানি না মারলে মডার্ণ হওয়ায় ছবক সে পাবে কোথায়। পীরভক্ত পিতার একমাত্র ছেলে হয়ে সে বেপর্দা বউকে নিয়ে মজাছে দিন কাটায়। একটা ধারণা তার মনে কাঠের সিড়ির মতো পোক্ত হয়েছে যে পরের খেতের ফসল তছরুপ না করলে পালের গরু মহিষ তাগড়া হয়না। হলে আসা সব নতুন ছবির খোঁজ রাখে স্বপ্না । সিনেমার হিরো, বিশেষ করে বোম্বের নামকরা হিরোর  প্রতি তার তীক্ষè নজর। তারা কি খায় কিভাবে চলে তা সে পাই টু পাই খবর রাখে সে। তাদের প্রতিটি ডায়লগ সে বাইবেলের শ্লোকের মতো মুখস্ত করে ফেলে। সংসারের যে কোন সমস্যায় সিনেমার কাহিনী হতে মীমাংসা খুঁজে নেয়ার বিষয়ে সে দারুণ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। স্বপ্নার একটাই কষ্ট শুক্কুরের এসব বিষয়ে মোটেই আগ্রহ নেই। কাষ্টমারের বেসাইজ কাপড় কেটে কুটে, ছোট্ট খুপড়ির একঘেয়েমীর মধ্যে যে দিন কাটায় তার মাথায় কি থাকতে পারে। দেশ বিদেশের বড় বড় লেখক আর পরিচালকেরা মেধা খরচ করে যেসব মুল্যবান ফিল্ম তৈরী করে তা দেখা শুক্কুরের ভাগ্যে কোনদিন হয়না। না হয় হোক, কিন্তু স্বপ্না যে চুনে চুনে বিভিন্ন ডকুমেন্ট থেকে মণিমুক্তার মতো যেসব দামী বিষয় তুলে আনছে তা যদি সে একটিবার মুখে তুলে চেখে দেখতো তাহলে স্বীকার করতে বাধ্য হতো স্বপ্না তার যোগ্য গৃহিণী বটে। এসব নিয়ে স্বপ্না বেশি বাড়াবাড়ি করলে শুক্কুর রেকর্ড প্লেয়ারে ফুল ভলিউমে মান্নাদের গান শোনে। না হয়  সিগারেট জ্বালিয়ে মনের সুখে টানতে থাকে। আর এই সুযোগে প্রাত্যহিক খরচের হিসেবটাও স্বপ্নার কাছে চেয়ে বসে। কোথায় ফিল্মের স্বপ্নের ভুবন আর আর কোথায় বাজার খরচের খটখটে হিসেব। মুহুর্তে স্বপ্নার মনটা ফুটো বেলুনের মতো ফুস্ করে চুপসে যায়। মুখে মুখে বাজারের হিসেব মিলানোর বিরক্তিকর কাজের চেয়ে ঠুনকো অভিমানে গাল ফুলিয়ে থাকাকেই স্বস্তিকর মনে করে সে। হায় বেরসিক শুক্কুর আলী! নারী হৃদয়ে লতিয়ে ওঠা কোমল রঙিন লতা তুমি যদি ভালো করে দেখতে পেতে। তবে তোমার গৃহ রণক্ষেত্রে পরিণত হতোনা। স্বপ্না তোমার রান্নার কাজে নিয়োজিতা বউ শুধু নয়, তোমার স্বার্থক উপদেষ্টা এবং সুযোগ্যা সংস্কৃতিমন্ত্রীও বটে। তোমার যদি রুচিবোধ থাকতো তা হলে তার সুমিষ্ট সংসর্গ ছেড়ে টেইলার্সের বদ্ধঘরে জীবন পয়মাল করতে না।

বাসার মোবাইল ফোন নেয়ার কারণে দিনে বেশ কয়েকবার স্বপ্নার সাথে শুক্কুরের কথা হয়। কথা বলার ইচ্ছে স্বপ্নারই বেশি। এই শহরে স্বপ্নার কতোজন খালু আর খালা আছে তার হদিছ এখনও করতে পারলো না শুক্কুর আলী। এখন পর্যন্ত খালু শ্বশুড়দের বাড়িতে দাওয়াত খাওয়ার সৌভাগ্য তার না হলেও তাদের আপ্যায়নে খরচ করতে হচ্ছে কাড়ি কাড়ি টাকা। হঠাৎ মোবাইল তুলে স্বপ্না কলকলিয়ে ওঠে-
‘ওগো শুনছো।’
‘বলো কি হয়েছে?’
‘ময়না খালা এসেছে।’
‘কোন ময়না খালা?’
‘কোন ময়না খালা আবার। একদিন যে বললাম। সেই ময়না খালা। খালুও এসেছে সাথে।’
‘কি খেতে দিয়েছো?’
‘কি খেতে দেবো। কিছুই তো নেই। নুডলস্ আর চা দিয়েছি।’
‘ভাত খাবে নাকি? কি বলে, দেরী করবে?’
এসব উটকো আত্মীয়ের কথায় খুব খারাপ লাগে শুক্কুরের। বাসায় নাস্তার উপকরণ দু’দিনও থাকেনা। এ এসেছে ও এসেছে বলে স্বপ্না মাথা খারাপ করে । কোথাকার ময়না খালা। তিনটে ছেলে দু’দিন থেকে কাজে আসছে না। সামনে ঈদ। সময়মতো মাল ডেলিভেরী দেয়া যাচ্ছেনা। আর ওদিকে খালা খালু দুলাভাইয়ের ¯্রােত বয়ে যাচ্ছে।
‘কি ব্যাপার। কল কেটে দিলে যে?’
‘দোকানে কেউ নেই। কাজের চাপ।’
‘কাষ্টমার নিয়ে থাকো। কি রাঁধবো?’
‘ফ্রিজে মাছ আছেনা?’
‘শুধু মাছ দিয়ে? কি যে বলো। তোমার বাসায় এসেছে মাছ খেতে?’
‘আচ্ছা চাল বসাও। দেখছি।’
‘চাল থাকলে তো। ক’দিন থেকে বলছি ?’
‘কয়টা আইটেম করবে?’
‘কমপক্ষে পাঁচটা না করলে কেমন হয়।’
‘রাখো পাঁচটা। ডালমাংসে চালিয়ে দাও।’

বেশ কাজ পড়ে আছে। এর মধ্যে বাজার করে বাড়ি পাঠাতে হবে। পরিচিত রিকসা না পেলে বাজার পাঠানো মুশকিল। একসাথে এতো সমস্যা সামাল দেয়া বড় কষ্ট। শুক্কুর আলী হাঁপিয়ে ওঠে। দু’টো কোট আর গোটা পাচেক প্যান্টের কাপড় কেটে না দিলে কর্মচারী বসে থাকবে। জোরে হাত চালায় শুক্কুর আলী। কাচিতে শান দেয়া হয়নি। বিকেলে শানের  লোক এসে কাচি নিয়ে যাওয়ার কথা। আবার মোবাইল আসে স্বপ্নার।
‘হ্যালো, তুমি কোথায়?’
‘কোথায় মানে? কাপড় কাটছি।’
‘বাজার যাওনি?’
‘এই তো। মাত্র কয়টা কাপড়।’
‘রান্না করবোনা। খালা কি বলে জান? মার্কেটে যাবে।’
‘রাখো তো। এতো টেনশনে মার্কেট।’
‘রাখো মানে। খালাকে কিছু দেবোনা?’
‘মন চায় দাও। শোন দুপুরে আমার একখানে দাওয়াত আছে।’

রাতে বিছানায় শুয়ে সস্তা অভিমানে চাঙর হয়ে থাকে স্বপ্না। শুক্কুর আলী দোকান থেকে দুপুরে বাসায় আসেনি বলে না খেয়েই চলে গেছে খালা। এতোদিন পর কতো আশা করে এসেছে। ভালো দেখে একখানা কুষ্টিয়ার শাড়ি যদি দিতে পারতো স্বপ্না, তাহলে তার মুখ কতো উচা হতো। মুখটা রাখলো না শুক্কুর আলী। সবার সামনে স্বামীকে নিয়ে কতো গর্ব করে বেড়ায় সে । আজ সব গর্ব পানি হয়ে গেলো। খালার ইচ্ছে ছিলো মার্কেট শেষে ওকে নিয়ে মেডিনী শোতে যাবে। পুর্বাশায় যে বোম্বের ‘ক্যায়সে ইয়াদ রাখনা’ চলছে তা খালা জেনেই এসেছে। আহ্! কতো দারুণ একখানা ছবি। শুক্কুরের গোয়ার্তুমির কারণে এতোবড় প্লানটা নষ্ট হয়ে গেলো। এটা মেনে নেয়া স্বপ্নার পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। ভালোবাসার জন্য মানুষ জীবন দিচ্ছে আর তার স্বামী মেতে আছে কাষ্টমার নিয়ে। সে কাষ্টমার নিয়ে মেতে থাক কিন্তু স্বপ্নার কুসুমিত প্রেমের মধু সে কোনদিন পান করতে পারবে না।

দোকানের ব্যস্ততা সামাল দিয়ে বাসায় এসে ভাত মুখে দিতেই শুক্কুর আলী ঘুমে ঢলে পড়ে। স্বপ্নার মনটাকে সে মাজতে যায়না। শুক্কুর আলী তো অর্থের কাঙ্গাল। প্রেমের কাঙ্গাল সে তো নয়। স্বপ্না তার প্রেমহীন আচরণের জন্য ব্যথিত হয় এবং অবোধ শিশুর মতো বালিশ বুকে চেপে কান্না শুরু করে। কান্নার শব্দে শুক্কুরের ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে রেগে যায়। বন্ধুদের নিয়ে ধুমধাড়াক্কা মারপিট আর সাপবিচ্ছুর ছবি দেখতে যাবে আর এখন কান্না করলে থামাবে কে। কাছে কোন কান্ডুকার ফকির আছে যে ডেকে এনে ঝাঁড়ফুক করাবে। সে স্বপ্নাকে একটু সমঝায়, মানে শরীরে ঘুমের ধান্দায় হালকা করে হাত বুলিয়ে দেয়। কিন্তু স্বপ্না যে রকম মেজাজ করে আছে তাকে সামলাতে মনোরঞ্জনের যে সব সস্তা প্রাকটিস করা দরকার তা সে করেনা। তার নরম ঠোঁটে চুম্বনের স্পর্শ দিয়ে নায়কী কায়দায় মাই লাভ জাতীয় সম্বোধন করে মান ভাঙ্গানোর কোশেশ সে করেনা। বরং রাতদুপুরে মারদাঙ্গা মস্তানের মতো স্ত্রীর কোমড়ে একখানা বেখাপ্পা লাথি কষে দেয়। রাগে ক্ষোভে বেসামাল হয়ে স্বপ্না শয্যা ছেড়ে অন্য রুমে যেয়ে রাত কাটায়। সকাল হতেই রাস্তা থেকে রিক্সা ডেকে বাবার বাড়িতে চলে যায় সে। প্রয়োজন হলে সে পিতৃগৃহে জীবন কাটাবে তবু অবহেলা অনাদরের কারাগারে এক মুহুর্ত থাকবে না। এই প্রেমহীন সংসারে বেঁচে থাকার কোন আকর্ষণ নেই স্বপ্নার । চেহারায় রাত জাগার কালিমা মেখে, চোখে বিষাদের অশ্রু ঝরিয়ে জননীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। মেয়েকে দেখে মায়েরও চোখে আষাঢ়ের বৃষ্টির ঝরতে লাগলো। কান্না বিজড়িত কন্ঠে তিনি মেয়েকে বলতে লাগলেন-
‘কখন এলে মা? এমন হয়েছো কেন? কোন অসুখ করেনিতো!’
‘আমি ভালো আছি মা। তোমাকে দেখতে এলাম।’
‘কি বললে, ভালো আছো? এটা কি ভালো থাকার চেহারা?’
‘বললাম তো ভালো আছি। এর চেয়ে ভালো তোমরা আশা করবে না।’
‘কেন আশা করবো না? কি হয়েছে খুলে বলছো না কেন?’
‘তোমার জামাই কোমড়ে লাথি মেরেছে।’
‘দেখি দেখি। হাড্ডি ভেঙ্গেছে নাকি? এতোবড় সাহস গায়ে হাত তোলে।’
মায়ের চিৎকারে সবাই জড়ো হয়। প্রশ্ন করে হঠাৎ কি ঘটলো। রাস্তার পাশের বাড়ি। কেউ অসুস্থ হতে পারে। পথচলতি মানুষও বাড়িতে ঢুকে পড়ে। স্বপ্নার মা সবাইকে বলে-
‘আমার মেয়েকে তাড়িয়ে দিয়েছে শুক্কুর আলী।’
মায়ের খোলামেলা কথায় লজ্জা পায় স্বপ্না। সংসারে যা ঘটেছে তা একান্ত ব্যক্তিগত। সবার সামনে প্রকাশ করলে প্রেস্টিস বলে কিছু থাকবে? প্রতিবেশীদের মুখ দেখাবে কি করে। সে মাকে বলে,
‘মা, চুপ করো। রটিয়ে দেয়া খারাপ হচ্ছে।’
‘খারাপ বলছো কেন? লোকে জানুক শুক্কুর একটা নরপশু।’
‘বেশ হয়েছে। চুপ না করলে আমি চলে যাবো।’
‘চলে যাবি মানে? ওকে জেলে না ঢুকিয়ে তুমি চলে যাবে?’
‘কাকে জেলে ঢোকাবে তুমি। ছোট জিনিষ বড় করছো কেন?’
‘আমি ছোট জিনিষ বড় করি? এই কথা বলতে এসেছো?’
‘তোমার কাছে কিছু বলা দোষ। তুমি হলে নাটকার বংশ।’

মা মেয়ের বিতন্ডায় লোকের ভীড় বেড়ে যায়। স্বপ্নার বাবা বাড়িতে ছিলেন না। তিনি এসে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন। কি করবেন তিনি। এতো লোক বাড়ির ভেতর কি জন্য ঢুকেছে?  স্ত্রী হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
‘তোমার মেয়ে বলছে আমি নাটকার বংশ।’
‘চুপ করো। আমি দেখছি বিষয়টা।’
উনি লোক বের করে দেয়ার জন্য কোশেশ করতে লাগলেন। ‘এই যে ভাই আপনারা দয়া করে যান তো দেখি। এটা মা মেয়ের বিষয়। এখানে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয়না। ’
তার অনুরোধে সবাই যার যার কাজে চলে যায়। বাড়ি ফাঁকা হলে মা মাটিতে গড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। তা দেখে বাবা বললো,
‘স্বপ্নার মা, ধৈর্য ধরো। ও কেন এসেছে ভালো করে শুনি।’
‘কি শুনবে তুমি? ও আমাকে নাটকার বংশ বলে।’
‘বলুক না। ওর কথায় নাটকার বংশ হয়ে গেলে?’
‘তুমি ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলছো? যেমন বাবা তেমন মেয়ে।’
‘কি বাজে বলা শুরু করলে। মাথা ঠান্ডা করো।’

বাড়ির পরিবেশ খারাপ হয়ে গেলো। এই অবস্থায় স্বপ্না কাউকে মনের কষ্ট জানাতে পারলো না। সে ঘরের ভেতর চুপ করে শুয়ে থাকলো। বিকেলে শুক্কুর আলী মাইক্রো ভাড়া করে মিষ্টি আর সন্দেশ নিয়ে শ্বশুরালয়ে হাজির হলো। শ্বশুড় শ্বাশুড়ীকে কদমবুছি করে হাসিমুখে স্ত্রীর সাথে দেখা করলো সে ।
‘কি ব্যাপার স্বপ্না, আমাকে না বলে চলে এসেছো?’
‘না এসে কি করবো? তুমি কি আগের মতো আছো?’
‘কি বাজে কথা বলো? তুমি না থাকলে মনের ভেতর দোজখের আগুন জ্বলে। চলো বাড়ি যাই।’
‘তুমি যাও। আমি বাড়ি যাবোনা। এখানে না খেয়ে মরবো।’
‘হায়রে আমার পাখিরে! মিতালিতে অনির্বাণ নেমেছে। চলো খুব মজা হবে।’

নতুন ছবির কথা শুনে স্বপ্নার চেহারা উচ্ছল হয়ে উঠলো। তার রাগের মিটার শা করে নীচে নেমে গেলো। রুপালি পর্দার অনির্বাণ তার মনের পর্দায় ঝলমল করতে লাগলো। অভিমান ভুলে স্বামীকে নিয়ে ব্যস্ত হলো স্বপ্না। জামাইর আনা আকবরিয়ার মিষ্টি আর রসমালাই খেয়ে শ্বাশুড়ীর মেজাজ সহজেই খোলতাই হলো। স্বামীকে বাজারে পাঠিয়ে খরচ করে এনে শ্বাশুড়ী রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। দামী গাড়িতে করে জামাই এসেছে। আপ্যায়নে কমতি করলে কেমন হবে বিষয়টা। খাওয়া দাওয়া আনন্দ ফুর্তিতে মুহুর্তে বাড়ির চেহারা পাল্টে গেলো। ভোজন শেষে মুখে জর্দা মেশানো পান দিয়ে জামাইকে উপদেশ দিতে বসলো শ্বশুড়।
‘যাহোক বাবা, আমাদের দিন তো ফুরিয়ে এলো। ক’দিন আর বাঁচবো। স্বপ্না আমাদের একমাত্র মেয়ে। ভেবেছি ওকে তোমার হাতে দিয়ে আরামে মরতে পারবো। এসব কি শুনছি বাবা? স্ত্রী হলো গৃহলক্ষী। তার মনে আঘাত দিয়ে সংসারে সুখ আসেনা। তুমি তো অবুঝ ছেলে নও। এখন থেকে দেখে শুনে চলো।’
শ্বশুড়ের নছিহতে শুক্কুর আলীর মন গলে যায়। সে অনুধাবন করে সোহাগিনী স্বপ্নার মনে কষ্ট দেয়া তার উচিত হয়নি। সে বিনীতকন্ঠে বলে,
‘কিছু ভাববেন না আব্বাজান। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘লোকে খারাপ বলে। তোমার শ্বাশুড়ী কেঁদে আকুল।’
‘জানেন তো আব্বা। কাষ্টমারের ঝামেলায় মাথা ঠিক থাকেনা।’
‘আরে বাবা! বাইরের জন্য ঘরের শান্তি নষ্ট করতে নেই।’
‘আর ভুল হবেনা আব্বা। স্বপ্না শুধু জিদ করে।’
‘ওর জিদ একটু বেশি। সেটা নতুন কথা নয়।’
‘প্যাকনা করলে মেজাজ ঠিক থাকেনা।’

এরই মধ্যে সাজগোজ করে স্বপ্না বাবার সামনে এসে দাঁড়ায়। মেয়ের হাসিখুশি চেহারা দেখে বাবার মন আনন্দে ভরে যায়। অবাক হয়ে তিনি প্রশ্ন করেন,
‘কোথায় যাচ্ছো মা?’
‘তোমার জামাইর সাথে চলে যাচ্ছি বাবা। খালি বাড়িতে ওর সমস্যা হচ্ছে।’
‘আজকের দিনটা থেকে যাও মা।’
‘না বাবা, বাড়িতে কেউ নেই। কাজের বুয়া ফ্যাকরা করছে।’
‘একটা রাত। চোখ বন্ধ করলে কেটে যাবে।’
‘আজ থাক বাবা। অন্য একদিন রাত কাটিয়ে যাব। তুমি মাকে নিয়ে আসবে তো।’

ড্রাইভার গাড়ি ষ্টার্ট দিলে গিন্নিকে কাছে ডেকে নেয় স্বপ্নার বাবা। আবেগভরা কন্ঠে বলেন,
‘স্বপ্নার মা। কে বলবে ওরা স্বামী স্ত্রী। মনে হয় মায়ের পেটের ভাই বোন।’
‘ওর কথা বলবে না। মুখে মুখে তর্ক করে।’
‘আরে মেয়েরা অমন বলে।’
‘লাই দিয়ে মাথায় তুলেছো। তা না হলে অমন করে?’
‘তবে যাই বলো। জামাই কিন্তু মাটির মানুষ। অন্য কোথাও স্বপ্না ঘর করতে পারতো না।’

স্বপ্নার বাবার মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। একটা বাজার ফেরত মেয়েকে শুক্কুর আলীর গলায় ঝুলিয়ে দিতে পেরেছে বলে তার খুশির শেষ নেই। অমন মেয়ে বাড়িতে পড়ে থাকলে সংসারের কী দশা হতো সে কথা যে স্বপ্নার মা ভাবেনা এমনটা নয়। এই খান্নাসি মেয়েটাকে বড় করে তুলতে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। সে কারণে তারও খুশির দিকটা অবহেলা করার মতো নয়। স্বামীর কাছে তা প্রকাশ না করলেও বিচিকলা দাঁত বের করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসে সে। আর জর্দার কৌটা থেকে সুগন্ধি জর্দা নিয়ে যশোরের পরিপুষ্ট পানের সাথে মুখে পুরে দেয়।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত